বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

অতিমারির সঙ্গে ইয়াস: আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে

অতিমারির সঙ্গে ইয়াস: আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে

সম্পাদকীয়, ১ জুন, ২০২১

photo

অতিমারি ও লকডাউন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল অসাম্য পীড়িত এই সমাজ কতটা অমানবিক হতে পারে। কাজ হারানো লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী ও তাদের পরিবারের ঘরে ফেরার মর্মান্তিক চেষ্টা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ক্লান্তিতে পথিমধ্যে চিরতরে লুটিয়ে পড়া, রেল লাইনে বা পথেই অকাতরে মৃত্যু বুঝিয়ে দিয়েছিল— ব্যবস্থা হিসেবে ধনতন্ত্র শ্রমজীবীদের প্রতি কতটা নির্দয়। যে শ্রমজীবীদের শ্রম লুঠ করে কর্পোরেট সাম্রাজ্য ফুলেফেঁপে ওঠে এবং গৌতম আদানি, মুকেশ আম্বানি ও রতন টাটাদের মতো অতিধনীদের সম্পদের পাহাড় আরও স্ফিতকায় হয়, সেই শ্রমজীবীদের ঠেলে দেওয়া হয় অন্ধকারের অতলে।
সামান্য চিকিৎসার অভাবে করোনা সংক্রমণে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় এই সংকট আরও ভয়াবহ ভাবে সামনে এসেছে। হাসপাতালে বেড নেই, অক্সিজেনের সরবরাহ নেই, প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী ওষুধের যোগানের অভাব, টীকার জন্য দীর্ঘ লাইন, টীকা নিয়ে অবাধ মুনাফা কামানোর আয়োজন। নয়া উদারনীতির পর্বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঢালাও বেসরকারিকরণ, সরকারি হাসপাতালগুলির অপ্রতুল পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য খাতে অকিঞ্চিতকর ব্যয় বরাদ্দ, গোটা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বীমানির্ভর করে তোলার পরিণতিই এই মৃত্যু মিছিল। মোদি সরকারের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ বা তৃণমূল সরকারের ‘স্বাস্থ্য সাথী’ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের মুনাফা কামাবার ব্যবস্থা। সরকারি বীমা প্রকল্পে নথিভুক্ত থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলি কোভিড আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা করতে অস্বীকার করছে।
অতিমারির পরিস্থিতিতে আমফান ও ইয়াস মতো ঘূর্ণিঝড় মানুষের অসহায়তাকে বাড়িয়ে তুলছে। ইয়াস ঘূর্ণিঝড় বাংলার এক বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষত পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার সমুদ্র উপকূলবর্ত্তী এলাকাগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের শিকার হয়েছেন। বহু এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে। বহু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। বহু মানুষ নিরাশ্রয় হয়েছেন। কত মানুষের ঘর-বাড়ি ভেঙে গেছে, কত গবাদি পশু ধ্বংস হয়েছে, কত মৎসচাষিদের নৌকা ভেঙে গেছে, কত হেক্টর চাষের জমি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে বা কত জমিতে লবণাক্ত জল ঢুকে চাষের অনুপযুক্ত হয়ে গেছে— তার হিসেবনিকেশ এখনও হয়ে উঠেনি। তবে এই ঘূর্ণিঝড় বিপুল সংখ্যক মানুষকে বড় ক্ষতির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দুর্গত মানুষ খাদ্য, পানীয় জল, চিকিৎসা ও উপযুক্ত আশ্রয়ের অভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখে।
