বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১— স্বাধীনতার ৭৫ বছরে, অতিমারি ও লকডাউনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার রেল, প্রতিরক্ষা, কয়লা, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, ব্যাঙ্ক-বিমা থেকে কৃষিক্ষেত্র সহ দেশের প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো একের পর এক চরম জনবিরাধী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে। এ হল স্বাধীনতা থেকে কর্পোরেটের অধীনতার দিকে গোটা দেশের এক বিরাট বিপরীত যাত্রা।
রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি প্রকল্পের এক গালভরা নামও দিয়েছে কেন্দ্র — ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন। যে পাইপলাইন দিয়ে গত সাড়ে সাত দশক ধরে জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে তোলা অর্থনীতি ও পরিকাঠামোর যা কিছু নির্মাণ, তা সাইফন হয়ে চলে যাবে দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের মুনাফার ভাণ্ডারে — ইতিমধ্যেই অতিমারির সময়কালে যা অনেকটাই স্ফীত হয়েছে।
সরকার বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করে ৬ লক্ষ কোটি টাকা নগদ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে এবং বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিকাঠামো ‘উন্নয়নের’ পরিকল্পনা পেশ করেছে। ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’ ও জনগণের সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার এই পদক্ষেপ নির্লজ্জ দেশদ্রোহিতা। এর আগে কোনও সরকার এমন বেপরোয়াভাবে কর্পোরেট শক্তির সেবা করেনি।
বিক্রির তালিকায় অগ্রাধিকারে আছে রাস্তা, রেলপথ এবং বিদ্যুৎ পরিকাঠামো। ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটির ২৬ হাজার ৭০০ কিমি জাতীয় সড়ক বিক্রি করা হবে ১.৬ লক্ষ কোটি টাকায়। ৪০০ রেলস্টেশন ও ১৫০টি ট্রেন বিক্রি করা হবে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকায়। পাওয়ার গ্রিড ট্রান্সমিশনের ৪২ হাজার ৩০০ কিমি বিদ্যুৎ লাইন বিক্রি করা হবে ৬৭ হাজার কোটি টাকায়। এনএইচপিসি, এনটিপিসি, নেভেলি লিগনাইটের জল, সৌর এবং বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি বিক্রি করা হবে ৩২ হাজার কোটি টাকায়।
সরকার যখন কর্পোরেট স্বার্থে এই জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, ঠিক সেই সময় রাজধানী দিল্লির সিঙ্ঘু সীমানায় সংযুক্ত কিসান মোর্চার ডাকে ৩০০টির বেশি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুব, মহিলা সংগঠনের দু’হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি দু’দিন ব্যাপী এক কনভেনশনে মিলিত হয়েছিলেন কেন্দ্রের হামলার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সংগ্রামের রণনীতি নির্ধারণ করার জন্য। কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ ক্রমশ হয়ে উঠছে সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর, ছাত্র-যুব-মহিলা সহ সমাজের নানান স্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বৃহত্তর মঞ্চ।
কনভেনশন সর্বসম্মতভাবে কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিল সহ শ্রমিক-কৃষক ও জনসাধারণের নানা দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন তীব্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনের ১০ মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের ডাক দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে ৫ সেপ্টেম্বর এযাবৎকালের বৃহত্তম প্রতিবাদী সমাবেশ সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়েছে। দেশের সমস্ত গ্রামে উত্তাল আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কনভেনশন সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে এবং দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সরকারি ক্ষেত্রকে কর্পোরেট ও বহুজাতিক সংস্থার কাছে বিক্রির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক পাঠিয়েছে।
কনভেনশনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সরকার দেশের কৃষক সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। নয়া কৃষি আইন আসলে দেশের কৃষি, কৃষিপণ্য বিপণন সহ সমগ্র কৃষি বাণিজ্যকে কর্পোরেট ও বহুজাতিক সংস্থার মুনাফার স্বার্থের কাছে বিকিয়ে দেওয়ার নকশা। যার ফলে কৃষক ঋণের ফাঁদে আরও জড়িয়ে পড়বেন, কৃষক আত্মহত্যা বাড়বে, জমি থেকে উচ্ছেদ বাড়বে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ধ্বংস হবে। জীবন-জীবিকার উপর নেমে আসবে ভয়ংকর বিপদ।
কিন্তু এই আক্রমণ কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকের ওপরেই সীমাবদ্ধ নয়। সরকার দেশের সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। দেশের সম্পদ, যা দিয়ে দেশের প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার কথা, যা দেশের মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবিকার নিশ্চয়তার এক একটি স্তম্ভ, সেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও পরিকাঠামো— রেলওয়ে, পাওয়ার ট্রান্সমিশন লাইন, প্রাকৃতিক গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিকম, ব্যাঙ্ক-বিমা সবই তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। ৪টি শ্রম কোডের মাধ্যমে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের উপর হামলা নামিয়ে আনা হয়েছে। দরিদ্রদের কল্যাণ ও সেবা ক্ষেত্র, গণ বন্টন ব্যবস্থা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত। সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। সুতরাং এই লড়াই শুধু কৃষকদের স্বার্থে নয়, এই লড়াই শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব-মহিলা সহ দেশের অগণিত মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। কৃষক আন্দোলন দেশবাসীকে সংগ্রামে উঠে দাঁড়াতে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বর্বর হামলা, কুৎসা, অপপ্রচার দিয়ে এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায়নি। এই আন্দোলন ধর্ম, বর্ণ এবং অঞ্চল নির্বিশেষে মানুষকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে এবং কর্পোরেট লুট থেকে মুক্ত, আত্মনির্ভর গণতান্ত্রিক ভারত গঠনের সংগ্রামে সবচেয়ে নিপীড়িত অংশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে।
হরিয়ানার কারনালে পুলিশের লাঠিচার্জে নিহত প্রতিবাদী কৃষক সুশীল কাজলের রক্ত বৃথা যাবে না। এই আত্মহুতি আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেবে।