বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১— পেট্রল-ডিজেলের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে চলেছে। মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা সহ সারা দেশের প্রায় অধিকাংশ জায়গায় পেট্রোলের দাম একশো টাকার গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। ডিজেলের দামও একশোর দিকে দৌড়াচ্ছে। পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরোপিত কর। পেট্রোলের উপর কেন্দ্রীয় আবগারি শুল্ক ৩২.৯০% এবং ডিজেলে ৩১.৮০%। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে মোদি সরকার জ্বালানির উপরে আবগারি শুল্ক বাবদ ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার জন্য নয়, পেট্রোল-ডিজেলে বিপুল হারে কর চাপানোর জন্যই পেট্রোপণ্যের দাম চড়া হারে বেড়েছে, তা সংসদের বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনেই কেন্দ্রের অর্থ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন।
রাজ্য সরকারগুলি যথার্থভাবেই পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রের দিকে আঙুল তুলছে। জিএসটির বকেয়ার দাবিতে একজোট হচ্ছে। কিন্তু জিএসটির আওতায় পেট্রোপণ্যকে আনতে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না। পেট্রোপণ্য জিএসটি-র আওতার বাইরে রয়েছে। রাজ্য সরকারগুলি তার সুযোগ নিয়ে পেট্রোপণ্যের ভ্যাট বাবদ বড় পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে রাজ্যগুলি পেট্রোপণ্যের ভ্যাট বাবদ আয় করেছে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা।
পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ যদি হয় কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরোপিত আবগারি শুল্ক, দ্বিতীয় কারণ হল রাজ্যগুলি কর্তৃক আরোপিত ভ্যাট ও অন্যান্য শুল্ক। রাজ্যভিত্তিতে সেই হারের তারতম্য আছে। রাজ্যের আরোপিত ভ্যাট সব থেকে বেশি মহারাষ্ট্র-মুম্বইয়ে— সেখানে পেট্রোলে ও ডিজেলের উপর ভ্যাট যথাক্রমে ৩৯.১২% এবং ২৪.৭৮%। পশ্চিমবাংলায় পেট্রোলে ও ডিজেলের ওপর ভ্যাট যথাক্রমে ২৫.২৫% এবং ১৭.৫৪%।
জ্বালানির আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতিকে তীব্র করেছে। কেয়ার রেটিংয়ের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন মাসে পেট্রল ও ডিজেল এই উভয় জ্বালানির উপর মুদ্রাস্ফীতি যথাক্রমে ৬৩.২ শতাংশ এবং ৬৬.৩ শতাংশ। এর সরাসরি প্রভাবে সমস্ত ক্ষেত্রেরই মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে ব্যাপক হারে। সব ধরনের পণ্য পরিবহণ খরচ বেড়েই চলেছে। সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তদের বেশির ভাগ অংশের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সমস্ত ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ভোজ্য তেলের দাম আকাশছোঁয়া। এই পরিস্থিতিতে পেট্রোপণ্যের কর কমানোর দাবি সারা দেশের মানুষের অত্যন্ত জরুরি দাবি হয়ে উঠেছে।
পরিস্থিতির আর একটি দিক হল, অতিমারির সময়ে ভারতে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহের পরিমাণ বিপজ্জনক ভাবে কমেছে। প্রত্যক্ষ কর বলতে বোঝায় কর্পোরেট ট্যাক্স ও ইনকাম ট্যাক্স। অথচ পরোক্ষ কর সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে যাচ্ছে। বিগত বছরের তুলনায় ২০২১ অর্থবর্ষে পরোক্ষ কর বাবদ আয় ১২.৩ শতাংশ বেড়েছে। নগদের সঙ্কটে পড়া কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির উপার্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানির উচ্চ মূল্য— পেট্রোলের খুচরো মূল্যের ৫৫ শতাংশ এবং ডিজেলের প্রায় ৫০ শতাংশ তাদের রাজস্বের উৎস। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি কেন জ্বালানির উপর ট্যাক্স কমাতে চায় না তার কারণ নিহিত আছে এখানেই।
ভয়াবহ আর্থিক মন্দা ও সংকোচনের মুখে দাঁড়িয়ে নগদ অর্থের তল্লাস করতে গিয়ে মোদি সরকার দেশের অর্থনীতির পক্ষে একের পর এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। নোটবন্দি করে বা জিএসটি চালু করে নগদ অর্থের সংকটের কোনও সমাধান হয়নি। বরং আর্থিক মন্দা গভীরতর হয়েছে। অতিমারি ও লকডাউন আর্থিক সংকোচনকে তীব্র করেছে। দেশের আর্থিক স্বনির্ভরতার উপাদানগুলিকে দাঁও হিসাবে কাজে লাগিয়ে সরকার রাজকোষ ভরাবার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায় জলের দরে বেচে দিচ্ছে। কিন্তু বিলগ্নিকরণ করে সরকার নগদ অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কখনো পূরণ করতে পারেনি। আসলে আমাদের মতো দেশে ভারসাম্যযুক্ত প্রবৃদ্ধির জন্য যে অর্থনৈতিক নীতিসমূহ ও রাজস্ব নীতি গ্রহণ করা দরকার তাতে ঘোরতর আপত্তি দেশের শাসকদের।
দেশের কর ব্যবস্থায় চালু নীতি হচ্ছে রাজকোষ ভরানোর জন্য পরোক্ষ করের বোঝা বাড়িয়ে চলা। যে পরোক্ষ করের বোঝা বহন করতে হয় দেশের আপামর মানুষকে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে দেশের সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রতর জনসাধারণকে। বিপরীতে, অতি ধনী ও সম্পত্তিবান শ্রেণীগুলির প্রদেয় প্রত্যক্ষ করের বোঝা কীভাবে সহনীয় করে তোলা যায় তার জন্য সরকার নানা উদ্ভাবনী রাস্তা খুঁজে বের করে তাদের জন্য ট্যাক্স ছাড়ের ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট।
মনমোহন সরকারের শেষ পর্বে যখন থেকে পেট্রোপণ্যের দাম বিনিয়ন্ত্রণ করা হয় তখন থেকেই পেট্রল ও ডিজেলের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে ফাঁসের মতো চেপে বসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিমারি ও মোদি সরকারের জমানায় পেট্রল ও ডিজেলের উপর কেন্দ্রীয় ট্যাক্স বিপজ্জনক ভাবে বাড়িয়ে চলার নীতি।
অবিলম্বে পেট্রোপণ্যের উচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এর জন্য দেশের রাজস্ব নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। রাজস্ব সংগ্রহে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়িয়ে চলার বিপরীতে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহের উপর গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। বিশেষ করে কর্পোরেট ট্যাক্স বৃদ্ধির রাস্তা খোঁজা দরকার। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। আশু হিসেবে, পেট্রোপণ্যকে জিএসটির অন্তর্ভূক্ত করার দাবিতে দেশব্যাপী জনমত গড়ে তোলা জরুরি।