বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

স্বাধীনতা তুমি কার?

স্বাধীনতা তুমি কার?

সম্পাদকীয়, ১৬ অগাস্ট, ২০২১

photo

অতিমারি ও লকডাউন দেশের চলমান অসাম্যকে তীব্র করেছে। সরকারি নীতির সৌজন্যে অতিমারির পরিস্থিতিতে অতিধনী ও ধনীরা কেবল সংকট মোকাবেলা করতেই সক্ষম হয়নি বরং তাদের সম্পদ ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই সময়ে দেশের ধনকুবেরদের সম্পদ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। নতুন করে ৪০ জন ভারতীয় ধনকুবের বিলিয়নিয়ার ক্লাবে প্রবেশ করেছে। এদেশে ধনকুবেরদের সংখ্যা এখন ১৭৭। বিপরীতে, দেশের ব্যাপকতর দরিদ্র প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের আয়, সঞ্চয়, চাকরি, রোজগার এবং ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।

অতিমারির কারণে অসাম্য বৃদ্ধি এক বিশ্বজনীন সমস্যা, তবুও আমাদের মতো দরিদ্র দেশে এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। লকডাউনে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি সবচেয়ে বড় সংকোচনের মধ্য পড়ে। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী বেকারত্বের হার ২৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে যান, যা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বৃদ্ধির ৬০ শতাংশ। ২৩ কোটি মানুষের দৈনিক উপার্জন ৩২০ টাকার জাতীয় ন্যূনতম মজুরির সীমার নিচে নেমে যায়। কিন্তু শেয়ার বাজারের সূচক রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে।

লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিক সহ গোটা দেশের অসংগঠিত ও ইনফর্মাল ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরা ব্যাপক হারে কাজ হারিয়েছেন। কাজ ফিরে পাওয়ার পরে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই শ্রমজীবীরা প্রধানত নির্মাণ শিল্প, পরিবহন, রেস্তোরাঁ, সেবা, গৃহকর্ম, ভ্রমণ, পর্যটন বা হকারির মতো কাজে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু যারা সরকারি-বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রের হোয়াইট কলার চাকরি করেন তাদের আয় সুরক্ষিত এবং তাদের অনেকেই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করার বিলাসিতা উপভোগ করতে পেরেছেন।

অসাম্যের তীব্রতা নানা উৎস এবং নানা দিক থেকে এসেছে। শহরের বস্তি এবং অন্যান্য জনাকীর্ণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা স্পষ্টতই কোভিড সংক্রমণের ক্ষেত্রে সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে ছিলেন। চিকিৎসা ও জীবিকার জন্য তারা তাদের ন্যূনতম সঞ্চয় খরচ করে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।

স্বচ্ছল-ধনীরা কোভিড সংক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছেন, সংক্রমিত হলে চিকিৎসা, বিচ্ছিন্নতা, বিশ্রাম এবং সুস্থতা অর্জনের আর্থিক সক্ষমতা তাদের ছিল ও আছে। বিপরীতে, দরিদ্রতর শ্রমজীবী মানুষ কোভিড সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার অনেক পরেও উপার্জন করার শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন না।

সরকারের কর্পোরেট বান্ধব নীতির সৌজন্যে ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যবস্থাপনায় সুদের হার কমানো ও ঢালাও ঋণদানের ফলে অর্থনীতিতে নগদ টাকার যোগান বেড়েছ বিপুল পরিমাণে। কিন্তু ঋণের বড় অংশ উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে প্রবাহিত হওয়ার পরিবর্তে, শেয়ার বাজারে চলে গেছে এবং সম্পদের মূল্যবৃদ্ধিতে ইন্ধন যুগিয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে ধনীদের সম্পদ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে— তাদের জীবনধারণে বড় রকমের আঘাত নেমে এসেছে।

বড় বড় সংস্থাগুলি কম সুদের হার এবং কাঁচামালের কম দামের সুবিধা নিতে সক্ষম হয়েছে। তারা নির্মমভাবে ছাঁটাইও করেছে। ইনফর্মাল ক্ষেত্র এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলি কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এদের বড় অংশই হয়ত চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা ছোট থেকে বড় সংস্থাগুলিতে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এটি অপরিবর্তনীয় হতে পারে।

অনলাইন শিক্ষা শিক্ষাক্ষেত্রে অসাম্যকে আরো তীব্র করেছে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের এক ক্ষুদ্র অংশই অনলাইনে ক্লাসের সুযোগ নিতে পেরেছে। বঞ্চিত হয়েছে সংখাগরিষ্ঠ দরিদ্রতর পরিবারগুলির শিশুরা। স্কুল শিক্ষা অর্জনের মাত্রা এদেশে এমনিতেই হতাশজনকভাবে কম, প্রায় টানা দেড় বছর স্কুল বন্ধের ফলে প্রায় সমগ্র নবীনতর প্রজন্মের ভবিষ্যৎ গভীর প্রশ্নের মধ্যে পড়ে গেল। শিক্ষাক্ষেত্রে লকডাউনে স্কুলছুটের হার তীব্রভাবে বাড়বে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পড়ুয়ারা সকলেই উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী ধাপে তাদের কত অংশ পড়া চালিয়ে যেতে পারবে। তাদের কর্মজীবনের ভবিষ্যৎ বা কি হবে। দরিদ্রতর সমাজে শিক্ষা প্রজন্ম ধরে ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার পথ তৈরি করে। শিশুদের এক বৃহত্তর অংশের আয়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সম্ভাবনা কার্যত বন্ধ হয়ে গেল।

সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হল, এই তীক্ষ্ণ অসাম্যের দাগ কোভিড ছেড়ে যাওয়ার পরেও বহাল থাকবে। অসাম্য নৈতিকভাবে ধ্বংসাত্মক। অর্থনৈতিকভাবে ভারসাম্যহীনতা বাড়িয়ে চলে। রাজনৈতিকভাবে ক্ষয়কারী। অসাম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এক রণনৈতিক কর্তব্য। স্বাধীনতার ৭৫-এ সেই সংগ্রামের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.