বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২— শারোদৎসব সমাগত। ক্লাবগুলি খুঁটি পুজো করে দুর্গা পুজোর মহা আয়োজনে ব্যস্ত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবছর ৪৩ হাজার ক্লাবকে রাজ্যের কোষাগার থেকে ৬০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। পুজো উপলক্ষ্যে ক্লাবগুলির বিদ্যুতের খরচের ৬০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার কথাও তিনি জানিয়েছেন। সিইএসসি বেসরকারি সংস্থা, তারা কীভাবে এই গুনাগার উসুল করবে, কলকাতাবাসী অনুমান করতে পারেন, পুজোর পর হঠাৎ বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। কিন্তু রাজ্য সরকার পরিচালিত রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন পর্ষদ এই গুনাগার উসুল করতে কি বেসরকারি সংস্থার পদাংঙ্ক অনুসরণ করবে, না সংস্থার লোকসানের বোঝা বাড়ানোর পথে হাটবে। বছর বছর বেড়ে চলা সরকারি ঋণের টাকায় এবং জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় ক্লাবগুলিকে উৎসাহ দান চলছেই। এবার আবার পুজোর এক মাস আগে থেকে উৎসব শুরু হয়ে যাবে। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় বাংলার দুর্গা পুজো স্থান পাওয়ায় ১ সেপ্টেম্বর দুর্গা পুজোর মহা র্যালির আয়োজন করেছে সরকার।
মাত্র ১১ বছরে এই রাজ্যের ঋণের বোঝা প্রায় দু’ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া ডিএ ৩১ শতাংশ। মে মাসে আদালত তিন মাসের মধ্যে বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও সেই সময়সীমা অতিক্রান্ত। কোষাগারের সামর্থ্যের পুরোনো যুক্তি দেখিয়ে সরকার আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আর্জি জানিয়েছে। সরকারের যুক্তি, বকেয়া ডিএ দিতে গেলে রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথীর মতো কল্যাণ প্রকল্পের টাকায় টান পড়বে। ওদিকে সরকার বকেয়া না মেটানোয় বেসরকারি হাসপাতালগুলি স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের দরিদ্র রুগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। জেলায় জেলায় সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল বানানো হয়েছে— বাইরে ঝাঁ চকচকে প্রবেশদ্বার, কিন্তু প্রয়োজনীয় ডাক্তারের অভাব, বরাদ্দের অভাবে জরুরি চিকিৎসার যন্ত্রপাতি নেই বা অকেজো হয়ে পড়ে আছে, নতুন যন্ত্রপাতি কেনা যাচ্ছে না, জীবনদায়ী ওষুধ কেনায় টান পড়ছে।
প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ অভাবে প্রায় সব সরকারি দপ্তরের জরুরি কাজ আটকে থাকছে। স্কুল, হাসপাতাল থেকে সমস্ত সরকারি দপ্তরে অসংখ্য শূণ্যপদ খালি পড়ে থাকছে, স্থায়ী নিয়োগ নামমাত্র, অস্থায়ী চুক্তি ভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করে কাজ চালানো হচ্ছে। অনেক দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের সামান্য কনসোলিডেটেড বেতনও মাসের পর মাস বকেয়া পড়ে থাকছে।
রাজ্যজুড়ে শিক্ষকের বিপুল ঘাটতি স্কুলশিক্ষার প্রতিটি স্তরে এক প্রকট সমস্যা। এক-দুই-তিন জন শিক্ষক বহু স্কুলে শত শত ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। অসংখ্য শিক্ষকপদ শূণ্য পড়ে থাকছে। ছাত্রছাত্রীরা প্রয়োজনীয় যত্ন পাচ্ছে না। রাজ্যে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। ছাত্রসংখ্যা কমছে। অতিমারির দু’ বছরে পড়াশোনা বন্ধ থাকায় লক্ষ লক্ষ দরিদ্র প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের শিক্ষা ও জীবনের ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকারের মুখে। এর মধ্যে স্কুলশিক্ষার প্রতিটি স্তরে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির কারণে শুধুমাত্র যোগ্যপ্রার্থীদের প্রতিই অবিচার করা হয়নি, সরকার পোষিত স্কুলগুলির বিশ্বাসযোগ্যতাকে বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। ধান সংগ্রহে যেটুকু অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে তার সিংহভাগ অংশ আত্মসাৎ করছে ফড়ে, দালাল এবং নামে-বেনামে অনুব্রতের মতো নেতা এবং শাসক দলের আনুকূল্য ধন্য চালকল মালিকরা।
কেন্দ্রীয় সরকার একশো দিনের কাজে বরাদ্দ কমিয়েছে। তার উপর, রাজ্য সরকার একশো দিনের কাজের হিসেব না দেওয়াতে এবছর কেন্দ্র রাজ্যের বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজ করেও অসংখ্য শ্রমজীবী প্রাপ্য মজুরি পাচ্ছেন না। গ্রামের দরিদ্র-প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ বিপর্যয়ের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, বিভিন্ন কল্যাণ প্রকল্প বন্টনে শাসক দলের নির্লজ্জ কাটমানি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে গরু পাচার, বেআইনি কয়লা খাদান, পাথর খাদান, বালি খাদানে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী ও মদতপুষ্টদের নির্লজ্জ দুর্নীতি এবং কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ আত্মসাৎ রাজ্যের সাধারণ মানুষ নিশ্চিতভাবেই নজরে রাখছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি ও দেশদ্রোহী নীতির আড়ালে রাজ্য সরকারের অন্যায়-ভ্রষ্টাচার আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। আগামী বছরে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্লাবগুলিকে দাক্ষিণ্য বিতরণ হল টাকা দিয়ে শাসকের আনুগত্য কেনার নির্লজ্জ প্রয়াস মাত্র।