বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
উত্তর ২৪ পরগণার সুন্দরবন সংলগ্ন সন্দেশখালিতে নারী শক্তির উত্থানে পিছু ঘটেছে শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতিরা। নারী শক্তির তেজের সামনে বিপর্যস্ত দুষ্কৃতি বাহিনী থেকে পুলিশ-প্রশাসন। এক দশক ধরে চলা অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছে সন্দেশখালি। শাসকদলের বাহুবলীদের লুঠের জুলুম এবং পুলিশ-প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছে জনরোষ। জনতার প্রতিরোধের সামনের সারিতে নারী শক্তি। দুষ্কৃতির পান্ডাদের অনেককেই একে একে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। অবস্থা বেগতিক দেখে শাসকরা বহিষ্কার করে অপরাধের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। বাহুবলীদের পলায়নের পর গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক সমাধানের পথে না হেটে গ্রামে পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সরকার।
সুন্দরবনের অন্যান্য বাদা অঞ্চলের মতোই সন্দেশখালির কৃষকরা স্বাধীনতার আগে থেকে তেভাগা আন্দোলনের পথ বেয়ে ফসল ও জমির আন্দোলনে বারবার উত্তাল হয়েছেন। যুগ যুগ লাঞ্ছিত নিঃস্ব মানুষেরা লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ান। ফসল, জমি ও মর্যাদার জন্য লাগাতার আন্দোলনে ভেঙে পড়ে জোতদারদের কর্তৃত্ব। তফশিল জাতি, জনজাতি, মুসলমান কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এবং ভূমি সংস্কার আইন ও বর্গাদার অধিকার আইনের সফল রূপায়নে জমি ও ফসলের উপর দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাদারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হাজার হাজার দরিদ্র কৃষক পরিবার পেয়েছিলেন পাট্টা এবং সামান্য হলেও জমির অধিকার। ভাগচাষিরা চাষ ও ফসলের অধিকার পেয়েছিলেন। হাজার হাজার বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত হয়েছিল। সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি হওয়ায় নোনা জলের মেছো ভেড়িতে চিংড়ি ও মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় অন্যতম উপার্জনের উপায় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও লাভজনক চিংড়ি চাষ ও রফতানিকে কেন্দ্র করে পুঁজির সঞ্চালন ও মুনাফার ভাগদখলকে কেন্দ্র করে বাহুবলীদের উত্থান শুরু হয়ে যায় নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে।
২০১১ সালের পালাবদলের পর গত এক দশকে পশ্চিমবাংলার আরও অসংখ্য জায়গার মতো সন্দেশখালির গ্রামীণ জীবনে বাহুবলীরা দন্ডমুন্ডের অধিকর্তা হয়ে ওঠে। কেড়ে নিতে শুরু করে ভূমি সংস্কারের ফসল— ছোট কৃষক ও বর্গাদাররা জমি থেকে উচ্ছেদ হন। কৃষকদের কাছ থেকে হাজার হাজার বিঘা জমি জোর করে ভয় দেখিয়ে জলের দরে কেড়ে নেওয়া হতে থাকে। চাষের জমিতে জবরদস্তি নোনা জল ঢুকিয়ে মেছো ভেড়ি বা লিজের টাকা না দিয়ে জলকর করা শুরু হয়। ভূমিসংস্কারের বিপরীত যাত্রা কেবল সন্দেশখালি নয় এখন সাধারণ প্রবণতা।
ভূমিসংস্কার ও মাছ চাষের উপর ভিত্তি করে গ্রাম জীবনের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির রাস্তা তৈরি হয়েছিল তার লাভের ভান্ডার কব্জা করে শাসক আশ্রিত বাহুবলী দুষ্কৃতিরা। তারা হয়ে ওঠে বিপুল অবৈধ সম্পত্তির অধিকারী। আর শ্রমজীবী জনগণ কাজের অভাবে দূরে পারি দিতে থাকেন আরও বেশি করে। এমনিতেই অনুন্নয়নের কারণে সুন্দরবন এলাকার পুরুষরা বাইরে কাজে যেতে বাধ্য হন— এখন সেই প্রবণতা তীব্র হয়েছে।
সুন্দরবন তথা পশ্চিমবাংলায় এখন নারীরা গুরুত্বপূর্ণ শ্রমশক্তি। তাদেরকে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে বা সামান্য মজুরিতে জবরদস্তি কাজ করানো, ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং এ যেতে বাধ্য করা, মাঝরাতে কাজ করানো, পার্টি অফিসে বসিয়ে রাখার মতো অবমানকর পুরুষতান্ত্রিক অপরাধগুলি সন্দেশখালির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সহ্যের বাঁধ ভাঙে দেয়।
ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা হয়ে উঠে বাহুবলীদের লুঠের হাতিয়ার। গ্রামীণ জীবনে অধিপত্য কায়েমের জন্য বিরোধীশূণ্য পঞ্চায়েত গড়তে লুঠ করা হয় মানুষের ভোট। গরিব মানুষের চাল, মিড ডে মিলের শিশু আহার থেকে গরিব মানুষের আবাসের টাকা লুঠ হতে থাকে। প্রতিবাদ করলেই কোদালের বাট দিয়ে মার, বাড়ি ঘর ভাঙচুর, মিথ্যা মামলা, গ্রামছাড়া করা চলতে থাকে পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে তাদেরই প্রশ্রয়ে।
সন্দেশখালির প্রাক্তন বাম বিধায়ক বিধানসভায় এই সমস্যা উত্থাপন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছেন। হট্টগোল করে তাঁর কন্ঠস্বরকে চাপা দেওয়া হয়। সন্দেশখালি উত্তাল হয়ে উঠলে তাঁকেই মিথ্যা মামলায় অভিযোগ দায়ের করার আগেই এফআইআর করে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আপাতত দুষ্কৃতিরা গ্রেপ্তার হওয়ায় সন্দেশখালিতে সাময়িক মুক্তির উচ্ছাস। তবে সতর্ক থাকতে হবে দুষ্কৃতিরা যেন আবার ভোট লুঠ করতে না পারে অথবা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি যেন প্রতিবাদী জনতার ঐক্যে বিভাজন আনতে না পারে। সন্দেশখালি সহ সারা রাজ্যে বাম ও গণতন্ত্রের পরিসরকে শক্তিশালী করা সময়ের দাবি।