বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

অতিমারিতে কর্মহীনদের বিপন্নতা

অতিমারিতে কর্মহীনদের বিপন্নতা

সম্পাদকীয়, ১৬ জুলাই, ২০২১

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— অতিমারির এই সঙ্কটকালে আমাদের রাজ্যে প্রায় নিঃশব্দে কতকগুলি ঘটনা ঘটে চলেছে যার খবর মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে খুব একটা সামনে আসছে না। ইদানীং সমাজের নানা স্তরের লোকজনদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর পিছনে রয়েছে অভাবের তাড়না। অভাবের পিছনে রয়েছে কোভিড পরিস্থিতি এবং কঠোর বিধিনিষেধের কারণে কাজ হারিয়ে আর্থিক দুরবস্থার মধ্য পড়া।

বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, এ বছরের জুন-জুলাই মাসে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকজন অভাবের কারণে আত্মঘাতী হয়েছেন। চলতি মাসে কথাই ৩ জুলাই দুপুরে রাজেশ গাঙ্গুলি নামের এক যুবক বঙ্কিম সেতুর ওপর থেকে হাওড়া প্ল্যাটফর্মে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হন। এক সময় ভিন রাজ্যে সোনার অলঙ্কারের কাজ করতেন তিনি। লকডাউনে কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। দ্বিতীয় দফার লকডাউনে ইদানীং প্রায় দু মাস কর্মহীন ছিলেন। অভিযোগ, রোজগারের পথ না পেয়ে হতাশায় আত্মঘাতী হন তিনি। ৭ জুলাই দক্ষিণ কলকাতায় বাসের মধ্যেই গলায় তার জড়িয়ে আত্মঘাতী হন এক বাসচালক রঞ্জিত দাস। অভিযোগ, কোভিড পরিস্থিতির কারণে বাস বন্ধ থাকায় রোজগার ছিল না তাঁর। এর আগে ১৬ জুন বেহালায় আত্মঘাতী হন ৩৮ বছরের ভাস্কর রায়। তাঁর মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভের চাকরি চলে গিয়েছিল। ১১ জুন কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হন বালুরঘাট ব্লকের শ্রমজীবী ননীগোপাল বর্মণ। ৬ জুন বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হন কুশমন্ডির পরিযায়ী শ্রমিক প্রসেনজিৎ মার্ডি। ৯ জুন ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহননের চেষ্টা করেন বাংলা টেলিভিশনের এক শিল্পী। কর্মচ্যুত হয়ে মাত্র ৩১ বছর বয়সেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ছিলেন তিনি। ১৫ জুন বেহালার সরশুনার বাসিন্দা ৫২ বছরের কৃষ্ণা রায় নিজের ফ্ল্যাটেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন। কোভিডে বিধিনিষেধের কারণে কাজ চলে গিয়েছিল তাঁর ছেলের। স্বামীরও আয় কমে গিয়েছিল। সেকারণে ফ্ল্যাটের ভাড়া দিতে পারছিলেন না তাঁরা। সম্প্রতি বেলেঘাটায় আত্মহত্যা করেন বিমার এজেন্ট, ৫৪ বছরের দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সুইসাইড নোটে অভাবের তাড়নার কথা লেখা ছিল। ৮ জুলাই হোয়াটস অ্যাপে আর্থিক দুরবস্থার কথা জানিয়ে আত্মঘাতী হন ৭০ বছরের নেপাল দাস। বউবাজার থেকে উদ্ধার হয় তাঁর দেহ।

দেখা যাচ্ছে অভাবজনিত এই আত্মহত্যা প্রত্যন্ত জেলাগুলির চেয়ে বেশি ঘটছে কলকাতা ও শহরতলি এলাকায়। অনুমান করে নেওয়া অসঙ্গত হবে না যে, কোভিডের দীর্ঘ প্রকোপ এবং রাজ্যে জারি থাকা কঠোর নিষেধাজ্ঞার জেরে (এই নিষেধাজ্ঞাকে লকডাউন নামে চিহ্নিত না করে দায় এড়াতে চাইছে কেন্দ্র এবং অধিকাংশ রাজ্য সরকারই) শহর এলাকার মানুষের, বিশেষত নিম্ন ও মাঝারি আয়ের লোকজনদের মধ্যে যে তীব্র কর্মহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার ধাক্কা সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকেই। আয়ের অনিশ্চয়তা ও অভাবের তাড়না তাঁদের কাউকে কাউকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের পথে।

