বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার আগেই ভারতের প্রায় সবকটি কারবারি সংবাদমাধ্যম দেশের সবকটি ভাষায় জনমত সমীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেছিল। তা যে জনমতের পূর্বাভাস নয়, দেশের কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও শাসকদের জয়ের আকাঙ্ক্ষা ও দম্ভের প্রকাশ, প্রমাণ হয়েছে। জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে এই সমীক্ষাগুলি করা হয়েছিল। প্রবল পরাক্রান্ত শাসকরা যে কার্যত পরাজিত হতে পারে এরকম অনুমান করতে বিশ্লেষকদের অধিকাংশ সাহস করেননি। দেশের গণদেবতা অলক্ষ্যে অন্যরকম ভেবেছিলেন। দেশের শাসকদল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে ব্যর্থ করতে হয়েছে। আপাতত শাসকদের অশ্বের লাগাম টেনে ধরেছেন দেশবাসী।
কতগুলি কারণ দেশবাসীকে অপ্রসন্ন করেছে। মোদির শাসনে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ এবং হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শক্তির স্বার্থ একাকার হয়ে গেছে।
কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের সম্পদ ও মুনাফা ফুলেফেঁপে উঠেছে। বৈষম্য বহুগুণ বেড়েছে, বেড়েছে দারিদ্র, বেকারি রেকর্ড ছাড়িয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও ক্ষেতমজুর ও সর্বস্তরের অসংগঠিত শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি। নারী শ্রম যেন সব থেকে সস্তা। শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা ছাঁটাই হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ কাজের জন্য হাহাকার করছেন। কোটি কোটি বেকার কাজের খোঁজে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যেতে বাধ্য হয়েছেন অরক্ষিত পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বেশি করে তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি কারবারিদের হাতে। দরিদ্র, প্রান্তিক, শ্রমজীবী মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটাই হয়ে উঠেছে দায়।
কর্পোরেট লুঠের স্বার্থে বহু সংগ্রামে অধিকারগুলি কেড়ে নিতে একের পর জনবিরোধী কার্যক্রম নিয়েছে সরকার। কৃষকদের জমি ও ফসলর অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে আইন করে। শ্রমিকদের সংগ্রাম ও সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নিতে নতুন আইন পাশ করা হয়েছে। জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় গড়া লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র এবং প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। জনবিরোধী আইন ও কাজ করার আগে সংসদে আলোচনার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি সরকার। বিতর্ক আটকাতে ১৪৩ জন সাংসদকে নজিরবিহীন ভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই ঔদ্ধত্য ভাল চোখে দেখেননি দেশবাসী।
মোদির শাসনে এই বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের বহুত্ববাদ আক্রান্ত হয়েছে। দেশের সংবিধান, গণতান্ত্রিক উপাদান, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, গণতান্ত্রিক অধিকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা — সবকিছুই ধ্বংস করার লক্ষ্যে শাসকরা এগোচ্ছিল। বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর রাম মন্দির নির্মাণ, দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা, নিম্নবর্ণ ও মুসলমানদের উপর আক্রমণ দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন থেকে মানুষ প্রত্যয় সংগ্রহ করেছেন। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, হরিয়ানায় পরাজিত হয়েছে শাসকরা।
শাসকরা ৩৭০ ধরা বাতিল করে কাশ্মীরের ঐক্য ও স্বাধিকার খন্ডিত করেছিল। লাদাখ সহ জম্মু ও কাশ্মীরে পরাজিত হয়েছে শাসকরা। জাতিদাঙ্গায় রক্তস্নাত মণিপুরে খাতা খুলতে পারেনি শাসকরা। হিন্দুত্ববাদী ভারত গঠনের আগ্রাসী প্রচেষ্টা দেশবাসীকে অপ্রসন্ন করেছে।
শাসকরা চেয়েছিল কংগ্রেস মুক্ত ভারত এবং বিরোধী মুক্ত ভারত। বিরোধীদের দুর্বলতাগুলিকে ব্যবহার করে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে। একদিকে টাকার থলি, অন্যদিকে ভয় দেখিয়ে বিরোধী দল ভাঙিয়ে রাজ্যে রাজ্যে সরকার গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচনে কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলি রাজ্যে রাজ্যে বড় জয় পেয়েছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোট শাসকদের দুর্বল করার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে। বামপন্থী শক্তি সারা দেশে সব মিলিয়ে মাত্র ৮টি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে।
সারা দেশের মতো পশ্চিমবাংলার মানুষ বিজেপিকে রুখতে ভোট দিয়েছেন। বাংলার মানুষ বাম-কংগ্রেসের জোটকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করেননি। রাজ্যের শাসক দল তার ফলে বড় জয় পেয়েছে। কারবারি সংবাদমাধ্যম এই জয়কে কেবলমাত্র লক্ষ্মী ভান্ডারের মতো প্রকল্পগুলির প্রতি মানুষের সমর্থন বললেও বহু জায়গাতে বাহুবল ও অর্থবল ব্যবহার করা হয়েছে ভোটে জেতার জন্য। এই রায়কে রাজ্যের শাসক দলের সমস্ত অন্যায়ের প্রতি মানুষের সমর্থন ভাবলে ভুল হবে।
সাম্প্রদায়িক শক্তি কিছুটা দুর্বল হলেও শ্রমজীবী জনগণের জীবন-জীবিকার আন্দোলনগুলির মধ্য দিয়ে কর্পোরেট স্বার্থের রক্ষক সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে হবে। নবীন প্রজন্মের বামপন্থী নেতা-কর্মীদের সেই কাজের জন্য পৌঁছে যেতে হবে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুরের দ্বারে দ্বারে।