বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফলাফল বিজেপিকে নিরাশ করেছে। পশ্চিমবাংলা, কেরালা ও তামিলনাডুতে বিজেপি ও তার জোট পরাজিত হয়েছে। আসামে বিজেপি জয় হাসিল করে মুখরক্ষা করেছে— দ্বিতীয় বারের জন্য সরকার গড়ছে বিজেপি জোট। সেখানে বিজেপির ভোটের শতাংশ ৩৩.২১। কংগ্রেস জোট পরাজিত হলেও লড়াইয়ে ছিল। কংগ্রেস পেয়েছে ২৯.৬৭ শতাংশ ভোট। কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের সুবাদে সেখানে সিপিআই(এম) একটি আসনে জয়লাভ করেছে। পুদুচ্চেরিতে কংগ্রেসের দলছুট এন আর কংগ্রেস সঙ্গে জোট করে বিজেপি সরকারের অংশীদার হতে চলেছে।
কেরালায় নজির সৃষ্টি করে এলডিএফ বিপুল জয় পেয়েছে। পর পর দ্বিতীয় বার বাম-গণতান্ত্রিক জোট ক্ষমতাসীন হতে চলেছে। কেরালায় চার দশকেরও বেশি সময় পরে এমন ঘটল। বিগত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের থেকেও এবারে এলডিএফ বেশি আসন পেয়েছে।
কেরালায় সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর মিলিত ভোট (২৫.৩৮+৭.৫৮)= ৩২.৯৬ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছে ২৫.১২ শতাংশ। বিজেপি একটি আসনও পায়নি— ভোট পেয়েছে ১১.৩০ শতাংশ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেরালা সরকারের তৎপর ভূমিকা, পরিযায়ী শ্রমিক সহ শ্রমজীবী, প্রান্তিক ও গরীব জনসাধারণের জন্য জনমুখী কর্মসূচি নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তামিলনাডুতে ডিএমকে ও বাম-কংগ্রেসের জোট প্রত্যাশা মতো জয়ী হয়েছে। তামিলনাড়ুর জনগণ এআইএডিএমকে-বিজেপি জোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এআইএডিএমকে সরকারকে পরাজিত করেছে। জোটের কারণে সিপিআই ও সিপিআই(এম) দুটি করে আসনে জয়লাভ করেছে। বিজেপি পেয়েছে ৪টি আসন এবং ২.৬২ শতাংশ ভোট।
পশ্চিমবাংলায় দ্বিমুখী লড়াইয়ে পরাজিত হয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। বাংলার মানুষ আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও বিজেপিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। বিপুল জয় পেয়েছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস— ২১৩টি আসন এবং ৪৭.৯৪ শতাংশ ভোট। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী একদা তাঁর অন্যতম সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারীর কাছে ১৯৫৬ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। বিজেপি পেয়েছে ৭৭টি আসন এবং ৩৮.১৩ শতাংশ ভোট। পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে বাংলায় বিজেপির ভোট শতাংশ সব থেকে বেশি।
নির্বাচনে বিপর্যস্ত হয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকেই বেছে নিয়েছেন। বাম দলগুলি ও কংগ্রেস একটি আসনেও জয়ী হতে পারেনি। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে যা বেনজির। মোর্চার আইএসএফ-এর প্রার্থী নৌসাদ সিদ্দিকি ভাঙ্গড় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল ও বিজেপি প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনী লড়াইকে ত্রিমুখী করার দাবি জানিয়ে সংযুক্ত মোর্চা জনমনে প্রাথমিক উৎসাহ সৃষ্টি করলেও নির্বাচন প্রক্রিয়া যত এগিয়েছে বাংলা দখলের জন্য বিজেপির আগ্রাসী প্রচার মানুষকে ভীত-শঙ্কিত করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী সহ বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা যেভাবে বার বার বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচার করেছেন তাতে বাংলার মানুষ ক্রমেই বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে থাকেন। বিজেপিকে পরাজিত করতে বাংলার মানুষ সংযুক্ত মোর্চা নয়, প্রবলতর পক্ষ হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে বেছে নেন। গত দশ বছর শাসন ক্ষমতায় থাকার কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রবণতা জমা হয়েছিল, বিশেষত রাজ্যের শাসক দলের স্বৈরাচারী মনোভাব, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে ছাপিয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিজেপিকে প্রতিহত করার চাহিদা।
তাছাড়া কর্পোরেট মিডিয়া হাউসগুলি ২০১৪ সাল থেকে, আরও নির্দিষ্টভাবে ২০১৯ সাল থেকে বাংলায় দ্বিমেরু রাজনীতির প্রচার ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছিল। বাংলার মানুষের কাছে বেছে নেওয়ার জন্য মিডিয়া দুটি বিকল্পই তুলে ধরছিল— তৃণমূল ও বিজেপি।
বামপন্থী শক্তিকে খুঁজে দেখতে হবে, কেন এমন হলো। ২০০৬ সালে বামেদের ভোট ছিল ৫০ শতাংশ। ২০১১ সালে পরিবর্তনের সময় বামেদের ভোট কমে দাঁড়ায় ৪১ শতাংশ। আর ২০২১ সালে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫.৬৭ শতাংশ—সিপিআই(এম)-এর ভোট ৪.৭৩ শতাংশ। জনসমর্থনের কেন এই ধ্বস? নির্মোহ আত্মসমীক্ষা ছাড়া কোনও শক্তিই ইতিহাসের বাঁকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। বামপন্থীদের নবীন প্রজন্ম এই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে সারথী হতে পারে। লকডাউন এবং আমফানের দুর্যোগে যেভাবে প্রায় নিঃশব্দে বামপন্থী কর্মীরা বিশেষত তরুণ প্রজন্ম আর্ত মানুষের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং রাজ্য জুড়ে শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালু করে বিপর্যস্ত শ্রমজীবী গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যেভাবে নির্বাচনী প্রচার উপলক্ষে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছেন— সেই রকমভাবে প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকে ফিরে যেতে হবে শ্রমজীবী, প্রান্তিক, গরীব মানুষের দ্বারে। তবে কেবল নেতা হিসাবে নয়, তাঁদের জীবন সংগ্রাম ও অধিকারের লড়াইয়ের সাথী হিসেবে।
যে বন্ধুরা বাম ও কংগ্রেস পতনে উল্লসিত, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিই— বিজেপির ঘোষিত লক্ষ্য: কংগ্রেস মুক্ত ভারত, বাম মুক্ত ভারত গড়া। পশ্চিমবাংলায় সে কাজটাই করে ফেলেছেন মমতা ব্যানার্জী ও তৃণমূল কংগ্রেস। বাম-কংগ্রেসের ধ্বসের উপর দাঁড়িয়ে বাংলায় বিজেপির ভোট এখন ৩৮.১৩ শতাংশ।
শেষ করার আগে যে কথা আর এক বার বলা প্রয়োজন, স্বৈরাচার দিয়ে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করা যায় না। বরং স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদকে আবাহন করে নিয়ে আসে। বাংলার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়ের যা কিছু অর্জন তাকে রক্ষা করতে সমস্ত বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে নতুন পর্বের লড়াই তুলতে হবে। সেই লড়াইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হলো আত্মসমীক্ষা করা— নিজেদের ভুলগুলি নির্মোহভাবে খুঁজে বার করা। বামপন্থার ঝান্ডা নিয়ে তারূণ্যের বাহিনীকে এই সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকতে হবে।