বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— ধনতন্ত্র তার চলার পথে বৃহদায়তন শিল্প-কারখানার জন্ম দিয়েছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম হয়েছিল সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর। শ্রমিক শ্রেণী তার সংগঠন শক্তি, আঘাত করার ক্ষমতা এবং শতাব্দী ব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছিল ৮ ঘন্টার কাজের অধিকার, উচ্চ হারে মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা সহ নানা অধিকার। অর্জন করেছিল মালিক শ্রেণীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দরকষাকষির ক্ষমতা। বৃহদায়তন শিল্প-পরিষেবা ও সংগঠিত শ্রমশক্তি পুঁজির মুনাফার স্বার্থের বিপরীত বস্তুগত প্রবণতা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি তার মুনাফার চড়া হার বজায় রাখতে শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবিকাশমান সংগঠিত শক্তিকে চূর্ণ করার পথ খুঁজতে থাকে। প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতিকে ব্যবহার করে তারা সংগঠিত ও বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থাকে ভাঙার রাস্তা নেয় যাতে করে সংগঠিত শ্রমশক্তিকে দুর্বল করা যায়। বাড়তে থাকে সরকারি-বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রের ‘ডাউনসাইজ’ ও ‘আউটসোর্স”। এ এক আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্য। উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে, বড় শিল্প-পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে ছোট-মাঝারি ইনফরমাল ক্ষেত্রে লগ্নি পুঁজির অনুপ্রবেশ বদন্যতা বিলোবার জন্য নয়— সস্তা শ্রমশক্তি লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে। স্থায়ী নিয়োগ প্রায় বাতিল করা হয়। সরকারি-বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে ছোট-মাঝারি-ইনফরমাল ক্ষেত্রে অস্থায়ী নিয়োগ, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ প্রায় সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়ায়। উৎপাদন ব্যবস্থার অসংগঠিতকরণ আজকের মন্দাক্রান্ত ধনতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোভিয়েতের পতন লগ্নি পুঁজির কাছে সু্যোগ এনে দেয়। নয়া উদারবাদের পর্বে আগ্রাসী পুঁজি দাবি করে সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন অর্থনীতি। অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হতে থাকে। জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় তিলতিল করে গড়ে তোলা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ এবং সরকারি কোষাগারের লক্ষ কোটি টাকার বেলআউটের গতি বাড়তে থাকে। কৃষিক্ষেত্র, অরণ্যভূমি, পাহাড়, নদী, খনি, সমুদ্র, সমুদ্র উপকূল সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুন্ঠনের লক্ষ্যে সংস্কারের গতি তীব্র হয়। আগ্রাসী পুঁজির চাহিদা মতো শ্রমসংস্কার করে এ দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী জনগণকে অধিকারহীন, সংগঠনহীন অসংগঠিত সস্তা শ্রমে পরিণত করে মজুরি-দাসত্বের প্রায় আদি পর্বে ঠেলে দেওয়া হয়। তিন দশক আগে মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে পুঁজির স্বার্থবাহী যে সংস্কারপর্ব চালু হয়েছিল আজ নরেন্দ্র মোদির সরকার তাকে নির্মমভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
নয়া উদারবাদের পর্বে অসাম্য তীব্রতর হয়েছে। আম্বানি-আদানির মতো মুষ্টিমেয় ধনী-অতিধনীদের হাতে সম্পদ আরও কুক্ষিগত হয়েছে আর ব্যাপকতর শ্রমজীবী মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বঞ্চনা, দারিদ্র, বেকারি ও নিঃস্ব হওয়ার দিকে।