এই অবস্থায় অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বাম ছাত্র-যুবরা প্রশংসনীয় ভাবে অতিমারি আক্রান্ত মানুষের সাহায্যে এবং ঘূর্ণিঝড় প্লাবিত এলাকায় ত্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। গত বছর লকডাউনে ও আমফানের সময়ও তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সংকট এত সর্বগ্রাসী ও বহুমাত্রিক যে বিধ্বস্ত মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। সমস্ত মানুষকে বিনা মূল্যে টীকা দেওয়া, হাসপাতালে বেড বাড়ানো, অক্সিজেন ও জীবনদায়ী ওষুধ সরবরাহ থেকে আরম্ভ করে ঘূর্ণিঝড় পীড়িত মানুষকে আশ্রয়, খাদ্য, পানীয় জল, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারের এবং সরকারকেই নিতে হবে। সুন্দরবন ও সমুদ্র-নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে ঝড়-বন্যা প্রতিরোধে আশু ও দীর্ঘমেয়াদী বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা কার্যকরি করতে হবে সরকারকেই। কর্পোরেট ও ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের স্বার্থের সেবা করা এবং আত্মনির্ভরতার মিথ্যে গরিমা প্রচার বন্ধ করে সরকারকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য কার্যকরি ভূমিকা নিতে হবে। বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেছে এক মাস। তবুও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ মূলক আচরণ চলছেই। বন্ধ করা হোক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিরোধী ভূমিকা। বন্ধ করা হোক রাজনৈতিক দ্বৈরথ। বন্ধ হোক রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর হামলা ও হিংসার ঘটনাগুলি।
কিন্তু কেন এই বছর বছর ঝড়-বন্যা? মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং প্রশ্ন করেছেন, গত বছর আমফানের পর সুন্দরবনে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভের চারা লাগানোর কী হয়েছে। বাঁধ মেরামতির কি হলো। অভিযোগের তীর দলত্যাগীদের বিরুদ্ধে। জনসাধারণের সজাগ তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে পারলে এসব অনাচার বন্ধ করা সম্ভব।
কিন্তু সমস্যাটা অনেক গভীরে। ঝড়-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অস্বভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠার কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন। উষ্ণায়নের ফলে মেরু এলাকা ও হিমালয়ের মতো পর্বতের বরফ দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে। সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে উঠছে। তাপপ্রবাহ ও ঘুর্ণিঝড় বেড়েই চলেছে।
সভ্যতার যাত্রা পথে মানুষ ক্রমেই প্রকৃতির ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে। অরণ্য ধ্বংস করে বানিয়েছে কৃষিক্ষেত্র ও নগর, বৃহদায়তন শিল্প নির্গত গ্রীন হাউস গ্যাস পরিবেশকে দূষিত করে চলেছে, নদীপথ পরিবর্তন করে নির্মাণ করা হয়েছে অতিকায় বাঁধ। সমুদ্র উপকূল ও জলাভূমিতে নির্মাণের বিধিনিষেধ ক্রমেই শিথিল করা হয়েছে। এ সমস্ত কিছুই প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ধ্বংস করছে।
অরণ্য ধ্বংস করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করার ফলে মেসোপটেমিয়া, গ্রীসের মতো প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ধনতন্ত্রের অগ্রগতির পথে প্রকৃতির উপর নির্বিচারে হামলা তীব্র থেকে তীব্র হয়েছে। নয়া উদারনীতির পর্বে অরণ্য, পর্বত, খনি, নদী, সমুদ্র, সমুদ্র উপকূল, কৃষি জমি সমস্ত কিছুই লগ্নি পুঁজির লোলুপ রসনার বস্তু। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ দেশ পৃথিবীর ৫০ শতাংশ গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে।
আজ থেকে বহু বছর আগে ১৮৮৩ সালে অসমাপ্ত ‘ডায়লেক্টিস অফ নেচার’ গ্রন্থে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস আলোচনা করেছিলেন— মুনাফার লোভে ধনতন্ত্র ও পুঁজিপতি শ্রেণী সমগ্র সমাজকে সমূহ ধ্বংসের দিকে চালিত করছে। তারা জানে না এই ধ্বংসাত্মক গতি কি করে রুদ্ধ করা যায়। মোদ্দা কথায়, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করতে পুঁজি যেমন অক্ষম, তেমনই প্রকৃতি ও সমাজের পরিবেশের উপর চাপিয়ে দেওয়া ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম।
এই গভীরতর বিষয়ে মনোযোগ দিয়েই মানুষকে করণীয় কর্তব্য ঠিক করতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.