বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

বাংলাদেশের পালাবদলে উদ্বেগ

বাংলাদেশের পালাবদলে উদ্বেগ

সম্পাদকীয়, ১৫ অগাস্ট, ২০২৪

photo

রক্ত নদীর পথ বেয়ে বাংলাদেশের পালাবদল ঘটেছে। পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে আপাতত ভারতে। ব্রিটেন তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ভিসা বাতিল করে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তিনি আবার পশ্চিমের দেশগুলির কাছে গ্রহণযোগ্য। আমেরিকাও উদগ্রীব হয়ে আছে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনা সরকার সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা বাতিল করেছিল। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশের হাইকোর্ট হাসিনা সরকারের কোটা বাতিল করার সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণার পর কোটা বাতিলের দাবিতে আবার আন্দোলন আবার শুরু হয়। এই সময়ে শেখ হাসিনার “রাজাকারের নাতি-পুতিরা এ সুবিধা পাবে” মন্তব্য ‘ব্যাক-ফায়ার’ করে। ওই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে ছাত্রদের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে বিএনপি ও জামায়েতের মতো শক্তি। ১ জুলাই থেকে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ গড়ে ওঠে। হাসিনা সরকার কঠোর হাতে এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে আরও ভুল করে। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে দেয় এবং ছাত্র আন্দোলনের দাবি মেনে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৫ শতাংশ কোটা ঘোষণা করে। তাসত্ত্বেও আন্দোলন চলতে থাকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে। সংক্ষিপ্ত এক মাসের ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশে পালাবদলের কাজটি সম্পন্ন করে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশের মধ্যেকার মৌলবাদী, দক্ষিণপন্থী, ভারত-বিরোধী শক্তি এবং বৈদেশিক শক্তির যোগসাজসে বাংলাদেশের পালাবদল। এই কাজে হাতিয়ার হয়েছে হাসিনা সরকারের ক্রমশ বেড়ে চলা গণতন্ত্র বিরোধী স্বৈরাচারী প্রবণতা।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম লগ্ন থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। পূর্ব বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনার জওয়ানরা এক সঙ্গে লড়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একবারই ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণের সুর মিলেমিশে একাকার হয়েছিল — সে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর সম্পর্ক দুই প্রতিবেশি দেশের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সমার্থকও বটে। ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের দাপট বাড়লে, বাংলাদেশে জামায়াতের দাপটও বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশে জামায়াতের দাপট বেড়ে উঠলে, ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা তার সুযোগের নেয়। বাংলাদেশে পালাবদলের পর ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার পরও হিংসা, অরাজকতা চলছে। সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন — তাঁরা আতঙ্কিত। আবার বহু জায়গায় সাধারণ মুসলমানরা সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে, মন্দির রক্ষা করতে পাহারা দিচ্ছেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পন্ন মানুষেরা মৌলবাদী উত্থানকে প্রতিহত করতে লড়াই চালিয়ে যাবেন, এটাই আশার কথা। আক্রান্ত হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থকেরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল জামায়াতে। তারা সেখানে রাজাকার বলে কুখ্যাত। তারা ভারত বিরোধীও বটে। ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থানে শেখ মুজিবর নিহত হওয়ার পর্বে জামায়াতের বোলবোলাও বেড়ে ওঠে। সাম্প্রতিক অতীতে বিএনপি-র সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা চলছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয় তার প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবর রহমান। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর শাসনকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রী সারা বিশ্বে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একদা সোভিয়েতের মিত্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রী আমেরিকা ও পশ্চিমের চক্ষুশুল ছিল।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত আমেরিকার সঙ্গে রণনৈতিক মিত্রতায় আবদ্ধ। তবুও আমেরিকার স্বার্থের বিপরীতে ভারত, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকস গঠন করেছে। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহেন্সবার্গে ব্রিকসের বৈঠকে শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার অতিসক্রিয়তা কার্যত বিরোধীদের উৎসাহ দিচ্ছে।
ভারত ও চীন বাংলাদেশের দুই বৃহৎ প্রতিবেশি। ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুই দেশের সঙ্গেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করেছে। পালাবদলের পর খালেদা জিয়া বলেছেন, ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিলে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের পালাবদল ভারতকে উদ্বেগে রাখবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.