দেশের শ্রমজীবী জনগণের ৯০ শতাংশের বেশি আজ পরিণত হয়েছে প্রায় নিঃস্ব অসংগঠিত শ্রমশক্তিতে। তাদের না আছে জীবিকার নিশ্চয়তা, কাজের নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা। তাদের কাজের ঘন্টার ঠিকঠিকানা নেই— তারা ১০-১২-১৪ ঘন্টা পর্যন্ত খাটতে বাধ্য হন। মানুষের মতো বাঁচার জন্য মজুরি তো দূরের কথা সরকার নির্ধারিত মজুরিটুকুও এদের অধিকাংশ পান না। এদের মজুরিতে ভাগ বসায় ঠিকাদাররা। এরাই কাজের খোঁজে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে পাড়ি দেয় পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে। কোভিড লকডাউনে এদের নিদারুণ যাত্রা আমরা দেখেছি। এদের নিয়োগকর্তারা শ্রম আইনকে থোড়াই কেয়ার করে। আর সরকারই যেখানে নিয়োগকর্তা সেখানে কে শ্রম আইন প্রয়োগ করবে। সরকারি দপ্তরে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ হচ্ছে— আশা, আইসিডিএস, মিড-ডে-মিলের মতো প্রকল্প কর্মীদের সামান্য সাম্মানিক দিয়েই খালাস সরকার। দেশে-রাজ্যে নিদারুণ বেকারির আঘাত শ্রমজীবী মানুষকে যা হোক কিছু একটা কাজের জন্য তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি নিয়োগকর্তারা সেই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে চলেছে।
অসংগঠিত শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী শ্রমিকরা আরও বেশি বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অরক্ষিত। কর্মক্ষেত্রে যৌনলাঞ্ছনা যেন তাদের চিরসঙ্গী। অসংগঠিত শ্রমশক্তির সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত, আদিবাসী, মুসলমান ও অন্যান্য পশ্চাদপদ অংশের মানুষ। এরা সমাজ ও অর্থনীতির প্রান্তসীমায় বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। এরা, বিশেষত এদের পরিবারের নারী ও শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগেন। এদের পরিবারে শিশু মৃত্যুর হার বেশি। অভাবের জ্বালায় এদের শিশুরা কৈশোর পার হওয়ার আগেই কাজে লেগে পড়তে বাধ্য হয়। এদের পরিবারে নাবালিকা বিয়ের হার বেশি— এদের পরিবারের কিশোরীরা প্রায়শ পাচার হয়ে যায়।
এই অসংগঠিত শ্রমশক্তির ব্যাপক অংশই এমন কি আত্মরক্ষার প্রাথমিক সংগঠন ট্রেডইউনিয়নে সংগঠিত নয়। এদের সঙ্গে সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীদের আর্থিক-সামাজিক-চেতনাগত ব্যবধানও দুস্তর। কিন্তু এই অসংগঠিত শ্রমজীবী জনতার উত্থান ছাড়া ভারতীয় সমাজের উত্থান কি করে সম্ভব? এই অসংগঠিত শ্রমশক্তিকে সচেতন ও সংগঠিত না করে কিভাবে শ্রমিক আন্দোলনের নতুনতর পর্বে আমরা পৌঁছাতে পারবো।
বিগত সময়পর্বে বামপন্থী দল ও কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নগুলি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন অসংগঠিত শ্রমজীবীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটে আশা, আইসিডিএস-এর প্রকল্প কর্মীরা উল্লেখযোগ্যভাবে অংশ নিয়েছেন— তারা নিজেদের দাবি নিয়েও বিভিন্ন রাজ্যে সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন। কিন্তু যেতে হবে আরও অনেক পথ। অসংগঠিত শ্রমজীবীদের সংগঠিত করার কাজে বামপন্থী দল, ট্রেডইউনিয়ন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে হবে। সংগঠিত ক্ষেত্রের সচেতন শ্রমিক, আলোকিত বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-যুবদের এগিয়ে যেতে হবে অসংগঠিত শ্রমজীবীদের জীবন যন্ত্রণার পাশে। সারা বছর কাজ, কাজের নিশ্চয়তা, বাঁচার মতো মজুরি, ৮ ঘন্টা কাজ, সামাজিক সুরক্ষা, ইউনিয়ন করার অধিকার, খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো দাবিগুলি পৌঁছে দিতে তাদের কাছে। শ্রমজীবী ভারত গড়ার পথে এ হবে প্রাথমিক পদক্ষেপ। এই হোক মে দিবসের ডাক।