বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
পশ্চিম বাংলায় ২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া ভয়ঙ্কর হিংসার মধ্য দিয়ে আচমকা শুরু হয়ে গেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন কতটা হিংসাত্মক হতে পারে তার ইঙ্গিত মিলেছিল অনেক আগেই। বাহুবল ও অস্ত্রের দাপটে বিরোধী দল ও মতকে নিকেশ করতে মরিয়া প্রচেষ্টা চলেছে পরিবর্তনের পুরো সময়কাল জুড়েই। বাম ও কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলিকে দুরমুশ করার কাজ চলেছে বিগত ১২ বছর ধরেই। কেন্দ্রের বিজেপির সরকার যেমন সারা দেশে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার অভিমুখে এগোতে চাইছে তারই রকমফের চলছে এই রাজ্যে। কেন্দ্রের শাসক দলের মতোই অন্য দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসক দলে টেনে নেওয়াতে পিছিয়ে নেই এই রাজ্য। তারই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বিধায়ক পদে পদত্যাগ না করেই বায়রন বিশ্বাসের শাসক দলে যোগদান।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের বহু আগে থেকে পশ্চিম বাংলার নানা প্রান্তে বোমা বিস্ফোরণ, বাজি কারখানার আড়ালে বোমা তৈরির মহাযজ্ঞ পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছিল খুল্লমখুল্লা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বিপুল পরিমাণ বোমার অর্ডার ছিল বাহুবলী দুষ্কৃতির কাছ থেকে। পঞ্চায়েত ভোট বলে কথা। পঞ্চায়েতের মধুভাণ্ডের শেয়ার বিরোধীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এমনকি সেই মধুভাণ্ডের কর্তৃত্ব কার দখলে থাকবে সেই নিয়ে শাসক দলের বিবাদমান বাহুবলীদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষে রাজ্যবাসী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। ১৯৭৮ সালে যখন এই রাজ্য প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হল— গ্রামের গরিব প্রান্তিক মানুষেরা যেন উৎসাহের বানে ভাসল। প্রায় সর্বত্র সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা ভূমিহীন-প্রান্তিক-গরিব কৃষক, খেতমজুর, আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও সংখ্যালঘু মানুষেরা প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের কাজে অংশ নিলেন। তাঁদের অনেকেই নির্বাচিত হলেন। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে প্রায় এক চিত্র। পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদেও নির্বাচিত হলেন গরিব মানুষের আস্থাভাজন দরদী নেতারা। কামিয়ে নেওয়া যাঁদের জীবনের মোক্ষ ছিল না। সেই সময় পঞ্চায়েতের কাজে অর্থ বরাদ্দ ছিল খুব সামান্য। কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত অফিসে হাজির হতেন গ্রামের গরিব মানুষেরা। পঞ্চায়েত অফিসগুলির অবস্থাও ছিল অথৈবচ। পাকা ঘর কদাচিত দেখা যেত। উত্তপ্ত আলোচনা চলতো সামান্য যে অর্থ এসেছে তা দিয়ে কী করা হবে। কোন গরিবদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে হবে। কোন গরিবরা পাট্টা পাবেন, কাদের নাম অপারেশন বর্গায় নথিভুক্ত করতে হবে। ভেঙে পড়েছিল গ্রামীণ সম্পত্তিবান কায়েমী স্বার্থের যুগ যুগ ধরে চলা কর্তৃত্ব। বিডিও অফিস বা পার্টি অফিস থেকে নয় গ্রামীণ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো পঞ্চায়েত অফিস থেকে গ্রামের গরিব মানুষদের সঙ্গে পরামর্শ করে। বর্গায় নথিভুক্ত করার কাজ করা হতো বিডিও অফিস থেকে নয়, মাঠে গিয়ে— পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধি এবং কৃষক জনতার উপস্থিতিতে বিডিও অফিসের কর্মীরা সেই কাজ সুসম্পন্ন করতেন। পঞ্চায়েত হয়ে উঠল গ্রামীণ জনতার তৃতীয় সরকার। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলিত অনুশীলন।
