বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

করোনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

করোনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

সম্পাদকীয়, ১লা এপ্রিল, ২০২০

photo

করোনা ত্রাসে কাঁপছে সারা বিশ্ব, আমাদের দেশও। দেশে দেশে মানুষরা লকডাউন ও আতঙ্কের কারণে গৃহবন্দি। বন্ধ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, খেলাধুলা, বিনোদন, ধর্মীয় সমারোহ। পিছিয় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে অলিম্পক্স গেম। সমস্ত আন্তর্জাতিক উড়ান বাতিল। বিশ্ব জুড়ে এক দেশ থেকে আর এক দেশে মানুষের চলাচল ও পণ্য চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসকে ‘মহামারি’র হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বায়নের পৃথিবী এখন আর ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ নয়, পরস্পর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, গৃহবন্দি। আপনি বাচলে বাপের নাম, এই মন্ত্র জপা হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। যে উন্নত দেশগুলি দুনিয়াকে লুঠ করে উদারিকরণের সুফল ভোগ করেছে তারাই সর্ব প্রথম দুনিয়ার জন্য নিজের দরজা-জানালা অমানবিক ভাবে বন্ধ করেছে। করোনার ভাইরাসের আক্রমণ প্রথম আছড়ে পড়ে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। চীনের পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। এখন মারণ ভাইরাসের ‘এপিসেন্টার’ হয়ে উঠেছে ইউরোপ। ইউরোপীয় মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে মারণ ভাইরাস। সংক্রমিতের তালিকার শীর্ষে এখন আমেরিকা— ১২ লক্ষ ছাপিয়ে গেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা। ইতালিতে মৃত্যুর সংখ্যা চীনকে বহু পিছনে ফেলে ১৩ হাজার। চীনে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০৫। স্পেনে মৃত্যু সংখ্যা ৯৩০০। ইরানে মৃত্যু ৩০০০। ফান্সে মৃত্যু ৪০০০। আমেরিকায় মৃত্যু ৫১০০। ইংল্যান্ডে মৃত্যু ২৩০০। জার্মানিতে মৃত্যু ৯৩১। করোনা ত্রাসে কাঁপছে উন্নত বিশ্বে। চীন যখন করোনার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই গড়ে তুলছিল তখন আমেরিকা ও উন্নত বিশ্ব সহমর্মিতায় তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং নিজ নিজ দেশে এই মারণ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা প্রতিরোধে সাবধানতা, সতর্কতার বদলে এই দুর্যোগকে ব্যবহার করেছে চীন বিরোধী প্রচারে। তখনো আমেরিকা ও উন্নত বিশ্ব জানতো না তাদের দিকেই নেমে আসছে করোনা মহামারির সুনামী। লকডাউন করে একটা গোটা প্রদেশকে গৃহবন্দী করায় চীনা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে উন্নত বিশ্বে। লকডাউনের সিদ্ধান্ত আসলে নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারকে সংকুচিত করা। কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এটা হতে পারে না। চীনে একনায়কতন্ত্রী-একদলীয় শাসন বলেই এটা সম্ভব। যদিও লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণকে বাগে আনার চীনা পদ্ধতি কার্যকরি বলে স্বীকৃত হয়েছে করোনা আক্রান্ত বিশ্বে। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ভারত সেই চৈনিক পথই গ্রহণ করেছে। চীনের সঙ্গে উন্নত দেশগুলির পার্থক্য হলো— চীনা সরকার ৫ কোটি মানুষকে প্রায় দু’মাসের জন্য গৃহবন্দি থাকার নির্দেশ দিয়েই নিশ্চুপ ছিল না— যুদ্ধকালীন তৎপরতায় গৃহবন্দি সমস্ত মানুষের জন্য খাবার প্যাকেট পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। প্রাথমিক পরীক্ষা থেকে হাসপাতালের চিকিৎসা সব কিছু বিনামূল্যে দেওয়ার নীতি ঘোষণা করে। চীনা সরকার জনস্বাস্থ্যে ভরতুকি দেয় ১১০ বিলিয়ন ইউয়ান। ভারতীয় টাকায় যার পরিমাণ ১ লক্ষ ১৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সরকারের এই নীতির জন্য বেশি বেশি সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করা হয়েছে। আক্রান্তদের চিহ্নিত করে চিকিৎসা করা গেছে। সংক্রামিত রোগীদের বাঁচাতে মাত্র ১০ দিনে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল তৈরির কাজ সম্পন্ন করেন ৬ হাজার নির্মাণকর্মী ও ইঞ্জিনিয়ার। এই অবিশ্বাস্য নির্মাণের মূল দায়িত্বে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চায়না কনস্ট্রাকশন থার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো। রাতারাতি গড়ে তোলা হয় ১৬টা অস্থায়ী হাসপাতাল— যে গুলির শয্যা সংখ্যা ৫৬০০। পিপলস লিবারেশন আর্মির ১২০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠানো হয় উহানের স্থানীয় চিকিৎসক, চিকিৎসা-কর্মীদের সাহায্য করতে। ভাইরাস আক্রমণের আগে চীন তৈরি করত গোটা দুনিয়ার মাস্কের মোট চাহিদার অর্ধেক। দিনে ২ কোটি। এখন তৈরি করছে দিনে ১১ কোটি ৬০ লক্ষ। নিজের দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সংক্রমিত বিশ্বের চাহিদা মেটাতে মাস্ক, গ্লাভস, সংক্রমণ প্রতিরোধক পোষাক, চিকিৎসা সরঞ্জাম, পরীক্ষার কিট, ওষুধ অক্লান্ত ভাবে কাজ করছে চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি। চীনে এ পর্যন্ত ৮১,৩৪০ জন মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন— সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে ইতিমধ্যেই তার মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৭৪,৫৮৮ জন। করোনা মোকাবিলায় চীনের তৎপরতাকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এটা সম্ভব হয়েছে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত চীনা আধুনিক গণ-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং উন্নত মানবিক দায়বদ্ধতার কারণে। চীন পারে, ভিয়েতনাম-কিউবা পারে। কিন্তু করোনার কালান্তক আক্রমণকে মোকাবিলা করতে হিমসিম খেয়ে যায় উদারনীতির পথে চলা আমেরিকা, ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলি— যারা নিজ নিজ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ক্রমেই বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্য ছেড়ে দিয়েছে। যাদের অর্থনীতির লক্ষ্যই হলো মুনাফা, আরও মুনাফা, কেবল মুনাফা। সাধারণ ও গরীব মানুষের জীবনের দাম সেখানে কানাকড়ি। এই পরিস্থিতিতেও ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন জারি রেখেছেন অমানবিক অর্থনৈতিক অবরোধ। যার ফাঁক গলে পৌঁছতে পারছে না ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিষেধক ওষুধপত্র, মাস্ক ইত্যাদি। কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। চীনা রেডক্রস ইরানে পাঠিয়েছে কয়েক লক্ষ মাস্ক ও অন্যান্য প্রতিষেধক। সেদেশে গিয়েছেন চীনের পাঁচ জন ভাইরাস প্রতিরোধ-বিশেষজ্ঞ। মানবিকতার মহান আদর্শে করোনা বিধ্বস্ত ইতালিতে চিকিৎসা করতে গেছেন কিউবার ৫২ জনের চিকিৎসক এবং নার্সদের একটি দল। চীনের চিকিৎসক, নার্সদের দলও পৌঁছে গেছেন ইতালিতে। চীন যখন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মরণপন লড়াই চালাচ্ছিল; কিউবা, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া যখন সংক্রমণ প্রতিরোধে পরীক্ষা ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থাকে জোরালো করে তুলেছে, তখন উন্নত বিশ্বের মতোই ভারত সরকার যেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল, কোনও রকম প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নেয় নি। বিশ্ব সংক্রমণের প্রায় দু’ মাস পরে হঠাৎই যেন জেগে উঠে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক দিনের ‘জনতা কার্ফু’ এবং তারপর ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা যেখানে বলছে, লকডাউনই যথেষ্ট নয়, করোনা প্রতিরোধের চাবিকাঠি হলো “টেস্ট, টেস্ট অ্যান্ড টেস্ট”। পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সংক্রমিতকে চিহ্নিত