বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
নির্বাচনী বন্ড ভারতীয় গণতন্ত্রের আসল চেহারাটা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। কর্পোরেট, ব্যবসায়ী এবং ক্রোনিরা যাতে নিজেদের পরিচয় গোপন করে রাজনৈতিক দলগুলিকে টাকা দিতে পারে এবং কার ঝুলিতে কত টাকা ঢুকছে প্রকাশ না হয় সেকারণেই নির্বাচনী বন্ডের প্রকল্প চালু করেছিল মোদি সরকার। আর বিজেপি যখন কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় তখন কর্পোরেট টাকার সিংহভাগ তাদের ঝুলিতেই ঢুকবে এটাই স্বাভাবিক। কমন কজ ও এ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফরমস এর মতো নাগরিক সংগঠন এবং সিপিআইএম দল এই নির্বাচনী বন্ডের রহস্য প্রকাশ্যে আনার জন্য লাগাতার আইনি লড়াই এবং জনমত গড়ে তুলেছেন। মোদি সরকার এই কর্পোরেট চাঁদার হিসাব প্রকাশ্যে না আনার জন্য নানাভাবে বাধা দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ডের রহস্য প্রকাশ্যে আনার নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনী বন্ডের যতটুকু এখনো পর্যন্ত প্রকাশ্যে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে কেবল কর্পোরেট ও ব্যবসায়িক কোম্পানির টাকা নয়, বিভিন্ন সেল কোম্পানির মাধ্যমে কালো টাকাও ঢুকেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলগুলির কোষাগারে। বন্ডের টাকা সবচেয়ে বেশি গেছে বিজেপির ঝুলিতেই। বোঝা যায় বিজেপিই এখন ক্রোনি পুঁজির সবচেয়ে বিশ্বস্থ পাহারাদার— জনগণের স্বার্থের চৌকিদার নয়। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্পোরেট দান পেয়েছে পশ্চিমবাংলার শাসক দল তৃণমূল। সুতরাং এটাও বোঝা যায় যে রাজ্যের তৃণমূল দলটি ক্রোনি পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক দল। অনেকে তাদের দরিদ্র বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে বর্ণনা করে ঠকে গেছেন। কর্পোরেটরা অবশ্য বিভিন্ন রাজ্যে যারা শাসন ক্ষমতায় তাদেরকে বড় পরিমাণ দান দিয়েছে। কংগ্রেসকেও বঞ্চিত করেনি কর্পোরেটরা। কেবল বামপন্থী দলগুলিই ব্যতিক্রম— শ্রমজীবী মানুষের শ্রম, মেধা, প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠের টাকা তাদের ঝুলিতে ঢোকেনি।
ক্রোনি পুঁজি কর্পোরেট জগতের প্রতিযোগিতাকে এড়িয়ে শাসকদের সঙ্গে যোগসাজসে মুনাফার হারকে অবিশ্বাস্য হারে বাড়াতে চায়। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির সংকট যত তীব্র হয়েছে, সেই সংকটের বোঝা শ্রমজীবী জনতার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল ক্রোনি পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী কঠোর শাসকের। এক দশক আগে আম্বানি আদানি মতো কর্পোরেটরা নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপিকে শাসক হিসেবে বেছে নেয়। যাদের পিছনে আছে প্রায় একশ বছরের পুরানো আরএসএস সংগঠন। যারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং গুজরাট দাঙ্গার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক অভিযান শুরু করেছিল।
দেশ জুড়ে অসংখ্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষক শ্রমজীবী জনতা যে অধিকারগুলি অর্জন করেছিলেন এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলিকে কেড়ে নিতে মোদি সরকার উন্মত্ত অভিযান শুরু করেছে। শ্রমিকদের কাজ ও মজুরির নিশ্চয়তা, ইউনিয়ন করা, আন্দোলন ও ধর্মঘট করা, দরকষাকষি করার অধিকার কেড়ে নিতে চারটি শ্রম কোড চালু করেছে। ১০০ দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, বনাধিকার আইন, জমি অধিগ্রহণের সংশোধনী আইনকে ক্রমান্বয়ে লঘু করেছে। রেল, প্রতিরক্ষা, খনি বেসরকারিকরণ করে ক্রোনি পুঁজিপতিদের অবাধ লুঠের সুযোগ করে দিয়েছে। কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি বড় ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির অনাদায়ী ঋণকে রাইট অফ করে দিয়েছে। অন্যদিকে, শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ভাঙতে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব আইন সহ আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী অভিযানে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র করে যাচ্ছে।
ক্রোনি পুঁজি ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী জোটকে প্রতিরোধ করতে শ্রমিক-কৃষক ও শ্রমজীবীদের স্বার্থে বৃহত্তম জোট গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। বামপন্থী সহ শ্রমজীবীদের সমস্ত শক্তিকে এই কাজে হাত মেলাতে হবে।