বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুটো দল

আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুটো দল

সম্পাদকীয়, ১ মে, ২০২৪

photo

পুঁজিবাদ লাঞ্ছিত এই অসাম্যের বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই তো মে দিন। নয়া উদারবাদের পর্বে এই অসাম্য তীব্রতর হয়েছে। এদেশে আম্বানি-আদানি-টাটার মতো মুষ্টিমেয় ধনী-অতিধনীদের হাতে সম্পদ আরও কুক্ষিগত হয়েছে আর ব্যাপকতর শ্রমজীবী মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বঞ্চনা, দারিদ্র, বেকারি ও নিঃস্ব হওয়ার দিকে। থমাস পিকেটিরা জানিয়েছেন, ১৯২২-২০২৩ পর্বে ভারতে বিলিয়নেয়ার রাজের উত্থান ঘটেছে। আয় ও সম্পদের বৈষম্যে সারা পৃথিবীর সামনের সারিতে এখন মোদির ভারত। আজকের ভারতে বৈষম্যের মাত্রা ঔপনিবেশিক সময়ের চেয়েও বেশি। কর্পোরেট লুঠ দেশকে নিঃস্ব করছে।

দেশের শ্রমজীবী জনগণের ৯৩ শতাংশের বেশি আজ পরিণত হয়েছে প্রায় নিঃস্ব অসংগঠিত শ্রমশক্তিতে। তাদের না আছে জীবিকার নিশ্চয়তা, কাজের নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা। তাদের কাজের ঘন্টার ঠিকঠিকানা নেই। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী থেকে চুক্তিকর্মী বা স্বনিযুক্ত কর্মী, ক্ষেতমজুর কারোরই প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে মাত্র দু’টাকা বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয় ১৭৮ টাকা। মুদ্রস্ফীতি-মূল্যবৃদ্ধির দাপটে শ্রমজীবী মানুষ দিশাহারা। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিলের মতো প্রকল্প কর্মীদের সামান্য সাম্মানিক দিয়েই খালাস সরকার। ভোটের বাজারে সামান্য মজুরি (সাম্মানিক) বৃদ্ধির ঘোষণা করে শাসকরা আত্মপ্রসাদ পান যেন কত কি করে দিলাম। সরকারি দপ্তর, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা থেকে বেসরকারি সংস্থায় অবাধে চুক্তিভিত্তিক, ঠিকা কর্মী নিয়োগ হচ্ছে।

লক্ষ লক্ষ শূণ্যপদ খালি পড়ে থাকছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি দপ্তরগুলিতে। মোদির বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি বা মমতার লক্ষ লক্ষ চাকরির গল্প মানুষ আর বিশ্বাস করে না। সারা দেশেই কাজের আকাল। কর্মহীন শ্রমজীবীরা কাজের খোঁজে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে। পশ্চিমবাংলার এমন হাল যে এরাজ্যের বেকাররা কাজের খোঁজে কেবল মহারাষ্ট্র, গুজরাট বা কেরালায় যাচ্ছেন এমন নয়, যাচ্ছেন ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এমনকি মিজোরামে। দেশে-রাজ্যে নিদারুণ বেকারির আঘাত শ্রমজীবী মানুষকে যা হোক কিছু একটা কাজের জন্য তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি নিয়োগকর্তারা সেই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে চলেছে।

অসংগঠিত শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী শ্রমিকরা আরও বেশি বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অরক্ষিত। কর্মক্ষেত্রে যৌনলাঞ্ছনা যেন তাদের চিরসঙ্গী। সমান কাজে সমান মজুরি এবং নারী শ্রমিকদের জন্য পুরুষের সমান মজুরির দাবি যেন কোন দূর গ্রহের কথা। কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্পের অভাব না থাকলেও নাবালিকা বিয়ে আর নারী পাচারে এরাজ্য দেশের সামনের সারিতে।

বহু সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে যে অধিকারগুলি দেশের শ্রমজীবী মানুষ অর্জন করেছিলেন কর্পোরেট লুঠের স্বার্থে সেই অধিকারগুলি কেড়ে নিতে চারটি শ্রম কোড চালু করেছে মোদি সরকার। একইভাবে, খাদ্য সুরক্ষা আইন, ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা প্রকল্প, বনাধিকার আইন, জমি অধিগ্রহণ সংশোধনী আইনের মতো আইন ও অধিকারগুলি কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে কার্যত বাতিল করার অভিসন্ধি চালিয়ে যাচ্ছে মোদি সরকার।

কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শক্তির স্বার্থ আজ একাকার হয়ে গেছে। নির্বাচনী বন্ড কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদের আসল স্বরূপ প্রকাশ করে দিয়েছে। কর্পোরেট লুঠ ও বল্গাহীন শোষণের স্বার্থে আজ ফ্যাসিবাদী-স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলি ধর্ম-জাতপাত-জাতি-পরিচিতির ভিত্তিতে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে ধ্বংসের উন্মত্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রাম মন্দির ও জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল। রাম নবমী পালনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুই দল। উগ্র হিন্দুত্বের অভিযানকে নরম হিন্দুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

রাজনীতিকে ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে হবে, অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হবে কর্পোরেট লুঠের হাত থেকে। কর্পোরেট স্বার্থ ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিকে প্রতিরোধ করতে ব্যাপকতম শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে বামপন্থীদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে তরুণ প্রজন্মকে এই কাজের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে হবে— পৌঁছে যেতে হবে শ্রমজীবী মানুষ, ক্ষেতমজুর, দরিদ্র-প্রান্তিক কৃষকের দ্বারে দ্বারে। পরাজিত করতে হবে কর্পোরেট স্বার্থ ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শক্তিগুলিকে। সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে যে, গণতন্ত্র দলনকারী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করা যায় না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.