বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

ভয়ের বাতাবরণ একটু একটু করে ভাঙছে

ভয়ের বাতাবরণ একটু একটু করে ভাঙছে

সম্পাদকীয়, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

photo

ভয়ের বাতাবরণ জারি রাখার জন্য দেশ ও রাজ্যে চেষ্টার বিরাম নেই। ভয়ের বাতাবরণে দেশ আর রাজ্যকে মুড়ে ফেলতে পারলে যেন ক্ষমতাবানরা নিশ্চিত থাকতে পারে। তাহলেই যেন তাদের শাসন নিরাপদ থাকবে। পৃথিবী জুড়েই এই প্রবণতা। ধান্দার ধনতন্ত্র যত সংকটে ডুবে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দা যত দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, সম্পদ যত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় কর্পোরেট ধনীদের কাছে— বৈষম্য ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে— দারিদ্র, ক্ষুধা, বেকারি, মুদ্রাস্ফীতি, কাজ-রুজি-রোজগারের অনিশ্চয়তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। আর ভয়ের বাতাবরণ জারি রাখার বাসনা ক্ষমতাবানদের প্রণোদিত করছে। দেশে দেশে কঠোর থেকে কঠোরতর শাসন এখন বিশ্ব জোড়া প্রবণতা।
মুষ্টিমেয় কর্পোরেট ধনীদের ঘরে সম্পদের কেন্দ্রীভবন এবং লক্ষ-কোটি মানুষকে নিঃস্বতার দিকে ঠেলে দেওয়ার বিশ্ব জোড়া প্রক্রিয়ার সব থেকে বড় হাতিয়ার— অবাধ প্রতিযোগিতা, মুক্ত বাণিজ্য নয়, ক্রোনি পুঁজি ও শাসন ক্ষমতার যোগসাজস। এদেশে আদানি-আম্বানিদের রকেট গতিতে উত্থান তার সাক্ষ্য বহন করে। এই অমানবিক ব্যবস্থা ও তার বহিঃপ্রকাশগুলির বিরুদ্ধে যাতে জনমত সংগঠিত হতে না পারে, মানুষ যাতে আন্দোলন-প্রতিরোধে নামার দুঃসাহস না করে তারই জন্য ভয়ের বাতাবরণ জারি রাখা প্রয়োজন।
মানুষের মনে ভয়-আতঙ্কের পরিবেশ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেনা, আধা সেনা, পুলিশ, র‍্যাফ থেকে দুষ্কৃতি বা সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স রেইড, সিআইডি, স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ, মিথ্যা মামলা, বিনা বিচারে আটক, ইউএপিএ-র মতো কালা আইনকেই কেবল ব্যবহার করা হচ্ছে এমনটা নয়— ব্যবহার করা হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমকে। কর্পোরেট পরিচালিত সংবাদ মাধ্যমের অধিকাংশ আজ গোদি মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে। সরকার ও কর্পোরেটরা সর্বশক্তিমান, তারা মানুষের স্বার্থে নিবেদিত, তাদের কোনও ভুল হয় না— সরকার ও কর্পোরেটদের কাজে প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করা গর্হিত— এই ধরনের প্রচার তাদের সাধারণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও যদি পুঁজি ও ক্ষমতার স্বার্থদ্বন্দ্বে এমন কি কোনও বিশ্বখ্যাত মিডিয়া বেসুরো গেয়ে অপছন্দের খবর প্রকাশ করে ফেলে তাহলে শুরু হয় আয়কর হানা সহ ভয় দেখানোর নানা ব্যবস্থা। সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের উপর আক্রমণও ভয়ের বাতাবরণ জারি রাখার সাধারণ উদ্দেশ্যে।
