বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

উপনির্বাচনের ফল ও সামনে লড়াই

উপনির্বাচনের ফল ও সামনে লড়াই

সম্পাদকীয়, ১৬ নভেম্বর, ২০২১

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ নভেম্বর, ২০২১— লোকসভা ও বিধানসভা উপনির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে। নির্বাচকদের তরফে এ এক চেতাবনি।
উপনির্বাচনে তিনটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে দুটিতে জয়ী হয়েছে বিরোধীরা। হিমাচলপ্রদেশের মাণ্ডি লোকসভা কেন্দ্র বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দাদরা ও নগর হাভেলি আসনে বিজেপি পরাজিত হয়েছে শিবসেনার কাছে। মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়া লোকসভা কেন্দ্রটি বিজেপি দখল রাখতে পারলেও তিনটি লোকসভা আসনেই ২০১৯এর সাধারণ নির্বাচনের তুলনায় বিজেপির ভোট কমেছে ব্যাপক হারে।
বিধানসভা উপনির্বাচনেও বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থান, কর্ণাটক, হরিয়ানায়। হিমাচলপ্রদেশের মাণ্ডি লোকসভার ৩টি বিধানসভার তিনটিতেই কংগ্রেসের কাছে পরাজিত হয়েছে বিজেপি প্রার্থী। এর মধ্যে একটি আসন বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস।
রাজস্থানে দুটি কেন্দ্রেই বিজেপি পরাজিত হয়েছে। কংগ্রেস গত নির্বাচনে জেতা আসনটি দখলে রাখার পাশাপাশি বিজেপির কাছ থেকে একটি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে।
মোদি সরকারে কৃষি আইনের প্রতিবাদে আইএনএলডি-র অজয় সিং চৌতলা বিধায়কপদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। হরিয়ানায় এলানাবাদে তিনি ফের বিজেপিকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন।
পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা উপনির্বাচনে চারটি কেন্দ্রেই তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। বিজেপি চারটি আসনেই পর্যুদস্ত হয়েছে। তবে দিনহাটায় এবং গোসাবায় তৃণমূল প্রার্থীরা যথাক্রমে ৮৪ শতাংশ এবং ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। যা বিগত সময়ে অনিল বসুর ৫৯ শতাংশ বা নন্দরাণী ডলের ৬১ শতাংশ ভোট পাওয়াকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে উপনির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দলের প্রতি নির্বাচকদের প্রত্যাখ্যানের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, মোদি সরকারের কৃষক বিরোধী তিনটি কৃষি আইন এবং পেট্রল-ডিজেলে বিপুল হারে কর বৃদ্ধির সৌজন্যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়গুলি।
কৃষি আইনের দৌলতে দিকে দিকে এই বার্তা রটে গেছে, মোদি সরকার কৃষক বিরোধী— কর্পোরেট স্বার্থবাহী। চলমান কৃষক আন্দোলন কৃষক সমাজ তথা দেশবাসীর কাছে জোরালো ভাবে এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে এবং বিজেপির সমর্থনভূমি ক্রমশ আলগা করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির কাছে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ— কৃষি আইন নিয়ে পিছু হটার কোনও লক্ষণ তারা এখনও পর্যন্ত দেখায়নি। যদিও দীর্ঘ এক বছর সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও কৃষক আন্দোলন ম্রিয়মান হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। রাজ্য ভিত্তিতে তারতম্য থাকলেও ক্রমেই তা প্রসারিত হয়ে চলেছে এবং জাতীয় এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।
আগামী বছরের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ভোট বড় বালাই। সুতরাং উপনির্বাচনে হোঁচট খেয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার নির্বাচকদের মন ফিরে পেতে পেট্রল ও ডিজেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে আত্মরক্ষার আয়োজন করেছে। ফল বেরোতেই সরকার তড়িঘড়ি পেট্রলে লিটার প্রতি ৫ টাকা ও ডিজেলে টাকা ১০ টাকা উৎপাদন শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। পেট্রল ও ডিজেল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার যে বিপুল হারে কর আদায় করে, এই হ্রাস তার এক নগণ্য অংশ। এই প্রসাধনিক হ্রাসটি কেন্দ্রের শাসক দলের অপরাজেয় অস্মিতায় ধাক্কা লাগারই ইঙ্গিত।
এইভাবে প্রসাধনিক কর কমিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলি উপর পাল্টা চাপ তৈরির কৌশল নিল। এত দিন বিরোধী দলগুলি পেট্রোল-ডিজেলের উপর কেন্দ্রের কর কমানোর দাবি করছিল।
কেন্দ্র দাম কমানোর পরেই বিজেপি শাসিত অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর, কর্ণাটক, গোয়া, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, হিমাচলপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যগুলিও পেট্রোল এবং ডিজেলের উপর ভ্যাট কমিয়ে জ্বালানির দাম কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
পাঞ্জাবের চরণজিৎ সিংহ চন্নীর কংগ্রেস সরকার বিজেপির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে— রাজ্যে পেট্রল-ডিজেলের উপর থেকে মূল্যযুক্ত কর বা ভ্যাট কমিয়েছে পেট্রলে লিটার প্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেলে ৫ টাকা হারে। আগামী বছর নির্বাচনকে সামনে রেখে এই টক্কর।
তবে দেশের শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষের বেশি বেশি অংশ ক্রমেই কর্পোরেট স্বার্থ ও সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের রাস্তাকে বেছে নিচ্ছেন।
২৭ সেপ্টেম্বরের বনধের সাফল্য মোদি সরকারের বিভাজনের নীতি এবং কর্পোরেটের স্বার্থবাহী আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী জনগণের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছে। কৃষক সংগঠনগুলি ২৬ নভেম্বর রাজধানী দিল্লি সহ সারা দেশে কৃষক আন্দোলনের এক বছর পূর্তি মহাসমারোহে উদযাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কৃষকদের সেই কর্মসূচিতে সামিল হবেন শ্রমিক-কর্মচারী, ছাত্র-যুব-মহিলা ও প্রতিবাদী মানুষের বড় অংশ।
শ্রমিক সংগঠনগুলির জাতীয় কনভেনশন আগামী বছর সংসদের বাজেট অধিবেশনের সময় দু’দিন ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। এই কনভেনশনে যোগ দিয়েছেন কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরাও।
সরকারের কাছে শ্রমিক-কৃষক সংগঠনগুলির দাবি: শ্রম কোড বাতিল করতে হবে। বাতিল করতে হবে তিন কৃষি আইন। বন্ধ করতে হবে বেসরকারিকরণ। বাতিল করতে হবে ন্যাশনাল অ্যাসেট মানিটাইজেশন পাইপলাইন। খাদ্য এবং আয়ের জন্য আয়কর সীমার বাইরে থাকা সব পরিবারে মাসে ৭৫০০ টাকা করে দিতে হবে। রেগা প্রকল্পের আওতা বাড়িয়ে শহরাঞ্চলকে যুক্ত করতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা চালু করতে হবে। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড ডে মিল এবং অন্য প্রকল্প কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তার জন্য ধনী ও অতিধনিদের উপর প্রত্যক্ষ কর আদায়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.