এর মানে গত প্রায় দু’ বছর অতিমারির কারণে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কাজকর্ম চূড়ান্ত ভাবে ব্যাহত হওয়ায় দেশের অর্থনীতি চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রবেশ করেছে। বিশেষত বেসরকারি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার জেরে কর্মহীনতা ও রোজগারহীনতা বাড়ছে। দেশে কোভিড পরিস্থিতি যা তাতে যে কোনও দিন তৃতীয় ঢেউ এসে পড়তে পারে। ফলে আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। এর জেরে আরও অনেক পরিবারকে দাঁড়াতে হবে অনিশ্চয়তার মুখে। অসংগঠিত শিল্পে এর প্রভাব পড়ছে সবচেয়ে বেশি। অস্থায়ী, আধা স্থায়ী, অনিয়মিত আয়ের লোকেদের জীবনে আর্থিক অনিশ্চয়তা বাড়বে।

এই অনিশ্চয়তার উৎস রয়েছে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলা বেকারি ও কর্মহীনতার মধ্যে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২১ এর ৬ জুন সারা দেশে বেকারির হার ছিল ১২.৮ শতাংশ। ওই সপ্তাহে গ্রামাঞ্চলে ও শহরে কর্মহীনতার হার ছিল যথাক্রমে ১৫.৫ ও ১১ .৬ শতাংশ। এবছরের মে ও জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গে কর্মহীনতার হার ছিল যথাক্রমে ১৯.৩ ও ২২.১ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও শিল্পোৎপাদন করোনার আগের পর্বকে এখনও ছুঁতে পারেনি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মূল্যবৃদ্ধি। পেট্রল ডিজেলের দাম দাম সেঞ্চুরি করে ফেলেছে। বোঝাই যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতা ও জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতির কারণে দেশে কর্মহীনতার ক্ষেত্রে অসহনীয় এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এবং পশ্চিমবঙ্গও তার বাইরে নয়। এখানেও কর্মহীনতার হার ঊর্ধ্বমুখী শুধু নয় জাতীয় গড়ের থেকে যথেষ্ট বেশি। এই পরিস্থিতির নির্দিষ্ট প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি অসহায় মানুষের একাংশের আত্মহত্যার ঘটনায়।

রাজ্য সরকার শুধুমাত্র কেন্দ্রকে দায়ী করে এই পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না। বিপন্ন পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াতে হবে রাজ্য সরকারকে। পাশাপাশি কর্মচ্যুত বেকারদের অবিলম্বে আর্থিক রিলিফ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য দরকারে নিতে হবে বিশেষ কর্মসূচি। রাজ্য প্রশাসন যদি কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় কর্মসূচি ক্রমাগত অবহেলা করতেই থাকে, যদি বেকারি ও কর্মহীনতা বাড়তেই থাকে, তাহলে বঞ্চনা ও ক্ষোভ থেকে জন্ম নেবে গণ আন্দোলন, যেটা এই রাজ্যের ঐতিহ্য। আবার সেরকম পরিস্থিতি এরাজ্যে দক্ষিণপন্থী শক্তিকেও পরিসর দখলে সাহায্য করতে পারে, একথাও রাজ্যের শাসকেরা ভুলে গেলে বিপদের সম্ভাবনা বাড়বে।

এই পরিস্থিতিতে দরকার রুজি হারানো পরিবারগুলির জন্য আর্থিক রিলিফের ব্যবস্থা করা। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রের কাছে প্রত্যাশা করে লাভ নেই। কারণ তারা সাহায্য বলতে বোঝে ঋণ। এবং সরকারি ঋণের টাকা যাতে রাঘব বোয়ালেরাই পায় তার আইনি বিলিব্যবস্থা করতেই তারা ব্যস্ত।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.