বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

উচ্ছেদ হচ্ছে দরিদ্র-নিম্নবিত্তদের রুজি-রোজগার

উচ্ছেদ হচ্ছে দরিদ্র-নিম্নবিত্তদের রুজি-রোজগার

সম্পাদকীয়, ১৫ জুলাই, ২০২৪

photo

লোকসভা নির্বাচনের পরেপরে উত্তরপ্রদেশের বুলডোজার রাজের এক ঝলক দেখতে পেল পশ্চিমবাংলার মানুষরা। বেআইনি নির্মাণ ও হকার উচ্ছেদ করার জন্য রাস্তায় নামল পুরসভা ও পুলিশ। সম্ভবত কলকাতা সহ পুরসভাগুলিতে রাজ্যের শাসক দলের পিছিয়ে পড়া এর অন্যতম কারণ। শহরের তুলনামূলক সচ্ছল ও শিক্ষিত নাগরিকদের সমর্থন ফিরে পেতে সংকেত দেওয়া, আমরা তোমাদের সমস্যাটা বুঝি। আমরা তোমাদের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করছি। মুখ্যমন্ত্রী একমাস সময় দিয়েছেন বেআইনি নির্মাণ সরিয়ে নেওয়া এবং শহরের ফুটপাতগুলির দুই তৃতীয়াংশ ফাঁকা করে দেওয়ার জন্য। কলকাতায় আপাতত বুলডজার অভিযান স্থগিত থাকলেও জেলার পুরসভাগুলিতে চলছে বুলডজার দিয়ে উচ্ছেদ। বিকল্প ব্যবস্থা না করে হকার উচ্ছেদ দরিদ্র প্রান্তিক মানুষদের জীবিকার উপর আঘাত।

রুজি-রোজগারের অনিশ্চয়তার কারণে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষদের একটা বড় অংশ রাস্তায় হকারি করতে বসেন। এ শুধু পশ্চিমবাংলায় নয় সারা দেশেরই চিত্র। দেশবিভাগ বাংলার মতো রাজ্যে নিয়ে আসে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু স্রোত। এই ছিন্নমূল মানুষদের একটা অংশ রাস্তায় হকারি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। গ্রাম ও কৃষি থেকে উৎখাত হওয়া বহু মানুষ কলকাতা ও অন্য শহরে হকারের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। হকারি করে এইসব মানুষদের সংসার চলে। লকডাউনের সময় আমরা দেখেছি অসংখ্য রুজি-রোজগারহীন মানুষেরা সংসার চালানোর দায়ে রাস্তায় রাস্তায় ফিরি করে বেড়াচ্ছেন। তুলনামূলক নিম্নবিত্ত মানুষেরা হকারদের কাছ থেকে নানা সামগ্রী কিনে থাকেন। দরদামে সুবিধা হয়। বড় দোকান বা বিগবাজার, রিলায়েন্সের মতো কর্পোরেট রিটেল আউটলেটগুলিতে দাম অনেক বেশি। হকাররা সাধারণত যে সমস্ত সামগ্রী বিক্রি করেন সেগুলো তৈরি হয় ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র সংস্থাতে। আমাদের দেশ ও রাজ্যে হকারি একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের ছোট কারখানাগুলির কর্মীদের কর্মসংস্থানও।

২০১৭-১৮ সালে এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ভারতে হকারদের সংখ্যা ১১.৯ মিলিয়ন (১ কোটি ১৯ লক্ষ)। শহরের জনসংখ্যা ১৪ শতাংশ হকারি করে জীবন ধারণ করেন। এখন সংখ্যাটা বাস্তবত অনেক বেশি। নোট বন্দি, জিএসটি আর লকডাউনের ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক লক্ষ ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র কারখানা ও উদ্যোগ। কর্মীরা হয়েছেন বেরোজগার। এদের একটা অংশ নতুন করে রাস্তায় হকারি পেশায় যোগ দিয়েছেন। এই হকারদের একটা বড় অংশই মহিলা।

২০২২ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং টাউন ভেন্ডিং কমিটি শহরের হাতিবাগান, নিউমার্কেট, বহুবাজার, গড়িয়াহাটে হকারদের উপর একটি আংশিক সমীক্ষা করে ৫৯,০০০ হকারদের একটি তালিকা তৈরি করে। কলকাতার হকার ইউনিয়নগুলির দাবি কলকাতায় ফুটপাতে হকারদের সংখ্যা ২.৭ থেকে ৩ লক্ষ। পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করলে জানা যেত কলকাতায় হকার সংখ্যা সম্ভবত অনেক বেশি। রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভায় মোট হকার সংখ্যার কোনও সমীক্ষা পাওয়া যায় না।

ক্রমবর্ধমান হকার সমস্যা সমাধানের জন্য এবং হকার ও শহরবাসী অন্যান্য নাগরিকের পারস্পরিক সুবিধা মাথায় রেখে ২০১৪ সালে দেশের সুপ্রিম কোর্টের সুপারশে সংসদে পাস হয় ‘প্রটেকশন অব লাইভহুড অ্যান্ড রেগুলেশন অব স্ট্রিট ভেন্ডিং আইন’। সেই সময় নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে হকারদের সমীক্ষা করতে হবে। তারপর প্রায় ১০ বছরে পার হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কলকাতা ও সারা রাজ্যের হকারদের নিয়ে কোনও পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষাই হয়নি।

সম্প্রতি আর একটি উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য এবং পরিকল্পনা বাস্তয়ায়নের ২০২২-২৩ সালের রিপোর্টে জানানো হচ্ছে, দেশে দোকান আছে ৬ কোটি ৫০ লক্ষ। তার ১২.৩ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে। ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ৭৩তম রাউন্ডের রিপোর্ট জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে এমন দোকান ছিল ৮৮,৬৮,৪৫৫টি। এখন পশ্চিমবাংলায় দোকানের সংখ্যা ৮০ লক্ষের কিছু কম। ৮ লক্ষ দোকান উধাও হয়ে গেছে।

পাঁচ বছর আগে পশ্চিমবাংলায় ২০১৫-১৬ সালে দোকান কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩৫ লক্ষ প্রায়। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি পাঁচ লক্ষ। তার মানে প্রায় ৩০ লক্ষ দোকান কর্মচারী উবে গেছেন।
এই রাজ্যে সাত বছরে ৮ লক্ষ দোকান উবে গেছে এবং ৩০ লক্ষ দোকান কর্মচারী উধাও হয়ে গেছেন।

এটাই আমাদের রাজ্য ও সারা দেশের সাধারণ চিত্র। বিগবাজার, রিলায়েন্সের মতো কর্পোরেট মল ও রিটেল আউটলেটগুলি জায়গা দখল করে নিচ্ছে ছোট দোকান ও হকারদের রুজি-রোজগার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.