ক্রমে ক্রমে অবস্থার বদল ঘটতে শুরু করল। গ্রামের নব্য ও পুরানো সম্পত্তিবান যখন বুঝলো যে এই শাসন স্থায়ী হতে চলেছে, কেন্দ্রীয় সরকার আগের মতো এই সরকারকে ভেঙে দেবে না, গুটি গুটি পায়ে চুপিসাড়ে তাদের একটা অংশ বামদলগুলিতে সেধোতে শুরু করল। বাম নেতৃত্বের মধ্যেও সজাগ সতর্কতার ঘাটতি দেখা দিতে থাকল। এবার আর চুপিসাড়ে নয় সদলবলে সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থবাদীরা বামদলগুলিতে অনুপ্রবেশ করতে থাকল। পঞ্চায়েতগুলি ক্রমশ দখল নিতে শুরু করল সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থবাদীরা। বেনোজলের স্রোতে প্রান্তিক-গরিব কৃষক, খেতমজুর, আদিবাসী, নিম্নবর্ণের মানুষেরা ক্রমশ গুরুত্ব হারালেন। বামদলগুলির সঙ্গে প্রান্তিক-গরিব মানুষের আত্মিক যোগাযোগ ক্রমশ ছিন্ন হতে থাকল। গ্রাম-শহরে প্রায় একই কায়দায় বেনোজল বামদলগুলিকে আচ্ছন্ন করতে থাকল। যদিও প্রক্রিয়াটা চলল বহু বছর ধরে। গ্রামীণ স্বার্থবাদীরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি এবং আখের গোছানোর ব্যবস্থায় বদলে ফেলতে শুরু করল। বাম নেতৃত্ব এই নেতিবাচক যাত্রার গতি রুখতে ব্যর্থ হলেন। তাঁদের বড় অংশ তখন স্থিতাবস্থার স্রোতে গা-ভাসিয়ে ফেলেছেন। নব্য ও পুরানো সম্পত্তিবান শ্রেণীর বঞ্চিত অংশটি উপযুক্ত সময়ের জন্য অধীর প্রতিক্ষায় প্রস্তুতি চালাতে থাকল, এক সময় তাদের ভাগ্যেও শিকে ছিড়বে। এরই প্রতিক্রিয়া ও নানা সমীকরণের পরিণতিতে ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে কয়েকটি জেলায় বামশক্তির পরাজয় হল। ২০১১ সালে মানুষের প্রত্যাখ্যানে বামেরা রাজ্যে পরাজিত হল।
ইতিমধ্যে সারা দেশে ইতিহাসের বিপরীত যাত্রা তীব্র গতি পেয়েছে। আরএসএস-বিজেপি সরকার ভারতের সহস্র বছরের বহুত্ববাদের ঐতিহ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের যা কিছু ইতিবাচক অর্জন, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষক জনতার ঢেউয়ের মতো সংগ্রমের অর্জনকে জলাঞ্জলি দিয়ে— সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে উদ্ধত পদচারণা চালচ্ছে। দেশের আর্থিক সয়ম্ভরতাকে ধ্বংস করে দেশি-বিদেশি ক্রোনি কর্পোরেটদের কাছে প্রায় জলের দরে রাষ্ট্রায়ত্ত ও প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিকেন্দ্রীভবন, জনগণের ক্ষমতায়ন, পঞ্চায়েত রাজ, স্থানীয় সরকার, জনসাধারণের নজরদারি, গ্রাম সংসদ— সবকিছুর মর্মবস্তুকে বিলোপ করে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের উপাঙ্গে পরিণত করার সংস্কার চলছে সারা দেশ জুড়ে। যেখানে জনগণের অধিকার ও ক্ষমতায়নের বদলে রাষ্ট্র, সরকার তথা শাসক দলের অনুগ্রহ বন্টনের উপাঙ্গ হিসাবে কাজ করবে পঞ্চায়েত। আর কোনও রাজ্যে যদি তৃণমূলের মতো শাসক দল থাকে, সেখানে অনুগ্রহ বন্টনের কাজকেও কামিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থায় অধঃপতিত করতে কোনও রকম রাখঢাকের বালাই যে থাকবে না তা বলাই বাহুল্য। এই অধঃপতিত আঞ্চলিক শাসকদের দুর্নীতি ও গণতন্ত্র বিরোধী কাজকে ব্ল্যাকমেইল ও ব্যবহার করে তাদের বশে রাখার কৌশলও কেন্দ্রের শাসকদের বাঁ হাতের খেলায় পরিণত হয়েছে।
অধিকার নয়, অনুগ্রহ বিতরণের জন্য নানান প্রকল্পে, নানান খাতে পঞ্চায়েতের হাতে বিপুল অর্থের জোগান আসছে। আর সেই মধুভাণ্ডের কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি নয় শাসক দলের বাহুবলীরা। সে কারণেই পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষ্যে এত বোমা, বন্দুক, গুলি। এত লাগামহীন হিংসা ও সন্ত্রাসের আয়োজন।
মনোনয়ন পর্বে মাত্র ছয় দিনে কমপক্ষে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। বশংবদ রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ বাহিনির চোখের সামনে শাসক দলের অবাধ সন্ত্রাস চলেছে। আক্রান্ত হয়েছেন সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা পর্যন্ত।
তবে মার খেতে খেতে গ্রামীণ জনতা এবং বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ সহ গণতান্ত্রিক শক্তি মরিয়া প্রতিরোধে নামছেন। উচ্চ আদালতও পঞ্চায়েত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ রাখতে শেষবেলায় রাজ্য জুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েনের আদেশ দিয়েছেন। যদিও রাজ্য সরকার ও কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে যাবে বলে শোনা যাচ্ছে।