বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

বাংলার জীবন জীবিকা ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে

বাংলার জীবন জীবিকা ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে

সম্পাদকীয়, ১৬ মার্চ, ২০২৩

photo

শ্রমজীবী ভাষা ১৬ মার্চ, ২০২৩— গ্রামবাংলায় স্বাস্থ্যের প্রাথমিক দায়িত্ব আশাকর্মীদের উপর। কোভিডের ভয়াবহ লকডাউন থেকে ডেঙ্গু দেখভাল— কার জ্বর হয়েছে, কোন মায়ের কী অবস্থা, শিশুদের আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ানো, টিকার ব্যবস্থা করা, টিবি রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো— অসংখ্য ধরনের কাজ করতে হয় আশাকর্মীদের। প্রসব বেদনা উঠলে গর্ভবতী মাকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা, এমন কি রাতবিরেতে — কার্যত ২৪ ঘন্টা কাজের জন্য তৈরি থাকতে হয় তাঁদের। তার উপর জুটেছে হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আবাস যোজনার তালিকার সমীক্ষার করার কাজ। এতশত কাজের পর মাস গেলে তাঁরা সাম্মানিকের নামে মজুরি পান মাত্র ৪৫০০ টাকা। লক্ষী ভান্ডারের টাকা যোগ করলেও এই মাগ্গী-গন্ডার বাজারে গ্রামাঞ্চলের এই ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীরা এই সামান্য মজুরিতে সংসার চালান কী করে, সেটাই বিস্ময়। অথচ সরকারের হেলদোল নেই। আশা কর্মীরা রাস্তায় নেমেছেন স্থায়ীকরণ ও ২১,০০০ টাকা বেতনের দাবিতে।
সংগঠিত হচ্ছেন মিড-ডে-মিল কর্মীরা। তাঁদের সাম্মানিক মাসে ১৫০০ টাকা। তাও সারা বছর নয়, বছরে ১০ মাস তাঁরা এই নামমাত্র এই মজুরি পান। এই সামান্য কটি টাকাও ভাগ হয় সেলফ হেল্প গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে। তাতে এক এক জনের ভাগে জোটে নামমাত্র টাকা। এই নামমাত্র মাত্র কটি টাকার বিনিময়ে তারা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রান্না করা খাবারের জোগান দিয়ে চলেছেন দিনের পর দিন। মিড-ডে-মিল কর্মীরা তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রী পিছু সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন রাজ্যের নানান প্রান্তে।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও সংগঠিত হচ্ছেন বাঁচার মতো সম্মানজনক মজুরি, স্বীকৃতি ও স্থায়ীকরণের দাবিতে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মজুরি মাসে ৮২৫০ টাকা ও সহায়িকাদের মজুরি ৬৩০০ টাকা। মিনি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মীরা পান ৭০০০ টাকা মাত্র।
প্রায় বেহাল হয়ে পড়া এই রাজ্যে এই সমস্ত প্রান্তিক শ্রমজীবী মহিলাদের শ্রমে চলছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবু এই শ্রমজীবীদের জীবন যন্ত্রণা, বঞ্চনা এবং দাবি নিয়ে মাথা ব্যথা নেই সরকার বাহাদুরের — মাথা ব্যথা নেই সংবাদ মাধ্যমেরও। সংবাদপত্রের ভিতরের পাতার এক কোণে কোথাও বা কদাচিত পাওয়া যায় এদের কাহিনী — দুপুরের সংবাদে এদের খবর কোনও দিন জায়গা পেলে, এদের খবরে স্থান নেই প্রাইম টাইমে।
কিন্তু ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তিতে সংবাদের শিরনামে উঠে এসেছে সরকারি কর্মচারীদের হার না মানা আন্দোলন। যে আন্দোলনের শক্তি সংগঠিত করে নিয়েছে সরকারি স্কুলের শিক্ষক, হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদেরও। সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নানা কলকারখানার শ্রমিক সাধারণ। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতির পর্বে সরকার বাহাদুরের বকেয়া মহার্ঘ্য ভাতা (ডিএ) না দেওয়ার ক্লান্তিকর যুক্তি কর্মচারী, শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স সহ কোনও স্তরের সরকারি কর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না। মহামান্য আদালতও সরকারের কোষাগারের সামর্থ্যের অভাবের যুক্তি বাতিল করে জানিয়ে দিয়েছেন, ডিএ সরকারি কর্মীদের ন্যায়সঙ্গত আইনি অধিকার। সরকারের সমস্ত হুমকি উড়িয়ে দিয়ে সরকারি কর্মীরা পরপর কর্মবিরতি পালন করেছেন, লাগাতার অবস্থান ও অনশন চালাচ্ছেন— সব থেকে বড় কথা গত বারো বছরে এই প্রথম বার রাজ্যব্যাপী ধর্মঘট ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সাহস ও আশা জাগিয়েছে সর্ব স্তরের শ্রমজীবী মানুষের মনে। কোষাগারে অর্থ নেই বলে প্রচার করে সরকারি কর্মীদের থেকে অপরাপর শ্রমজীবী সহ নানা প্রকল্পের উপভোক্তা প্রান্তিক মানুষদের বিভাজন করার চেষ্টায় কিছুটা হলেও বাধা পড়েছে। সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের বকেয়া ডিএ-র দাবির সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরেছেন সরকারি দপ্তর, স্কুল, হাসপাতালগুলিতে প্রায় কয়েক লক্ষ শূণ্যপদে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি এবং চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণের দাবি। যে দাবি এই রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার, নিয়োগ প্রার্থী, ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি।
কয়েক বছর ধরে লাগাতার আন্দোলন চালাচ্ছেন হাজার হাজার নিয়োগ প্রার্থী। শিক্ষাক্ষেত্রে সংগঠিত প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রতিবাদে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন মহামান্য আদালত শুধু নয় জনতার দরবারেও মান্যতা পেয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে এবং নজরদারিতে সিবিআই ও ইডি তদন্ত চালাচ্ছে। মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে এখনও পর্যন্ত সরকারি স্কুলের ৮৮৫ জন গ্রুপ সি কর্মী, ১৯১১ গ্রুপ ডি, মাধ্যমিক স্তরে ৬১৮ জন শিক্ষক, ২৬৯ জন প্রাথমিক শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন। আদালত বার বার নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যোগ্য প্রার্থীদের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশ দিলেও সে কাজ এগোয়নি। বরং অযোগ্য অসৎ উপায় অবলম্বনকারী উৎকোচের বিনিময়ে চাকরি পাওয়াদের চাকরি বাঁচাতে সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে নানা স্তরে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি শিক্ষক ঘাটতির সমস্যাকে লজ্জাজনকভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। এই সংগঠিত অপরাধে কেবল যোগ্যপ্রার্থীদের প্রতিই অবিচার করা হয়নি, সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে অযোগ্য শিক্ষকদের শিক্ষা দানে ব্যর্থতাও নিদারুণভাবে প্রকাশ্যে এসেছে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড গড়ে তোলে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অগ্রগতি ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়। লোভী আত্মস্বার্থবাদী ক্ষমতা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজের গুরুত্ব বোঝে না — তাদের হাতে রাজ্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতকে রক্ষা করতে সমস্ত স্তরের মানুষকে সংগঠিত প্রতিবাদে নামা সময়ের দাবি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.