বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

কৃষক ও গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম

কৃষক ও গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম

সম্পাদকীয়, ১ জুলাই, ২০২১

photo

টানা সাত মাস অতিক্রান্ত হল নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলন। পুলিশি ব্যারিকেড, পেরেক ও কংক্রিটের ব্যারিকেড, মিথ্যা মামলা, বিনা প্ররোচনায় গ্রেপ্তার, আলোচনার নামে কালক্ষেপ করে ধৈর্যচ্যুত করার চেষ্টা, কৃষক আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী তথা দেশবিরোধী হিসাবে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা— মোদি সরকারের কোনও কিছুই আন্দোলনকে ভাঙতে পারেনি। দিল্লির উপকণ্ঠে কৃষকেরা অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন মোদি সরকারের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে। ইতিমধ্যে শহিদ হয়েছেন ৫০০র বেশি কৃষক। এই বলিদান আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছে। দিল্লি, হরিয়ানা ও পাঞ্জাব থেকে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশজুড়ে। ঐক্যবদ্ধ করেছে বিভিন্ন স্তরের কৃষককে। গোটা দেশে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজের সবস্তরকে ঐক্যবদ্ধ করা ঐতিহাসিক এই কৃষক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
গোড়ায় সরকার এই আন্দোলনকে ধনী চাষিদের আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করে একে একঘরে করতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্রমশ এটা স্পষ্ট হল যে, শুধু ধনী চাষিই নয়, বড়-মাঝরি-ছোট সব ধরনের কৃষক নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। কারণ নতুন আইন কার্যকর হলে গোটা কৃষি ব্যবস্থাই চলে যাবে ক্রোনিদের দখলে। কৃষির উৎপাদন ও কৃষি বাণিজ্যকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে চলছে ধারাবাহিক ঐক্যবদ্ধ লড়াই। বহু চেষ্টাতেও এই ঐক্যে ফাটল ধরানো যায়নি। আন্দোলনের এই সর্বস্তরের ঐক্যই সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
১৯৭৫ সালের ২৬ জুন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই কালো দিনের স্মরণে ২৬ জুন আন্দোলনের ৭ মাস পূর্তিতে দেশজোড়া সমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব। এই সমাবেশের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে ব্যাপকতম দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করা। তবে শুধু কালো দিনকে প্রথামাফিক স্মরণ করাই এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে নাগরিক অধিকার যতটা সংকুচিত করেছিলেন, এখন কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারগুলি এদেশে গণতন্ত্রকে অনেক বেশি ধ্বংস করেছে। সিডিশন আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ করে প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ ও গ্রেপ্তার, সিএএ ও নাগরিকত্ব আইনের নামে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করতে চাইছে, আর্বান বা লিটারারি নকশাল তত্ত্ব আমদানি করে দলিত ও আদিবাসীদের আন্দোলনকে ধ্বংস করার কৌশল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো যুগ্ম তালিকার বিষয়গুলিকে কেন্দ্রের তরফে ছিনিয়ে নেওয়া, বিচারপতিদের সুবিধা বিলিয়ে বিচারব্যবস্থাকে পঙ্গু করার চেষ্টা, নির্বাচন কমিশনে দলের লোকেদের বসিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা— এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যার মাধ্যমে এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকেই তুলে দিতে চাইছে বিজেপি। স্বাধীনতার সাত দশকের অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর এর আগে এত ভয়ঙ্কর আঘাত আর আসেনি।
সে কারণেই কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইকেও নিজেদের পতাকায় উৎকীর্ণ করে নিয়েছেন। জানিয়েছেন, আগামী বছর উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড সহ সব রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁরা বিজেপি বিরোধী প্রচারে নামবেন। কৃষি আইনের বাতিলের দাবি অন্তর্বস্তুর বিচারে শ্রেণীর দাবি। গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই অন্তর্বস্তুর বিচারে বৃহত্তর রাজনৈতিক দাবি। এখানেই কৃষক আন্দোলনের উত্তরণ ঘটেছে। শ্রেণীর দাবি ও সাধারণ রাজনৈতিক দাবি পরস্পরের হাত ধরেছে। এবং সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছে শ্রমিক শ্রেণীও। ২৬ জুন শ্রমিকেরাও কৃষকদের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছিলেন। সব মিলিয়ে কৃষক আন্দোলন যে মশাল জ্বালিয়েছে, এখন তা আরও প্রসারিত হচ্ছে। এখানেই কৃষক আন্দোলনের আরও ব্যাপ্তি এবং টিকে থাকার সম্ভাবনা।
অতিমারি ক্রমশ ছড়াচ্ছে গ্রামে। গ্রামে মহামারি ছড়ালে কী হয় তার ভয়াবহতা আমরা দেখছি বিহার ও উত্তরপ্রদেশে। কোভিডের হাত থেকে কৃষক ও দেশবাসীকে বাঁচাতে বিনা মূল্যে টিকাকরণের দাবি প্রবল কন্ঠে তুলতে হবে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বকে। দেশবাসীকে অতিমারির হাতে ছেড়ে দিয়ে কর্পোরেট পুঁজিকে টিকা নিয়ে ব্যবসার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে মোদি সরকার।
এবার লকডাউনের দায় চতুরতার সঙ্গে রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে মোদি সরকার। পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্য লকডাউনের জন্য গত বছর মোদি সরকারকে সঠিকভাবেই কাঠগড়ায় তুলেছিল। এখন একাধিক রাজ্য ‘কড়া বিধিনিষেধ’ শব্দবন্ধে কার্যত লকডাউনই চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ যাদের বেশিরভাগকেই দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই দায় কোনও রাজ্য সরকারই এড়িয়ে যেতে পারে না। হয় এই সব শ্রমজীবী মানুষের আয়ের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা তাদের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব বিরোধী রাজ্য সরকারগুলিকে এই পরামর্শ দিলে এবং তা রাজ্য সরকারগুলি তা কার্যকর করলে তাঁদের মোদি-বিরোধী অবস্থান মানুষের কাছে আরও স্পষ্ট হবে। নতুবা স্রেফ শব্দবন্ধের আশ্রয় নিলে মানুষের সামনে বিরোধীদের ভিন্ন চরিত্রের ফারাকটা মুছে যেতে পারে। তাতে সুবিধা হবে কেন্দ্রের শাসক দলেরই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.