বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
কোভিড অতিমারি ধনতন্ত্র ও নয়া উদারনীতির আসল চেহারাটা উন্মোচিত করে দিয়েছে। সোভিয়েতের পতনের পর প্রায় এক মেরু বিশ্বে ধনতন্ত্র এক আগ্রাসী অভিযানে নামে। সোভিয়েত রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ, শিশু-বৃদ্ধ-অনাথদের ভরণপোষণ সহ অর্থনীতি ও জীবনের দায়িত্ব গ্রহণ— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হীনশক্তি ধনতান্ত্রিক দেশগুলিকে বাধ্য করেছিল কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করার পথ নিতে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ নাগরিক জীবনের নানান দায়িত্ব গ্রহণ করতে। নয়া উদারনীতির পর্বে ধনতন্ত্র সেই রাস্তা পরিত্যাগ করে লাগাম ছাড়া ভাবে লগ্নি পুঁজির রথে সওয়ার হয়।
অর্থনীতিকে পুরোপুরি বাজারের হাতে তুলে দিয়ে অর্থনীতির বিনিয়ন্ত্রণ শুরু হয় লাগামছাড়া ভাবে। দেশে দেশে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে জলের দরে বেচে দেওয়া হতে থাকে বেসরকারি পুঁজির কাছে। জল-জঙ্গল-জমি, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, প্রকৃতির কোনও কিছুই পুঁজির গ্রাস থেকে রক্ষা পায় না— যা জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নকে তীব্র করে তোলে। সরকার পোষিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বনাশ করে ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্য খুলে দেওয়া হয়। শ্রমিক শ্রেণীর বহু সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারগুলিকে ক্রমাগত সংকুচিত করার অভিযান শুরু হয়। এ হল লগ্নি পুঁজির মুনাফার হারকে বৃদ্ধি করার নিষ্ঠুর অভিযান।
অতিমারি ও লকডাউন নয়া উদারবাদের তীব্র অসাম্য জনসমক্ষে নিয়ে আসল। স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাবে দেশে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হল। এ দেশে লকডাউনে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলির অসহায় অবস্থা সামনে এল। কাজের অভাবে, খাদ্যের অপ্রতুলতায় কোটি কোটি শ্রমজীবী, প্রান্তিক মানুষ সরকার আর অদৃষ্টকে দায়ী করল। অমর্ত্য সেন, অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সারা পৃথিবীর বিবেকবান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানীরা দাবি তুললেন, দেশে দেশে সরকারকে জনসাধারণের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে; প্রান্তিক, দরিদ্রতর মানুষের কাছে সরাসরি নগদ হস্তান্তর করতে হবে সরকারকে।
বিভিন্ন দেশে বিরোধী দলগুলি নয়া উদারনীতির বিষময় ফলের বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কাজে লাগাতে শুরু করল। এই পটভূমিকায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আগ্রাসী উদারনীতির প্রতিনিধি ট্রাম্প পরাজিত হল। এ দেশেও রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন এবং নগরপালিকা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় সেই ইঙ্গিত বহন করছে।
এই রকম পরিস্থিতিতে ধনতন্ত্রের কর্ণধাররা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য রাস্তা খুঁজছেন। নয়া উদারনীতির প্রসাধনিক পরিমার্জন করে মানবিক মুখ হাজির করা তাদের লক্ষ্য।
ক্ষমতাধর ও ধনী দেশগুলি জি-৭ এর তিন দিন ব্যাপী বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান এবং ইংল্যান্ড— যারা সারা বিশ্বের মাত্র ১০% জনসংখ্যার অধিকারি, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির ৪০% নিয়ন্ত্রণ করে— তাদের বৈঠকে আমন্ত্রিত হিসেবে ছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা। অতিমারি ও চলমান অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেড়িয়ে আসতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলা ছিল ঘোষিত আলোচ্য বিষয়।
জি-৭ এর দেশগুলি কোভিড অতিমারি মোকাবিলায় নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে টিকাকরণের জন্য ১০০ কোটি ডোজ সরবরাহ করার অঙ্গীকার করেছে। পরবর্তী এক বছরে এই লক্ষ্যে তারা বেসরকারি ক্ষেত্র, জি-২০ ও অন্য দেশগুলির সঙ্গে একযোগে কাজ করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি কয়েক দিন আগে, ১৮ বছরের ঊর্ধে সমস্ত ভারতবাসীকে সরকারি খরচে বিনা মূল্যে কোভিড টীকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে ৮০ কোটি দরিদ্রতর ভারতবাসীকে মে-জুন মাস থেকে বাড়িয়ে দীপাবলি পর্যন্ত পাঁচ কেজি করে রেশন দেওয়ার কথা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণাও সরকারের মানবিক মুখ রক্ষা করার প্রয়াস মাত্র। যার পিছনে কাজ করেছে বিভিন্ন ধরনের চাপ ও বাধ্যতা।
জি-৭ ন্যূনতম ১৫% হারে কর্পোরেশন ট্যাক্সের প্রস্তাবে সহমত হয়েছে। ধনী দেশগুলি বহু বছর ধরে গুগল, অ্যামাজন, ফেসবুকের মতো অতিকায় বহুজাতিকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে একমত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। বহুজাতিকরা অবিশ্বাস্য হারে লাভ করে কিন্তু প্রায়শ যে সমস্ত দেশে তারা ব্যবসা করে তাদের কোনও ট্যাক্স দেয় না বা খুব সামান্য ট্যাক্স দেয়। উদারনীতির পর্বে অর্থনীতিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার এ এক ফল। অতিকায় বহুজাতিকগুলি এতটাই প্রভাবশালী উঠেছিল যে রাষ্ট্রের বিধিনিয়মকে কার্যত উপেক্ষা করছিল। ধারাবাহিক মন্দা ও অতিমারি মোকাবেলায় রাষ্ট্রগুলির যে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তা সংগ্রহ করার জন্য এই ঐকমত্য।
প্রধানমন্ত্রী মোদি জি-৭ এর এক অধিবেশনে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় বলেন— ভারত গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বৈরাচার, সন্ত্রাসবাদ এবং হিংস্র উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে ভারত জি-৭ এর স্বাভাবিক মিত্র। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ কত বড় রসিকতা, ভারতবাসী হিসেবে বুঝতে অসুবিধা হয় না।
বাস্তবতা হল, সোভিয়েতের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্ব প্রায় এক মেরু বিশ্ব আজ আর নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন স্বার্থশক্তি হিসাবে উঠে এসেছে। ব্রেক্সিটের পরও ইউরোপীয় সাধারণ স্বার্থের সঙ্গে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। এখনকার সময়ে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, অর্থনৈতিক ও বিশ্ব শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উন্নত দেশগুলি যাতে চীনের অর্থনীতির চমকপ্রদ উত্থানকে প্রতিহত করতে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারে তার জন্য জি-৭ এর বৈঠকে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তা সমর্থন করলেও ফ্রান্স, জার্মানির মতো ইউরোপীয় শক্তি চীনের সঙ্গে সরাসরি অর্থনৈতিক বিচ্ছেদে রাজি হয়নি। যদিও জাপান চীনের বিরুদ্ধে কঠোরতর শর্ত আরোপের পক্ষে মত দিয়েছে। চীন বিরোধী অক্ষ শক্তিশালী করতে ভারতের মতো দেশগুলি বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়েছিল। এখন দেখার ঘটনার গতিপ্রকৃতি কোন দিকে প্রবাহিত হয়।