বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়, ১৬ মে ২০২২

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ মে, ২০২২— আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষ, বিশেষত শ্রমজীবী, দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। গম, আটা, ভোজ্য তেল, দুধ, নুন, আলু, সব্জি সহ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রের হিসেবে গম, আটা, ভোজ্য তেল, দুধ, নুন সহ ২২টি খাদ্যপণ্যের দাম এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পেট্রল-ডিজেল এবং রান্নার গ্যাস ও কেরোসিনের দাম রকেট গতিতে বেড়েই চলেছে।
লাগামছাড়া এই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি। জ্বালানির দামের বৃদ্ধির জন্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সমস্ত পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় শাসক দলের কার্যকর্তারা যতই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন না কেন— সাধারণ মানুষ পেট্রল-ডিজেল ব্যবহার করেন না।
পেট্রল সারা দেশেই বহু দিন আগেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বেড়ে চলেছে। ডিজেলের দাম এই রাজ্যে ৯৯.৮৩ টাকা—অনেক রাজ্যে সেঞ্চুরি পার করেছে। রান্নার গ্যাসের দাম দাঁড়িয়েছে ১০২৬ টাকা।
২০১৪ সালের প্রথম দিকে গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ছিল ৪১০ টাকা। সেই সময় ইউপিএ-২ সরকার ভরতুকি দিতো সিলিন্ডার প্রতি ৮২৭ টাকা। এখন গ্যাসের সিলিন্ডারের জন্য গুণতে হচ্ছে ১০২৬ টাকা। আট বছরের মোদি শাসনে রান্নার গ্যাসে ভরতুকি দাঁড়িয়েছে শূণ্য।
মোদি সরকার উজ্জ্বলা প্রকল্পে প্রায় ৯ কোটি গরিব পরিবারকে নিখরচায় রান্নার গ্যাসের সংযোগ দিয়ে ঢাক পিটিয়েছিল। কিন্তু তারপরে ভর্তুকি তুলে দিয়ে গ্যাসের দাম এতই বাড়িয়েছে যে ৯০ লক্ষ পরিবার আর কখনও গ্যাসের সিলিন্ডার কেনেনি। আর ১.০৮ কোটি পরিবার বছরে একটি মাত্র সিলিন্ডার নিয়েছেন।
কেরোসিনের দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ টাকা যা ব্যবহার করেন প্রধানত দরিদ্র, প্রান্তিক পরিবারগুলি। ২০১৪ সালে কেরোসিনের দাম ছিল লিটার প্রতি ১৬ টাকা।
পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরোপিত কর। মোদি সরকার গত তিনটি অর্থ বর্ষে পেট্রোল-ডিজেলের কর বাবদ প্রায় ৮.০২ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেছে। যার মধ্যে ২০২১ অর্থ বর্ষে ৩.৭১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি।
কেন্দ্রীয় সরকার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার জন্য পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন। বাস্তবে যুদ্ধের বহু আগে থেকেই পেট্রোল-ডিজেলে দাম রকেট গতিতে বেড়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কোষাগার ঘাটতি পূর্ণ করার অন্যতম উপায় হিসেবে পেট্রোল-ডিজেলের উপর চড়া হারে কর আদায়ের রাস্তা নিয়েছে।
পেট্রোলের উপর কেন্দ্রীয় কর যথাক্রমে ৩২.৯৮ শতাংশ এবং ডিজেলে ৩১.৮৩ শতাংশ। পেট্রোপণ্য জিএসটি-র আওতার বাইরে রয়েছে। রাজ্য সরকারগুলিও তার সুযোগ নিয়ে পেট্রোপণ্যের ভ্যাট বাবদ বড় পরিমাণ রাজস্ব আদায় করছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে রাজ্যগুলি পেট্রোপণ্যের ভ্যাট বাবদ আদায় করেছে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা। পশ্চিমবাংলায় পেট্রোলে ও ডিজেলের ওপর ভ্যাট যথাক্রমে ২৫.২৫% এবং ১৭.৫৪%। কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারগুলি মরার উপর খাঁড়ার ঘা মেরে চলেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য পরস্পরকে দোষারোপ করছে আর সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠছে।
আলু, সব্জির মতো খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অবাক করা বিষয়। এর অন্যতম কারণ ফড়ে, মজুতদার, হিমঘরের মালিকদের দৌরাত্ম্য রোধ করতে না পারায় রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা। তার উপরে গত এক দশকে ফড়ে, মজুতদার, হিমঘরের মালিকদের সঙ্গে শাসক দলের মাতব্বরদের আঁতাত গোদের উপর বিষফোঁড়া। যদিও চাষিরা সেই আঁধারেই পড়ে আছে। তারা ফসলের লাভজনক দাম পান না। তাদের বড় অংশ চাষের খরচই তুলতে পারেন না। আম্বানি-আদানি-বিগবাস্কেট-আমাজনের মতো দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলিও খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় অনুপ্রবেশ করেছে। তারা ক্রেতাদের পকেট কাটার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছে।
জ্বালানি, ভোজ্য তেল, সব্জি সহ খাদ্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সমস্ত অনুমান ছাপিয়ে এপ্রিল, ২০২২-এ মুদ্রাস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭.৭৯ শতাংশ। তার উপরে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের রেকর্ড পতন হয়েছে। ১ ডলারের দাম এখন ৭৭.৫ টাকা। এর পরিণতিতে জ্বালানি সহ অন্য পণ্য বিদেশ আমদানি করতে বেশি টাকা গুণতে হবে।
এমতাবস্থায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে আশু ও দীর্ঘমেয়াদী সরকারি পদক্ষেপ জরুরি। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে রাজস্ব নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। পেট্রোপণ্য সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর কেন্দ্র ও রাজ্যের পরোক্ষ করের বোঝা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে হবে। আশু হিসেবে, পেট্রোপণ্যকে জিএসটির অন্তর্ভুক্ত করা। কর্পোরেটদের লক্ষ কোটি টাকার ট্যাক্স ছাড় ও বেলআউটের নীতি বাতিল করা। কর্পোরেট ট্যাক্স আদায়ে বিশেষ জোর দেওয়া। ফড়ে, মজুতদার, হিমঘরের মালিকদের দৌরাত্ম্য কঠোর হাতে দমন করা। আলুর ও অন্যান্য সব্জির বাজারজাত করার জন্য রাজ্যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.