বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
পেটের জ্বালা বিষম জ্বালা। যারা সেই জ্বালা ভোগ করেননি, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় তা কতটা ভয়ানক। সন্তান-পরিবারকে ক্ষুধার অন্ন জোগাতে না পারার যন্ত্রণা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা না করাতে পারার যন্ত্রণা, পরিবারের মানুষের অসুখ-বিসুখে ডাক্তার-বদ্দি না করাতে পারার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তাই স্বজন-পরিজন ছেড়ে দূরে, বহু দূরে যেতে বাধ্য হন এই পোড়া দেশ-রাজ্যের কোটি কোটি প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ। এরাই পরিযায়ী শ্রমিক। এরা দেশের মোট শ্রমশক্তির ৯৩ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিকদের একটা বড় অংশ।
এই ভরা বর্ষার মরসুমে পেটের বিষম জ্বালায় কাজে যেতে হয়েছিল মালদা-রতুয়ার শ্রমজীবী মানুষদের। সামান্য জমি আছে কি নেই। কাজের কোনও সংস্থান নেই। ১০০ দিনের কাজও নেই। কেন্দ্র টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। রাজ্য আগের হিসেব দেয়নি। তাই বর্ষার মধ্যেই এই শ্রমজীবীরা মিজোরামের সাইরাংয়ে নির্মীয়মাণ রেলসেতুর কাজে গিয়েছিলেন। তাদের পথ চেয়ে ছিলেন স্ত্রী-সন্তানরা। কবে তারা ফিরবেন কষ্টার্জিত উপার্জন নিয়ে, সংসারের অভাব কিছুটা মিটবে। ২৩ জন হতভাগ্য মানুষগুলো লাশ হয়ে ফিরলেন।
লাশ ঘরে ফেরার আগেই সাংসদ-নেতারা পৌঁছে গেলেন হতভাগ্যদের বাড়িতে। ২ লক্ষ টাকার চেক, সান্তনা আর সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। রেল বোর্ড ১০ লক্ষ করে টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ এক করুণ রসিকতা, এই শ্রমজীবী মানুষেরা বেঁচে থাকতে তাদের কাজ ও সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা হল না। মৃত্যুর পর সান্তনা আর টাকার চেক নিয়ে হাজির কেন্দ্র-রাজ্য।
এই মর্মান্তিক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে মুর্শিদাবাদের সমশেরগঞ্জের তিন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হল। ধার করে, দাদন নিয়ে তারা ২৪ তলা বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ করতে গিয়েছিলেন। বিদ্যুতপৃষ্ঠ হয়ে তারা মারা যান। মুম্বাইয়ে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে মুর্শিদাবাদের বড়ঞার ৬৩ বছরের শ্রমজীবী এক পৌঢ়ের।
কয়েক মাস আগে উড়িষ্যার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ২৬৪ জন। তাদের মধ্যে শতাধিক মানুষ ছিলেন বাংলার শ্রমজীবী। তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল শ্রমজীবী মানুষের জীবনের দাম বড় সস্তা।
অতিমারির সময় লকডাউনে আমরা দেখেছিলাম অনন্যোপায় চলমান শ্রমজীবী ভারতকে। পেটের জ্বালায় দূর দূরান্তের গ্রাম, গ্রামান্তর, মফস্বল শহর, বড় শহরের বস্তি থেকে যারা এসেছিলেন বড় বড় শহরগুলির আলো আঁধারির অন্তরালে কোনওক্রমে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে। কাজ জুটেছিল ছোট, মাঝারি কারখানায়, ইনফর্মাল ক্ষেত্রে, নির্মাণ প্রকল্পে বা কৃষি ক্ষেত্রে। আইনে যা স্বীকৃত তার চেয়েও কম মজুরি। নেই পিএফ, নেই বোনাস, নেই ইএসআই, নেই স্বাস্থ্যবিমা নেই। সবরকম নিরাপত্তাহীন একটা অস্তিত্ব। কাজ করলে জুটবে শুধু মজুরি। তাতেও ভাগ বসায় কন্ট্রাক্টর, পুলিশ থেকে সব রকমের মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। এখন আর এই শ্রমজীবীরা কেবল উত্তর-দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতে নয়, কাজের খোঁজে ছুটে যাচ্ছেন মিজোরামে, সুদূর উত্তর-পূর্ব ভারতে, কাশ্মীরে।
আর এই সস্তা শ্রমই আজ প্রায় অচল হয়ে যাওয়া অতিবৃদ্ধ ধনতন্ত্রের জীয়নকাঠি। শাসন ক্ষমতার সঙ্গে যোগসাজসে প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আত্মসাৎ করেও তারা পুঁজির মুনাফার হার বাড়িয়ে তুলতে পারছে না। নয়া উদারনীতির পৃথিবীতে ধনতন্ত্রের অস্তিত্ব রাখার জীয়নকাঠি সেই সস্তা শ্রম। যে পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে নিদারুণ অসাম্য, ক্ষুধা, বেকারি, কাজের অনিশ্চয়তা, মজুরি অনিশ্চয়তা, সামাজিক সুরক্ষা সহ সমস্ত অধিকারহীনতার দিকে।
আর শ্রমজীবী মানুষ ক্ষুধার জ্বালায়, বেঁচে থাকার তাড়নায় কাজের খোঁজে ছুটে যায় এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে, এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। এক সময় যেমন ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রামীণ শ্রমজীবীরা পুবে নামাল খাটতে যেত বর্ধমান, হুগলীতে। বেঁচে থাকার তাড়নায় প্রান্তিক শ্রমজীবীদের একাংশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেয় সুরক্ষাহীন বেআইনি বাজি কারখানায় এগরা, দত্তপুকুর, বজবজ-নুঙ্গি আর চম্পাহাটিতে। তাদের কেউ মারা যায় বেঘোরে এগরা বা দত্তপুকুরে। ক্ষুধার হাত থেকে মানুষের বেঁচে থাকার তাড়নাকে ব্যবহার করে বাজি কারখানার আড়ালে চলতে থাকে বোমা তৈরির কারখানাও।
রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলতে থাকে। এই বোমা কি ব্যবহার হচ্ছে শাসক দলের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে না পাচার হচ্ছে বাংলাদেশে। কিন্তু শ্রমজীবীদের ক্ষুধার জ্বালা মেটে না। তাদের কাজের ব্যবস্থা হয় না। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় অকালে। পরিবারের মানুষের অসুখ-বিসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় না।
কেউ বলছেন মালদা, মুর্শিদাবাদ পরিযায়ী শ্রমিকদের হাব। বাস্তবত সারা পশ্চিমবাংলা পরিযায়ী শ্রমিকদের হাব হয়ে উঠেছে। ৭৭ বছরের স্বাধীনতা বা ১২ বছরে পরিবর্তনের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ব্যর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের কাজের ব্যবস্থা করতে। ব্যর্থ শ্রমজীবীদের বেঁচে থাকার মতো মজুরির নিশ্চয়তা করতে। ব্যর্থ অবসরকালীন ভাতা, চিকিৎসার সুরক্ষা সহ সামাজিক সুরক্ষা দিতে। ব্যর্থ শ্রমজীবীদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা চালু রাখতে।
আর সেজন্য শ্রমজীবীদের অধিকার, কাজ, সম্মানজনক মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, শ্রমজীবীদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দাবিতে বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবি।