বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— কোন নিকষ অন্ধকারে ডুবেছে পশ্চিম বাংলা? সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই একটার পর একটা ধর্ষণ। তার পরে জ্বালিয়ে দেওয়া।
ধর্ষক বয়স মানে না। সে নাবালিকা হোক, বৃদ্ধা হোন, বা মধ্যবয়সী। রবীন্দ্রনাথ– বিদ্যাসাগরের বাংলায় এখন এটাই সংস্কৃতি। গত দু’ মাসের মধ্যেই আমরা একের পর এক নারী নির্যাতনের নজিরবিহীন ঘটনাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছি। সেই ঘৃণ্য অপরাধকে স্বাভাবিক, ছোট ঘটনা বলে লঘু করার চেষ্টা করা হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক মহল থেকে। তাতে করে বোঝা যাচ্ছে আমরা একটা পচনশীল সমাজে বসবাস করছি। এই বাংলা, এই সমাজ আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। অসহায় নারী, শিশুরা এখানে টার্গেট। বহু ক্ষেত্রেই নারী এবং শিশুদের ওপর আক্রমণকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে শাসক দল।
বিপুল জনসমর্থনে জিতে আসা সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা উচ্চারণ করতে পারবে না। করলেই বিপত্তি। ভয় দেখানো, হুমকি চলতেই থাকবে। নদিয়ার নাবালিকার অধিকার ছিল সুরক্ষা পাওয়ার। পরিবারের অধিকার ছিল কীভাবে তার মৃত্যু হল সেবিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়ার। কিন্তু তা হয়নি। গণধর্ষিতা মৃতা কিশোরীর পরিবার বারবার অভিযোগ জানাতে গেলেও পুলিশ কোনও অভিযোগ নেয়নি। বরং গণধর্ষিতার বাবা তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ের মৃত্যুর আধঘন্টার মধ্যে তাঁর বুকে বন্দুক ধরে হাঁসখালির তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যর ছেলে আর তার দলবল মেয়েটির মৃতদেহ মাদুরে মুড়ে নিয়ে চলে যায়। তারপর কোনওরকম ডেথ সার্টিফিকেট ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই কেরোসিন দিয়ে দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
শাসক ক্রুর হাসি হেসে যেন বলল “নে এবার তদন্ত কর। কীভাবে করবি সব প্রমাণ। এক রাতেই লোপাট।” অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর আগে কোনওরকম চিকিৎসা, অভিযোগ জানানোর জন্য সাহায্যের হাত, সামান্যতম সহানুভূতিও পায়নি নাবালিকা মেয়েটি।
মৃত্যুর পরেও তার নিস্তার নেই। রাজ্যবাসী তথা গোটা দেশের মানুষ অবাক হয়ে শুনলেন, গণধর্ষণে মৃত্যু হওয়া এক নাবালিকা প্রেগনেন্ট ছিল কি না বা মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিনা।
আসলে পুরুষতান্ত্রিক ন্যারেটিভ নিয়ে এসে নাবালিকার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলা একদিকে যেমন জনমানসে মেয়েটি সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরি করার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে পুলিশকেও বার্তা দেওয়া তদন্তের গতিপথ সম্পর্কে। নদিয়ার এসপির মুখেও শোনা গেল মেয়েটির মদ্যপানের কথা।
তবে 'পরিবর্তন' এর জমানার পশ্চিমবঙ্গে এই প্রবণতা নতুন কোনও বিষয় নয়। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের পর প্রশাসনিক প্রধান বলেছিলেন ‘‘সাজানো ঘটনা”। সম্মানীয়া মহিলা সাংসদ বলেছিলেন, “পার্ক স্ট্রিটে আদৌ কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। যা হয়েছে তা হল পেশাদার কাজকর্ম নিয়ে ওই মহিলা এবং তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল।’
২০১৩ সালের ৭ জুন বারাসাতের কামদুনিতে ২১ বছরের এক কলেজ ছাত্রীকে প্রথমে গণধর্ষণ ও পরে নৃশংস ভাবে খুন করার পর প্রতিবাদে গ্রামবাসীরা মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তাঁদের ‘মাওবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল।
ধর্ষিতা নারীর 'দাম' টাকার অঙ্ক দিয়ে বেঁধে দেওয়া, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই কোনও তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ঘৃণ্য অপরাধকে আড়াল ও লঘু করতে উদ্ভট পুরুষতান্ত্রিক তত্ত্ব হাজির করা, এই বাংলায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধুমাত্র শেষ দু’ মাসের মধ্যে রাজ্যজুড়ে যে ধর্ষণের খবরগুলো প্রকাশ্যে এসেছে তার মধ্যে বেশিরভাগ ঘটনায় রাজ্যের শাসক দলের কর্মী সমর্থকরা জড়িত। ৩ মার্চ সাগরদ্বীপে চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ, ২২ মার্চ বসিরহাটে এক আদিবাসী মহিলাকে ধর্ষণ, ২৪ মার্চ বসিরহাটের ১১ বছরের কিশোরীকে বারংবার ধর্ষণ অথবা ১ এপ্রিল হরিশ্চন্দ্রপুরে ১৪ বছরের মাদ্রাসা ছাত্রীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণে ধৃতরা সবাই রাজ্যের শাসক দলের কর্মী।
সুদের টাকা দিতে না পারায় আদিবাসী বাবার মেয়েকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে বোলপুরের সিয়ান মুলুক পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য। এই খবর কাউকে জানালে পুরো পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে ধর্ষক ও তার সঙ্গীরা।
জ্বালিয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে দেওয়া আমাদের বাংলার এখন নতুন ট্রেন্ড। ধর্ষকাম সমাজের পৈশাচিক উল্লাস।
আনিস খান হত্যা, বগটুই এর নারকীয় গণহত্যা, তুহিনা খাতুনদের আত্মহত্যায় প্ররোচনা, নাবালিকা ধর্ষণ ও খুন, রামনবমীর নির্লজ্জ ভয়ংকর উচ্ছ্বাস— প্রতিটি ঘটনার পেছনেই একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। ভয়ের রাজনীতি। মানুষকে ভয় পাইয়ে রাখতে হবে। আর কখনো দুর্নীতির উচ্ছিষ্ট গিলিয়ে, কখনো বা অনুদানের সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে হবে। যাতে তারা প্রশ্ন করতে না পারে। সুবিচার পাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ করে রাখা হবে। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট, পুলিশ স্টেশন, হাসপাতাল, শ্মশান কার্যত সব জায়গায় বিধিভঙ্গের খেলা চলছে।
নারীর নিরাপত্তার অধিকার নেই। আহতের চিকিৎসার অধিকার নেই, রাজনীতির সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের সম্পর্ক নেই। আছে শুধু সর্বগ্রাসী ভয়।
এই ভয়কে জয় করতে পারাই হোক বাংলা নববর্ষের শপথ।