বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২২— স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মোদি সরকার যখন মহা সমারোহে “অমৃত মহোৎসব” পালনের ডাক দিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি দেশ ও কোটি কোটি জনতা।
দেশের অর্থনীতি গভীর সংকোচনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, রান্নার গ্যাসের দাম দফায় দফায় বেড়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে খাদ্য সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম। টাকার দাম তলানিতে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার ৭৫-এ ডলারের দাম ৮০ টাকা। ১৯৪৯ সালে ১ ডলারের দাম ছিল ৪.৭৬ টাকা।
সরকারি নীতির সৌজন্যে অতিমারির দু’ বছরে অতিধনী ও ধনীদের সম্পদ আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে। দেশের ধনকুবেরদের সম্পদ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। দেশের ব্যাপকতর দরিদ্র প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের আয়, সঞ্চয়, চাকরি, রোজগার এবং ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে চলেছেন। অসাম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে। দেশের ৭o শতাংশের বেশি মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য কেনার ক্ষমতা নেই। দেশে এখন বেকারির হার ৭.৭%, শহরাঞ্চলে ৯.১% এবং গ্রামাঞ্চলে ৭.০%। যুব বেকারির হার বিপজ্জনকভাবে ১৪.৯%। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত অগ্নিবীর প্রকল্পে চার বছরের জন্য ঠিকা সেনা নিয়োগ যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। প্রায় দীর্ঘ দু’ বছর স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে ওঠার গতি ভীষণভাবে মার খেয়েছে। স্কুলছুটের হার তীব্রভাবে বেড়েছে। গড়ে ৯২% শিশু ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক দক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে। দারিদ্রের কারণে দেশজুড়ে নাবালিকা বিয়ে বেড়েছে— বেড়েছে মেয়ে পাচার। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারত এখন ১০১তম স্থানে। যদিও সরকার এই হিসেব প্রত্যাখ্যান করেছে।
এ হেন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনে যাদের অবদান খুঁজতে গেলে দূরবিন লাগে তারাই আজ মহা সমারোহে স্বাধীনতার উৎসব পালন করছে শুধু নয়, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পুনর্লিখনের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্রিটিশ শাসকদের মতোই তাদের হাতিয়ার “ভাগ করো এবং শাসন করো” নীতি।
মাত্র আট বছরের শাসনে মোদি সরকার নয়া উদারবাদী সংস্কারের পথ মসৃণ করতে জনগণের ঐক্যকে ভাঙতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি ব্যবহার করছে। তাদের ধ্বংসাত্মক নীতি দেশের আবহমান কালের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে উদ্যত। এই সরকারের হাতে দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সহ সংবিধানের মৌল নীতিসমূহ বিপজ্জনকভাবে আক্রান্ত। মানবাধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার ভীষণভাবে লঙ্ঘিত। প্রতিবাদীদের শায়েস্তা করতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন ও ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন মুসলমান, খ্রিশ্চান, দলিতরা। তাদের পোষাক, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মাচারণের উপর নামিয়ে আনা হয়েছে আক্রমণ। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ধর্মের ভিত্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেনাগরিক করার আয়োজন চলছে। দেশ জুড়ে কায়েম করা হয়েছে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ।
এই সরকার রেল, বিমানবন্দর, ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে প্রতিরক্ষা, কয়লা, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, ব্যাঙ্ক-বীমা, জল-জমি-জঙ্গল সহ দেশের প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে একের পর এক দেশদ্রোহী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে। এ হল স্বনির্ভর অর্থনীতির অভিমুখকে জলাঞ্জলি দিয়ে কর্পোরেট অধীনতার দিকে এক বিরাট বিপরীত যাত্রা। এই শক্তি শ্রমজীবী মানুষের ন্যূনতম অর্জিত অধিকার কেড়ে নিতে শ্রম আইন সংস্কার করে লেবার কোড চালু করেছে। আগে কোনও সরকার এমন বেপরোয়া ও নির্লজ্জভাবে কর্পোরেট শক্তির সেবা করেনি।
কংগ্রেস পরিচালিত বিগত ইউপিএ সরকারগুলি সংস্কারের বকেয়া কাজ করতে দ্বিধা করেছে শুধু নয়, বামপন্থী ও সমাজবাদীদের চাপে ১০০ দিনের কাজ, খাদ্য নিরাপত্তা আইন, বনাধিকার আইন, সংশোধিত জমি অধিগ্রহণ আইনের মতো আইনগুলি চালু করে। যা ছিল কর্পোরেট-বহুজাতিক স্বার্থের সরাসরি বিরুদ্ধে। সেকারণে কর্পোরেট শক্তি বেআব্রুভাবে কংগ্রেস সরকারের অপসারণ চেয়েছিল এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে শাসন ক্ষমতায় বসানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কর্পোরেট পরিচালিত মিডিয়ার সিংহভাগ সেকাজে সঙ্গত করেছিল।