তবুও বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়, প্রতিবাদে নামে। সেই প্রতিবাদ ও ঐক্যকে ভাঙার জন্য কর্পোরেট ও ক্ষমতাবানদের রয়েছে মানুষকে “ভাগ করো ও শাসন করো”র ব্রিটিশ নীতি। ভারতের মতো বিশাল দেশে নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা ধর্ম, নানা পরিধান, খাদ্য রুচি, সংস্কৃতির স্বাভাবিক বৈচিত্রকে বিরোধে উস্কে তুলছে ক্ষমতার শক্তি— এক জনগোষ্ঠীকে অপরের বিরুদ্ধে বৈরীতায় দাঁড় করার সংগঠিত প্রয়াস চালাচ্ছে। তার সঙ্গে রয়েছে এদেশের জাতপাতের সহস্র বছরের অভিশাপ, নিম্নবর্ণের প্রতি বঞ্চনা, সামাজিক অন্যায় ও পশ্চাদপদতা। রয়েছে আদিবাসীদের সহস্র সহস্র বছরের পশ্চাদপদতা। ক্ষমতায় আসীন মনুবাদী শক্তি আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের মানুষের পশ্চাদপদতাকে নিজেদের শাসনের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এদেশের সাংবিধানের মর্মবস্তুকে জলাঞ্জলী দিয়ে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে কার্যত তামাসায় পরিণত করেছে। এসবই ভয়ের বাতাবরণ জারি রাখার উদ্দেশ্যে। তবু একটু একটু করে ভয়ের বাতাবরণ ভাঙছে।
ক্ষমতাসীনরা বিরোধী ঐক্য ভাঙার জন্য সদা তৎপর। এই কাজে তাদের অন্যতম হাতিয়ার ঘোড়া কেনা-বেচা। দুর্নীতিগ্রস্থ বিরোধী দল ও নেতারা তাদের সহজ লক্ষবস্তু। আদর্শহীন, লোভী আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী নেতা ও বিরোধী দল তাদের আধিপত্যবাদী অভিমুখকে প্রসারিত করতে প্রকারান্তরে সুযোগ করে দিচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে আদর্শহীন বিরোধী দলগুলির ধরন কেন্দ্রের ক্ষমতাসীনদের মতোই— ভয়ের বাতাবরণ জারি রাখতে তারাও কম সচেষ্ট নয়। মানুষের স্বাধীন গণতান্ত্রিক মতামতকে তাদের বড় ভয়। সে বাংলায় হোক বা ত্রিপুরায়।
তবুও মানুষ সাহসে ভর করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। নিজেদের দাবি নিয়ে সংগঠিত হচ্ছেন, আন্দোলনের পথে পা বাড়াচ্ছেন। এই রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং যোগ্যদের নিয়োগের দাবিতে মরিয়া লড়াই সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। সরকার, প্রশাসন, শিক্ষা দপ্তর, শিক্ষা নিয়োগ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন ব্যর্থ হওয়ার পর আদালত তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আদালতের নির্দেশে আপাতত প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা নিয়োগ কর্তৃপক্ষ— অযোগ্যদের নিয়োগ বাতিল করার কাজ শুরু হয়েছে।
সম্মানজনক ভাবে জীবন ধারণের জন্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্সরা বকেয়া ডিএ বা মহার্ঘভাতার দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁদের সঙ্গে আছেন বয়স্ক পেনশনাররা। তাদের লাগাতার অবস্থান চলছে। প্রথমে একদিনের, পরে দু’দিনের কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন তাঁরা। গড়ে তুলেছেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম কমিটি। সরকার ৩ শতাংশ ডিএ ঘোষণা করলেও সম্পূর্ণ বকেয়ার দাবিতে ক্রমেই আন্দোলন প্রসারিত হচ্ছে। হয়ত দিল্লিতে এক বছরের বেশি দিন ধরে কৃষক আন্দোলন এবং ইউরোপের দেশে দেশে সম্মানজনক বেতনের দাবিতে একের পর পর আন্দোলন তাদের মানসিক জোর বাড়িয়েছে।
আন্দোলনে নামছেন সরকারি পরিবহন কর্মীরা। আন্দোলনে নেমেছেন আশা কর্মীরা। সংগঠিত প্রতিবাদের রাস্তা নিচ্ছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা, মিড ডে মিলেরর রন্ধন কর্মীরা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.