করো, সংক্রমিতকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করে দ্রুত চিকিৎসা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করো। আমাদের দেশও ইউরোপ-আমেরিকার মতোই উদারনীতির রাস্তায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্রুত বেসরকারিকরণ করে চলেছে। সরকারি বা গণ-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেটুকুও ছিল তার সর্বনাশ করা হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীব সাধারণ মানুষের কাছে আধুনিক চিকিৎসা ধরাছোঁয়ার বাইরে। করোনা প্রতিরোধের প্রতিটি স্থরে এদেশ ও রাজ্যের অপ্রতুল স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর দৈন্যতা প্রকট ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে— প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ব্যবস্থা, পরীক্ষার সরঞ্জাম, কিট, ভাইরাস প্রতিরোধক মাস্ক, গ্লাভস, পোষাক, স্যানিটাইজার, আইসোলেশন ওয়ার্ড, ভেন্টিলেটর, হাসপাতাল, চিকিৎসক ও চিকিৎসা-কর্মীর অভাব করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কঠিন করে তুলছে। কিন্তু গৃহবন্দি মানুষ খাবে কি? তাদের কাছে খাবার পৌঁছবে কি করে? তাদের রুজির কি ব্যবস্থা কি হবে? ইতিমধ্যেই ২৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই রাজ্যের লকডাউনে গৃহবন্দি দিন আনি, দিন খাই মানুষেরা কঠিন পরিস্থিতির মুখে। হাতে থাকা বা ঘরে জমানো টাকা প্রায় নিঃশেষ। বাজারে খাদ্যদ্রব্য সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম ইতিমধ্যেই একটু একটু করে বাড়তে শুরু হয়ে গিয়েছে। এমন কি ওষুধও বহু জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেন, ট্রাক বন্ধ থাকায় সরবরাহ বিঘ্নিত হতে শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও আশ্বাস অনেকটাই কথার কথা থেকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই অনাহারে মৃত্যুর কথা জানা গেছে। ১১ বছরের রাহুল মুসাহর মৃত কিশোরের নাম। পরিযায়ী শ্রমিকেরা এই মূহুর্তে সবচেয়ে বিপদের মুখে। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার সংখ্যায় শিশু, পরিবার সহ শত শত মেইল ভুখা পেটে হেঁটে গ্রামে ফিরছেন। হাজার হাজার মানুষ রাজধানী দিল্লি সহ বিভিন্ন শহর থেকে বাড়ি ফেরার জন্য ভীড় করছেন।– এতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বিপদ বাড়ছে। দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কী, কেউ জানে না। দেশ ও বিশ্ব দুর্ভিক্ষের দোরগোড়ায়। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ভারতে তিন সপ্তাহের করোনা লকডাউনে ক্ষতির পরিমাণ ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতীয় মূদ্রায় যার পরিমাণ ৯ লক্ষ কোটি টাকা। যা আবার এদেশের জিডিপি-র ৪ শতাংশ। বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ হবে আরও অনেক বেশি। এই অবস্থায় দেশের অর্থমন্ত্রী মাত্র ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার করোনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় যথসামান্যই। একটা ছোট রাজ্য কেরালা করোনার গ্রাস থেকে রাজ্যবাসীকে বাঁচাতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করতে দ্বিধা করে না। কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের ৭.৭৮ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করতে কার্পণ্য করেনি। কিন্তু সাধারণ দেশবাসীর জন্য অর্থ ব্যয়ে শাসকদের হাত কাঁপে। এই লকডাউন অর্থনৈতিক মন্দায় নাজেহাল দেশকে আরও গভীর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। সুতরাং দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে করোনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে চালাতেই আগামী দিনে আরও কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানসিক ও কার্যকরি প্রস্তুতি নিতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.