“সব কা সাথ, সব কা বিকাশ” শ্লোগান দিয়ে দেশের শাসন ক্ষমতায় বসেছিল মোদি সরকার। এই আট বছরে “সব কা বিকাশ” কেমন হয়েছে, দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। বিদেশি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা উদ্ধার হয়নি। বছরে দু’ কোটি বেকারের চাকরি বদলে নোটবন্দি, জিএসটি এবং অতিমারিতে কোটি কোটি শ্রমজীবী কর্মহীন হয়েছে, অসংখ্য ছোট-মাঝারি-ইনফর্মাল ইউনিট চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে হয়েছে।
কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার শ্লোগান দিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় বসেছিল। কংগ্রসকে নির্মূল করা তাদের রাজনৈতিক-রণনৈতিক লক্ষ্য। ঘোড়া কেনা-বেচা করে তারা কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস পরিচালিত সরকার ভেঙেছে, মহারাষ্ট্রে বিরোধী জোট সরকার ভেঙেছে। যদিও বিহারে তাদের মুখ পুড়েছে। নীতিশ কুমার ও তার দল জেডিইউ আপাতত বিজেপি সঙ্গ ছেড়ে তেজস্বী যাদবের আরজেডি, কংগ্রেস ও বামেদের হাত ধরেছে। বিরোধীদের কাবু করতে কেন্দ্রের শাসক দল সিবিআই, ইডির মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করছে। কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলির অনৈক্যকে কাজে লাগিয়ে তারা শাসন ক্ষমতায় বসেছিল— শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকতে এবং রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা বিস্তার করতে তারা বিরোধীদের অনৈক্য ও দুর্নীতিকে হাতিয়ার করছে। দুর্নীতিগ্রস্থ বিরোধী দলগুলি ও রাজনীতিকদের মধ্যে বিজেপি ‘সফট টার্গেট’ খুঁজে বেড়াচ্ছে যাদেরকে ব্যবহার করে বিরোধী ঐক্যের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করা যায়।
এই রাজ্যের শাসক তৃণমূল দলের দাবি, কংগ্রেস দৃঢ়তার সঙ্গে মোদি বিরোধী লড়াই করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সুতরাং বিরোধী জোটের নেতৃত্বে কংগ্রেস থাকতে পারে না। তারাই সারা দেশে কংগ্রেসের বিকল্প। মজার বিষয় হল, এরাজ্যের কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার সিংহভাগও সেকথা প্রচার করে চলেছে। তৃণমূল দল গত এক দশকে পশ্চিমবাংলায় বাম দলগুলি ও কংগ্রেসকে নির্মূল করার কাজ চালিয়েছে। সন্ত্রাস ও ঘোড়া কেনাবেচা একাজে তাদের হাতিয়ার। কংগ্রসকে নির্মূল করার বিজেপির রাজনৈতিক-রণনৈতিক লক্ষ্যের সঙ্গে তৃণমূলের ভূমিকার কোথায় যেন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আরএসএস-এর দুর্গা ক্রমশ এরাজ্যে আম্বানি-আদানি কর্পোরেটদের নয়নের মণি হয়ে উঠছে।
আদালতের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর কে বাগ কমিটি, সিবিআই, ইডি-র তদন্তে এরাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির উলঙ্গ ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে আন্দোলনরত এসএসসি ও টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কর্মপ্রার্থীদের অভিযোগ জনতার দরবারে মান্যতা পেয়েছে। সিবিআই, ইডি-র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে রাজ্যের শাসক দল ও সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী এবং এসএসসি-র একাধিক উচ্চ আধিকারিক। কোটি কোটি টাকা, সোনা, সম্পত্তি উদ্ধার করেছে ইডি। গরু পাচার কাণ্ডে সিবিআই-এর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে শাসক দলের বীরভূম জেলার দোর্দণ্ডপ্রতাপ সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। যিনি দলীয় প্রশ্রয়ে বছরের পর বছর বীরভূম জেলা জুড়ে ভয়-সন্ত্রাস ও লুঠের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। হদিস পাওয়া যাচ্ছে তার কোটি কোটি টাকার পরিমাণ বিপুল সম্পত্তির। রাজ্য জুড়ে তৃণমূল যে ভয়-সন্ত্রাস ও লুঠের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে তা ক্রমশ জনসমক্ষে আসছে।
এই অবস্থায় কোনও কোনও কলমচী ও কর্পোরেট মিডিয়ার একাংশ পরামর্শ দিচ্ছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নিতে হবে কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার করা চলবে না। এই কথা বলে তারা রাজ্যের শাসক দলের ভয়-সন্ত্রাস ও লুঠের রাজত্বকে কার্যত আড়াল করছেন এবং কার্যত এরাজ্যে বিজেপির উত্থানের সুযোগ করে দিচ্ছেন— যেভাবে তারা বিগত বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের দ্বি-মেরু তত্ত্ব তুলে ধরে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে লড়াইকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, রাজ্যের শাসক দলের দুর্নীতিগ্রস্থ নেতারা দলে দলে বিজেপিতে গেছিলেন এবং পরে আবার তৃণমূলে ফিরে গেছেন। প্রয়োজন বুঝলে এই দুর্নীতিগ্রস্থ নেতারা আবার বিজেপিতে ভীড় জমাতে পারেন।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির অবসরে দেশবাসীর কর্তব্য, দেশদ্রোহী-সাম্প্রদায়িক-বিভাজনের শক্তি বিজেপিকে প্রতিহত ও পরাস্ত করা। তৃণমূলের ভয়-সন্ত্রাস ও লুঠের রাজত্বকে হাতিয়ার করে বিজেপি যেন রাজ্যের শাসন ক্ষমতা দখল করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক প্রহরা রাখা। এই রাজ্যের গণতন্ত্র ও বামপন্থার সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তৃণমূলের ভয়-সন্ত্রাস ও লুঠের রাজত্বকে প্রতিরোধ করে স্বাধীন শক্তি হিসেবে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে।