বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১— অর্থনীতি চরম সঙ্কটে। কর্মচ্যুতি, কর্মহীনতা, বেকারি, লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, আয় সঙ্কোচন— এগুলোই এখন ভারতীয় সমাজের সঙ্কটের মূর্ত প্রকাশ। কোভিডের সুযোগে এই সব সমস্যাকে তীব্রতর করেছে মোদি সরকারের আর্থিক নীতি। সামাজিক সম্পদ বণ্টনে আরও বেশি বৈষম্য সৃষ্টি করা— এই নয়া উদারবাদী দর্শনই মোদি সরকারের দর্শন।
সম্পদ বণ্টনে বৈষম্যের চেহারা স্পষ্ট হয় সাম্প্রতিকতম কর্মসংস্থানের তথ্যগুলির ওপর নজর দিলে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকমনি জানিয়েছে, এবছরের আগস্ট মাসে জাতীয় স্তরে বেকারির হার বেড়ে হয়েছে ৮.৩২ শতাংশ। ওই মাসেই শহরে বেকারির হার বেড়ে হয়েছে ৯.৭৮ শতাংশ। এবছর মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগেও এই হার ছিল ৭.২৭ শতাংশ। এছাড়া গ্রামীণ বেকারির হার আগস্টে বেড়ে হয়েছে ৭.৬৪ শতাংশ। এর মানে খরিফ চাষের কাজ শেষ হতেই গ্রামের লোকের কাজ ফুরিয়েছে। তাঁরা ফের ভিড় করছেন কাজের বাজারে।
এবছরের আগস্ট মাসে এসে দেখা যাচ্ছে, গত এক মাসে কর্মচ্যুত হয়েছেন ১৯ লক্ষ মানুষ। কাজ কমেছে কৃষিতে। অকৃষি ক্ষেত্রে বেড়েছে ছোট ব্যবসা এবং দিনমজুরের সংখ্যা। এদের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ২১ লক্ষ। এবং মাস মাইনের চাকরিতে নিয়োগ বেড়েছে নাম কা ওয়াস্তে।
দেশের শিল্পক্ষেত্রে জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে কাজ পেয়েছেন ২৫ লক্ষ কম লোক। অতিমারিতে স্থায়ী ভাবে কাজ হারানোর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। কোভিডের আগে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে কর্মরতের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি। আগস্টে তাঁদের সংখ্যা কমে হয়েছে ২ কোটি ৮০ লক্ষ। মানে ১ কোটি ২০ লক্ষ কাজ স্রেফ উধাও। ২০১৯ সালে দেশের যুবকদের ২৩.০১ শতাংশ বা প্রায় এক চতুর্থাংশ ছিলেন কর্মহীন। অনুমান করে নেওয়াই যায়, গত দু’বছরে যুবকদের কর্মহীনতার হার আরও বেড়েছে। সারা দেশজুড়ে কর্মহীনতার এমন ভয়ঙ্কর ছবি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে দেখা যায়নি। উল্টোদিকে, দেশের একাংশ শিল্পপতিদের বিপুল সম্পদ বৃদ্ধিও চোখে পড়ার মতো।
একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে কর্মহীনতার এই সঙ্কটের উৎস অর্থনীতিতে। তেমনটা হলে মোদি ঘনিষ্ঠ ক্রোনি কর্পোরেটদে সম্পদ বিপুল হারে বাড়ত না। মোদি সরকারের অর্থনীতি হল তাদের রাজনীতির ঘনীভূত রূপ। এই নীতিই হল, কোভিড ও লকডাউনের সুযোগে সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলা।
মোদির এই নীতিকে যদি পরাস্ত করতে হয় তাহলে বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক সংগ্রামে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। দরকার ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম। এদেশে এখনও পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সবচেয়ে জোরালো রাজনৈতিক হাতিয়ার হল ভোটাধিকার। সেই ভোটাধিকারকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে মোদিকে পরাস্ত করাটাই কাজ। সেখানে বাধা জাতপাত ও ধর্ম সহ নানা খণ্ডচেতনা। অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নানা খণ্ড চেতনাকে অতিক্রম করে নির্ধারক রাজনৈতিক চেতনায় পৌঁছতে হয়।
এদেশকে যদি এমন একটা বিকল্প পথে চালিত করতে হয় তবে দরকার মোদির ন্যারেটিভের পাল্টা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ। রাজনৈতিক দলগুলি তা রচনা করার আগেই সেই ন্যারেটিভ তৈরি করে দিয়েছেন কৃষকেরা। মঞ্চ করে দিচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তাকে ধারণ করার মতো ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ এখনও গড়ে তুলতে পারেনি। কৃষক সমাজের অগ্রগামিতা এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের পিছিয়ে থাকা অবস্থান, এখনকার পরিস্থিতিতে এও এক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা।
এখনকার কৃষক সংগ্রাম ব্যতিক্রমী এই অর্থেও যে স্বাধীনতার পর এই প্রথম ধনী কৃষক, পুঁজিবাদী কৃষক, মাঝারি কৃষক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক— প্রায় সমগ্র কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে মোদির কৃষিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তাতে সমর্থন যোগাচ্ছেন এমনকী ভূমিহীনরাও। সামিল হিন্দু-মুসলিম-শিখ-জাঠ, মহিলারা এবং সমাজের অন্যান্য অংশ। এভাবে সমগ্র কৃষক সমাজের একটা দীর্ঘস্থায়ী অঘোষিত মঞ্চ হয়ে উঠেছে কৃষক মোর্চা। এভাবে কৃষক মোর্চা মোদির ভেদনীতির বিরুদ্ধেও গড়ে তুলেছে ঐক্যবদ্ধ লড়াই।
বাস্তবে মোদিরাজের বিরুদ্ধে অর্থনীতি আর রাজনীতির লড়াইকে কীভাবে মেলাতে হবে তার জ্বলন্ত উদাহরণ তৈরি করেছে দশ মাস স্থায়ী কৃষক আন্দোলন। কৃষি আইন বাতিলের লড়াইকে তাঁরা বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত করেছেন। এর জেরে শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মচারী, অসংগঠিত শ্রমিক— সবার মিলনের এক মহামঞ্চ হয়ে উঠেছে কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ। কৃষকদের দাবির আন্দোলনকে ধাপে ধাপে মোদি বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছে কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ। তার সাম্প্রতিক প্রমাণ মিলেছে ৫ সেপ্টেম্বরের মহাপঞ্চায়েতে। এই মঞ্চের শক্তি এখন এতটাই যে উত্তর প্রদেশের ভোট হারানোর ভয়ে হরিয়ানার কট্টর বিজেপি সরকারও কারনালে কৃষকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
কৃষকদের এই দেশব্যাপী লড়াইয়ের সর্বোচ্চ রূপ হতে চলেছে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধের ডাক। এই বনধে শুধু কৃষকরাই নন, সামিল হবেন গোটা দেশের শ্রমজীবী মানুষ। তা হবে মোদি সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এক দেশব্যাপী সংগ্রামের একটা পর্ব, যা ভবিষ্যতের আরও বড় এবং আরও ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ভিত গড়ে তুলতে পারে।