বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী মানুষ এক অভাবনীয় সংকটজনক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ১ মে, ২০২৫ মে-দিবস উদযাপন করছেন। বিগত শতাব্দীর মহা মন্দার পর এরকম বিপর্যয়ের মুখে শ্রমজীবী মানুষ পড়েননি। ধনতন্ত্র অন্তহীন অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বার হতে ব্যর্থ হচ্ছে।
গভীর অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে বিগত শতাব্দীতে পুরানো সাম্রাজ্যবাদী অধিশ্বররা দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ ডেকে এনেছে — আর মানব সভ্যতাকে উপহার দিয়েছে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু এবং অবর্ণনীয় ধ্বংস। কিন্তু পরিণতিতে প্রায় সারা পৃথিবীর উপনিবেশগুলি রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণা করে। রাশিয়া ও চীন সাম্রাজ্যবাদী শৃংখল থেকে মুক্তি পায়। একুশ শতাব্দীতে আর একটি বিশ্বযুদ্ধ বাধানো তাদের পক্ষে কার্যত সম্ভব নয়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটলে গোটা মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলির কাছে রয়েছে বিধ্বংসী পরমাণু বোমা।
কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ ও শ্রম সম্পদের অবাধ লুঠের জন্য আমেরিকা এবং তার সহযোগী ও উপগ্রহ রাষ্ট্রগুলি বার বার আঞ্চলিক যুদ্ধে গেছে। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও প্রক্সি যুদ্ধে — পূর্বতন যুগোশ্লোভিয়ায়, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্থান, সুদান, ইউক্রেন, প্যালেস্তাইন, লেবানন, ইয়েমেন তার উদাহরণ। কোনও আঞ্চলিক যুদ্ধেই তাদের সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং ডেকে এনেছে বিপর্যয় ও বিশ্ববাসীর ধিক্কার। এখন ট্রাম্প কানাডা, গ্রীনল্যান্ড, পানামা, গাজা দখলের স্বপ্নবিলাস করেছেন।
বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে, বশ্যতার দাবি জানিয়ে ট্রাম্প চীন, কানাডা, মেক্সিকো, থেকে ইউরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত সহ প্রায় সমস্ত দেশের উপর বিপুল হারে আমদানি শুল্ক বসিয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় দেশগুলি আমেরিকার উপর পাল্টা শুল্ক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীর শেয়ার বাজারে অভাবনীয় পতন ঘটে। যা ছিল বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকোচনের পূর্বাভাস। অর্থনীতির সংকোচনে সব থেকে ক্ষতির মুখে পড়ে শ্রমজীবী মানুষ। পরে ট্রাম্প চীন ছাড়া অন্য দেশগুলির উপর শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রেখেছেন। এমনকি চীনের সঙ্গে আলোচনার কথাও বলেছেন। এই প্রসঙ্গে গত শতাব্দীর ৩০এর দশকের মহা মন্দার আগে আমেরিকার কঠোর শুল্ক নীতি স্মরণ করা যায় — যা ছিল মহা মন্দার অন্যতম কারণ।
আজকের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা হল, পর্দার আড়ালে নয়, পাশাপাশি। আজ আর পার্লামেন্ট বা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পর্দার আড়ালে নয় — ট্রাম্পের সঙ্গে ইলান মাস্ক প্রকাশ্যে। ট্রাম্প সরকারি দপ্তর বন্ধ করে দিচ্ছেন, কর্মীদের ছাঁটাই করছেন। এদেশে নরেন্দ্র মোদি সরকার আদানি, আম্বানি, টাটার মতো কর্পোরেটদের অবাধ মুনাফার স্বার্থে জমি, অরণ্য, নদীর জল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনসাধারণের করের টাকায় গড়া রেল, প্রতিরক্ষা, টেলিকম থেকে ব্যাঙ্ক, বীমা রাষ্ট্রীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। শ্রমিকদের বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নিতে — ৮ ঘন্টার কাজের অধিকার বাতিল করে ১২ ঘন্টা কাজ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় অবাধে অস্থায়ী চুক্তি-ভিত্তিক কর্মী নিয়োগ, নাম মাত্র মজুরিতে কাজ করানো আইনসিদ্ধ করতে, ইউনিয়ন করা ও ধর্মঘট কার্যত নিষিদ্ধ করতে শ্রম কোড চালু করা হয়েছে।
শ্রমজীবী জনতার মধ্যে বিভাজন আনতে আমেরিকার ট্রাম্প ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি অভিবাসী বিরোধী হুঙ্কার দিচ্ছে। এদেশে চালানো হচ্ছে সংখ্যালঘু বিরোধী সংখ্যাগুরুবাদের অভিযান।
কর্পোরেট ও শাসকদের যৌথ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে নামতে না পারে তার জন্য ধর্ম, ভাষা, জাতি, বর্ণ, গায়ের রঙ সহ বহুমাত্রিক বিভাজনের পরিকল্পনা চলছে। শাসকদের সংখ্যাগুরুবাদের উগ্র অভিযানকে প্রতিহত করতে দেশের বহুত্ববাদকে রক্ষা করতে সমাজ বদলে বিশ্বাসী সমস্ত শক্তিকে শ্রমজীবী, প্রান্তিক, পিছিয়ে থাকা নিপীড়িত জনতার জীবন-জীবিকার সংগ্রামে সামিল হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ব্যাপকতম শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই-ই হয়ে উঠতে পারে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্গ। এই লক্ষ্যে আগামী ২০ মে দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে শ্রমজীবী মানুষের দরজায় দরজায়।
ইসলামী সন্ত্রাসবাদী শক্তি যখন কাশ্মীরের পহেলগামে হিন্দু পর্যটকের সঙ্গে কাশ্মীরী টাট্টু চালককে হত্যা করে বা মুর্শিদাবাদে ধর্মের নামে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ খুন হয়, তখন বোঝা যায় বিপদ শুধু সীমান্তে নয়, ঘরের মধ্যে। যে কোনও ধর্মের মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসবাদ প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসবাদকে বেড়ে উঠতে ইন্ধন যোগায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। তাই মে দিবসের ডাক হল, শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।