বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা ১ মে, ২০২৩— পুঁজিবাদ লাঞ্ছিত এই অসাম্যের বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই তো মে দিন। তবুও ১৮৮৬ সালে ৪ঠা মে আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী চিকাগোর শহরে মালিক শ্রেণী ও সরকারের হিংস্র আক্রমণ মোকাবিলা করে ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা ও ৮ ঘন্টা বিনোদনের অধিকারের দাবিতে যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের যাত্রা শুরু করেছিলেন তা আজও অমীমাংসিত। দুনিয়া জুড়ে তাই আজও শ্রমজীবী মানুষ অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রামের সেই পতাকাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। শতাব্দী ব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন ৮ ঘন্টার কাজের অধিকার, উচ্চ হারে মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা সহ নানা অধিকার। অর্জন করেছিলেন মালিক শ্রেণীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দরকষাকষির ক্ষমতা। আজ নয়া উদারনীতির পর্বে একে একে সেই অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়ার নিষ্ঠুর অভিযান চালানো হচ্ছে।
১৮৮৯ সালে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিকদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হে মার্কেটের শহীদদের স্মরণ করে পৃথিবীর দেশে দেশে ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে সারা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী মানুষ মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বপ্ন আরও একবার ঝালিয়ে নিতে ১লা মে উদযাপন করে আসছেন। এই ঐতিহাসিক উপলক্ষ্যে শ্রমজীবী মানুষ ঠিক করেন কীভাবে মালিক, সরকার ও লগ্নিপুঁজির হামলাকে মোকাবেলা করবেন। অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে অধিকারগুলি শ্রমজীবী মানুষ অর্জন করেছিলেন, আজকের নয়া উদারবাদী সময়পর্বে লগ্নিপুঁজির আক্রমণগুলিকে প্রতিরাধ করে কীভাবে তাঁরা সেই অধিকারগুলিকে রক্ষা করবেন ও সম্প্রসারিত করবেন।
তিন দশক আগে সোভিয়েতের পতনে আহ্লাদিত হয়েছিলেন লগ্নিপুঁজির কর্ণধাররা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী দুনিয়া সারা পৃথিবীর উপর চাপিয়ে দিয়েছিল নয়া উদারবাদী লুঠের অর্থনৈতিক শৃংখল। অর্থনীতিকে পুরোপুরি বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। অর্থনীতিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার নামে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে জলের দরে বেচে দেওয়া হতে থাকল বেসরকারি পুঁজির কাছে। জল-জঙ্গল-জমি, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, প্রকৃতির কোনও কিছুই পুঁজির উদগ্র লালসা থেকে রক্ষা পেল না— যা জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নকে তীব্র করে তুললো। খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বনাশ করে ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্য খুলে দেওয়া হল। শ্রমজীবী মানুষের বহু সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারগুলিকে ক্রমাগত সংকুচিত করার প্রয়াস চলছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই ছুড়ে ফেলে শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, অবসরকালীন সুরক্ষা, পেনশন ছাঁটাই শুরু হয়ে গেল। এ হল পুঁজির মুনাফার হারকে বৃদ্ধি করার নিষ্ঠুর অভিযান। উন্নত প্রযুক্তি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটিয়ে শিল্প-পরিষেবায় শ্রমশক্তির নিয়োগ বিপুলভাবে কমিয়ে ফেলা হল এবং পুঁজির মুনাফার হারকে অবিশ্বাস্য মাত্রায় বাড়িয়ে তোলা হল।
কিন্তু নিছক অর্থনৈতিক লুঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না নয়া উদারবাদী অভিযান। এক মেরু বিশ্বে অবাধ্য রাষ্ট্রনায়কদের শায়েস্তা করতে এবং ওই দেশগুলির প্রাকৃতিক সম্পদের দখল নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ধ্বংস করল ইরাককে, ধ্বংস করল লিবিয়াকে। “দুষ্ট চতুষ্টয়” বলে চিহ্নিত করা হল ইরাক, ইরান, কিউবা ও উত্তর কোরিয়াকে। আর্থিক অবরোধ থেকে সামরিক হুমকি এবং জলজ্যান্ত মিথ্যা প্রচার চলতে থাকল তাদেরকে নিকেশ করার অভিপ্রায়ে— যার পরিণতি ইরাক ধ্বংস।
সোভিয়েতের পতনের পর ওয়ারস চুক্তি ভেঙে গেল কিন্তু ন্যাটো ভেঙে দেওয়া হল না। পূর্ব ইউরোপের বহু দেশকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা চললো জোরকদমে। যুগোস্লোভিয়াকে সাত টুকরো করা হল। পূর্ব ইউরোপ হয়ে উঠল পশ্চিমী লুঠের অবাধ ক্ষেত্র। পশ্চিমী গণতন্ত্রের ধাঁচায় সারা পৃথিবীতে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে তারা প্রায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। পশ্চিমী শক্তির আধিপত্য ও কপিবুক গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে যে দেশগুলি স্বকীয়ভাবে বিকাশ ও গণতন্ত্রের চর্চার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে তারাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এবং পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যমের রোষানলে পড়ছে। ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া থেকে মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস সহ একের পর এক দেশে বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের উত্থান মার্কিন ত্রাসের কারণ হয়ে উঠেছে। আর্থিক শক্তি হিসাবে চীনের অভ্যূদয় এবং রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সমঝোতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী শক্তির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক আধিপত্যের বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং চীন-রাশিয়াকে বিপদে ফেলা তাদের রণনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব এক মেরু বিশ্ব এখন অতীত। আজ পৃথিবী বহু মেরুকরণের পথে এগিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতি শ্রমজীবী মানুষকে নিজেদের সংগ্রাম বেগবান করার বাহ্যিক পরিবেশ সুযোগ দিচ্ছে।
একাধিপত্য, যুদ্ধ ও সামরিক হুমকি দিয়ে সাধের ধনতন্ত্রকে সংকট থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। বিগত সময়পর্বে নয়া উদারনীতি ধনতন্ত্রের অন্তসারশূণ্য দেউলিয়া চরিত্রকে প্রকট হয়েছে। আমেরিকা থেকে উদ্ভূত মহামন্দা প্রায় সারা পৃথিবীকে গ্রাস করে। কয়েক কোটি মানুষ কাজ হারায়। নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায় অতিকায় সংস্থাগুলিকে ট্রিলিয়ন ডলার, পাউন্ড, ইউরো বেলআউট করেও ২০০৮ সালের মন্দা থেকে পশ্চিমী বিশ্ব বেরিয়ে আসাতে পারেনি। সরকারের ভারসাম্যহীন নীতির পরিণতিতে অসাম্য আরও তীব্র হয়েছে।
অতিমারি সারা পৃথিবী সর্বনাশ ডেকে আনলেও অতিকায় বহুজাতিক সংস্থার কাছে পৌষ মাস হয়ে দাঁড়ায়। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারায়। আর সরকারি কোষাগার থেকে কোটি কোটি মুদ্রা বেলআউট করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ভ্যাকসিন জনসেবার দাম মেটানো হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে ধনতন্ত্রের সংকট কাটার সম্ভাবনা ক্রমেই দূর হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যুদ্ধ ও অস্ত্রের ব্যবসাই ভরসা। রাশিয়ার বিস্তর্ণ ক্ষেত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদ কব্জা করতে পারলে মন্দ হয় না। রসদ ও অস্ত্রের সম্ভার দিয়ে জেলেনস্কির ইউক্রেনকে সজ্জিত করা হল। রাশিয়া হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলো— ইউক্রেনের পিছনে যে আমেরিকা ও ন্যাটো প্রক্সি যুদ্ধ চালানোর অপেক্ষায় আছে, সে হিসাব রাশিয়া করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিজ নিজ দেশের শ্রমজীবী জনতাকে চূড়ান্ত দুর্দশায় ফেলে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করল। রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর অধিকাংশ ইউরোপ নির্ভর করতো। রাশিয়ার থেকে সস্তা তেল ও গ্যাসের আমদানি বন্ধ হয়ে হয়ে যাওয়ায় ইউরোপকে চড়া দাম দিয়ে তেল ও গ্যাস কিনতে বাধ্য হতে হল আমেরিকা ও তার মিত্র দেশ থেকে বা ঘুরপথে রাশিয়ার তেল ভারতের মতো দেশ থেকে বেশি দামে।
চড়া দামে তেল-গ্যাস কিনতে গিয়ে ইউরোপের দেশে দেশে সরকারি কোষাগারে টান পড়ল। ছাঁটাই হতে থাকল নানা জনকল্যাণের সরকারি প্রকল্প। শ্রমজীবী জনতা জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ল। তাই ইউরোপ জুড়ে বেঁচে থাকার তাড়নায় শ্রমিক ধর্মঘটের ঢেউ— মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বা অবসরের বয়স বাড়ানোর প্রতিবাদে— ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে কানাডা এবং খোদ আমেরিকায় আছড়ে পড়ছে শ্রমিক ধর্মঘট। এর বাইরে নেই আমদের দেশ ও রাজ্য।
এই দেশের শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী মানুষ দেশের রেল, প্রতিরক্ষা সহ রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করার প্রতিটি প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধের মাধ্যমে মোকাবিলা করার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই রাজ্য শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং যোগ্যদের নিয়োগের দাবিতে লাগাতার লড়াই সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। সম্মানজনক ভাবে জীবন ধারণের জন্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্সরা বকেয়া ডিএ বা মহার্ঘভাতার দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল কর্মীরা রাস্তায় নেমেছেন স্থায়ীকরণ ও সম্মানজনক মজুরির দাবিতে। ব্লিঙ্কিট, জোমাটো, সুইগির কর্মীরা এবং অ্যাপ ড্রাইভাররা সংগঠিত হচ্ছেন উন্নত মজুরি ও অধিকারের দাবিতে। নয়া উদারবাদের সমস্ত বহিঃপ্রকাশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জেগে উঠছে।