বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— কোভিড অতিমারি এবং লকডাউনে গত দু’ বছর ধরে জনজীবনের নাভিশ্বাস উঠেছে। ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৪ কোটি ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ কোভিডে আক্রান্ত। এই সময়পর্বে গোটা ব্যবস্থাটাই যেন ধ্বসে পড়েছে। স্বাস্থ্যের ব্যবস্থার বেহাল দশা বেআব্রুভাবে সামনে এসেছে। সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকায় টিকা উৎপাদক কোম্পানির মুনাফার পাহাড় জমেছে। অথচ মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সামান্য চিকিৎসা পরিসেবা পাওয়ার জন্য— কত যে পরিবার চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তার হিসেব নেই। লক্ষ কোটি টাকার ঋণের পসরা সাজিয়ে আর রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদ বেচে দিয়ে অর্থনীতিকে সচল করা যায়নি। লক্ষ কোটি মানুষ কাছ হারিয়েছে। অগণিত ছোট ও ইনফর্মাল ক্ষেত্রের উদ্যোগ বদ্ধ হয়ে গেছে। স্বউদ্যোগীরা প্রায় কর্মহীন। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের শূণ্য পদে কার্যত সমস্ত নিয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক ঠিকা কর্মী দিয়ে সরকারি কাজ চলছে। তাও ঠিকা কর্মীদের একটা অংশ নিয়মিত মজুরি পাচ্ছেন না। মজুরি বকেয়া থাকছে। ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজের বাজারে চলছে হাহাকার। নগণ্য মজুরির বিনিময়ে অসংগঠিত শ্রমজীবীরা উদয়-অস্ত কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায় দু’ বছর দেশের ৯০ শতাংশ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনলাইন শিক্ষার সুযোগ নেওয়া তাদের হাতের বাইরে। কারখানা, স্কুল প্রায় বন্ধ— কিন্তু পানশালা খোলা।
অতিমারি পর্বে মোদি সরকারের আগ্রাসী উদারনীতির কারণে অসাম্য আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙেছে। দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। অথচ গৌতম আদানি, মুকেশ আম্বানিদের মতো বিলিয়নিয়রদের সম্পদের পরিমাণ সমস্ত রেকর্ড ভেঙে উপছে পড়ছে। মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ব্যাঙ্ক-বীমা, রেল, প্রতিরক্ষা, খনি বেসরকারিকরণ করে, কৃষি ও শ্রম সংস্কার করে কর্পোরেটদের জন্য অবাধ লুঠের ব্যবস্থা করেছে সরকার।
অতিমারিতে জনজীবনে প্রায় স্তব্ধ। তার মধ্যেই রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সংখ্যালঘু মুসলিম, খ্রিস্টান ও দলিতদের উপর হিংস্র আক্রমণের বিরাম নেই। কে কী খাদ্যগ্রহণ করবে, পোষাক পরিধান করবে, কে কার সঙ্গে প্রেম-বিবাহ করবে— সমস্ত ব্যক্তিগত পরিসরে শাসক দল অনধিকার হস্তক্ষেপ ও বর্বর আক্রমণ চালিয়ে যাছে। জনকল্যাণমূলক কাজ নয়, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং বিভাজনের রাজনীতির ভিত্তিতে কেন্দ্রের শাসক দল ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।
কিন্তু লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে কর্পোরেট স্বার্থবাহী বলদর্পী সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছে ঐক্যবদ্ধ কৃষকেরা। সরকার কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারতে শাসক দলের ভিত্তিভূমি অনেকটাই টলে গেছে। যে মজফফরনগর দাঙ্গা উত্তরপ্রদেশ ও সারা দেশে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিয়েছিল, সেখানকার জাঠ-মুসলিমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষক আন্দোলন লড়েছে— জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে পূর্ব উত্তরপ্রদেশে। পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কৃষকদের চ্যালেঞ্জের মুখে বিজেপি। পাঞ্জাবে এনডিএ শরিক আকালি দল বিজেপি সঙ্গ ত্যাগ করেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সঙ্গে বিরোধী দলগুলির মধ্যে বিভাজন ও অনুচর খোঁজার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। ইডি, সিবিআই, ইনকাম-ট্যাক্স দপ্তর একাজে তাদের হাতিয়ার।
পশ্চিমবাংলাতেও অতিমারির বিধিনিষেধের জন্য প্রায় দু’ বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ। লোকাল ট্রেন ও বাস ছিল অনিয়মিত। মানুষ কাজে বেরোতে পারছিলেন না কাজের অভাবে এবং প্রয়োজনীয় পরিবহনের অভাবে। কলকাতার ময়দানে ঈদের নামাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলায় লক্ষ মানুষের সমাগম হতে দেওয়া হয়েছে।
অতিমারির বিধিনিষেধের মধ্যেই হয়েছে একের পর এক নির্বাচন। তাতে লোকসমাগমে আপত্তি ওঠেনি বিশেষ। রাজ্যে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন হয়ে গেছে। চারটি কেন্দ্রেই জয়ী হয়েছে শাসক তৃণমূল দল। এর মধ্যে দিনহাটা ও গোসাবায় তৃণমূল প্রার্থী অবিশ্বাস্য ভোট পেয়েছেন— যথাক্রমে ৮৪.১৫ এবং ৮৭.১৯ শতাংশ। কলকাতা পুরনিগম নির্বাচন এবং আসানসোল, বিধাননগর, চন্দননগর, শিলিগুড়ি চার পুরনিগম নির্বাচনে প্রথামাফিক শাসকদল জয়ী হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনেই প্রচার পর্বে এবং নির্বাচনের দিন বিরোধীদের পরিকল্পিতভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। হুমকি, মারধোর, ছাপ্পা ভোট, বুথের বাইরে অবৈধ জমায়েত, কোথাও বা বোমাবাজি।
সামনে ১০৮টি পুরসভার ভোট। ইতিমধ্যেই চারটি পুরসভা শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছে। বাংলার ভোট চিত্রে কোনও বদল নেই। বারবার একই চিত্র প্রতিটি ভোটে। বাংলার ভোট মানেই হিংসা। নির্বাচনি হিংসায় বাংলা বিহার-উত্তরপ্রদেশকে হার মানিয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১০৮ পুরসভার ভোটে কী কী হবে তা এখনই আন্দাজ করা যায়। অসংখ্য প্রকল্প দিয়েও কি জনসাধারণের ক্ষোভকে প্রশমিত করা যাচ্ছে?
গণতন্ত্র দলন করে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করা যায় না, পৃথিবীর ইতিহাস সেরকমই বলে। যাঁরা ভেবেছিলেন তৃণমূলকে দিয়ে বিজেপিকে ঠেকাবেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির বিকাশ কি সেই অভিমতকে সমর্থন করছে।