বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ অক্টোবর, ২০২১— মোদি সরকারের বিভাজনের ক্রুর নীতি এবং কর্পোরেট অভিমুখী বেপরোয়া সংস্কারের গতিরোধ করতে দেশের বিরোধী দলগুলি যখন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে সেই সময় দেশবাসীর সামনে আশার আলোর ঝলক এনে দিয়েছে কৃষক আন্দোলন।
আজ থেকে ১০ মাস আগে রাজধানী দিল্লীর সীমান্তে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার এবং ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার দাবিতে কৃষকদের আন্দোলনকে কর্পোরেট স্বার্থবাহী শাসকরা বর্ণনা করেছিলেন, এই আন্দোলন নিছক পাঞ্জাব-হরিয়ানার ধনী কৃষক ও বিচোলিদের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আন্দোলন। সরকার দেশের ৮০ ভাগ কৃষকের পক্ষে— সে কারণে বিরোধীদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও তিনটি কৃষি আইন পাশ করেছে।
কিন্তু বাস্তবে এই ১০ মাসে পাঞ্জাব-হরিয়ানার ভৌগলিক সীমানা পেরিয়ে কৃষক আন্দোলন ছাড়িয়ে পড়েছে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে— পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখন্ড, হিমাচলপ্রদেশ, এমনকি জম্মুতেও; দক্ষিণে মহারাষ্ট্র, কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশে; পূর্বে বিহার, ঝাড়খন্ড থেকে সন্ত্রাসবিদ্ধ পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরায়। কৃষক আন্দোলন এক জাতীয় চরিত্র নিয়েছে। পাঞ্জাব-হরিয়ানার পর কৃষক আন্দোলনের তৃতীয় রণাঙ্গন এখন পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ।
দেশের নানান প্রান্তে কৃষক সমাজের প্রায় সমস্ত স্তর— ধনী কৃষক থেকে মাঝারি কৃষক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক— মোদি সরকারের কৃষিনীতির বিরুদ্ধে ক্রমেই আন্দোলনে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকরাও। মোদি সরকারের বিভাজনের নীতিকে বানচাল করে দিয়ে এই আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন জাতিবর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-জাঠ সকলে। কৃষিজীবী পরিবারের মহিলা, ছাত্র-যুবরা এই আন্দোলনের বড় শক্তি। সত্যিই এ এক কৃষক জাগরণ। সংযুক্ত কিসান মোর্চা হয়ে উঠেছে কৃষক আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ। ২৭ সেপ্টেম্বর কৃষক আন্দোলন আরও একবার মোদি সরকারকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
ভারতের ইতিহাসে বার বারই দেখা গেছে যখন যখন কৃষক আন্দোলন রাষ্ট্রশক্তি ও শাসকদের চ্যালেঞ্জ করেছে তা বৃহত্তর জনসমষ্টির সমর্থন আদায় করে নিয়েছে এবং মহান পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু হিসাবে কাজ করেছে। ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীন ভারত তারই সাক্ষ্য বহন করছে।
শাসকের সমস্ত রকম দমন, কুৎসা, অপপ্রচার সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলন ক্রমশ শক্তি সংগ্রহ করছে, বেগবান হয়ে উঠছে— সাড়া দেশের শ্রমজীবী মানুষের অনুপ্রেরণা ও আশা-ভরসার কারণ হয়ে উঠেছে। সেই কারণেই কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ হয়ে উঠেছে দেশের শ্রমিক-কর্মচারী, ছাত্র-যুব, মহিলা, ছোট ব্যবসায়ী থেকে সমস্ত প্রতিবাদী ও গণতান্ত্রিক মানুষের আন্দোলনের মঞ্চ। সে মঞ্চ থেকেই ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধের আহ্বান করা হয়েছিল। কৃষক আন্দোলনকে সংহতি জানানোর সঙ্গেসঙ্গে নিজ নিজ দাবি নিয়ে শ্রমিক-কর্মচারী, ছাত্র-যুব, মহিলারা দেশব্যাপী ধর্মঘট, অবরোধ, বিক্ষোভ, মিছিলে সামিল হয়েছেন।
মোদি সরকারের বিজয়রথের সামনে পরাজিত, হতোদ্যম, নানান সংকীর্ণ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থে বিভাজিত বিরোধী দলগুলিকেও উজ্জীবিত করেছে চলমান কৃষক আন্দোলন। বামপন্থীরা কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নির্ভরযোগ্য শক্তি প্রথম থেকেই। সারা দেশে বনধ সফল করতে বামপন্থী দলগুলির সক্রিয়তা সকলেই লক্ষ্য করেছেন। রাজ্যে রাজ্যে তারতম্য থাকলেও কংগ্রেস এই বনধ সফল করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানায় বনধ ১০ ঘন্টা রাস্তা রোকো ও ট্রেন অবরোধে সর্বাত্মক রূপ নিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় এবং আপ বনধ সমর্থন করায় দিল্লিতেও বনধের প্রভাব পড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কেরালায় শাসক এলডিএফ ও বিরোধী ইউডিএফ প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষই সমর্থন করায় সেখানে বনধ সর্বাত্মকভাবে সফল হয়েছে। মহারাষ্ট্রে কৃষক সংগঠনগুলি এবং বাম-কংগ্রেসের তৎপরতায় বনধের প্রভাব পড়েছে যথেষ্ট। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানায় তেলাগু দেশম, বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল, ঝাড়খন্ডে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা বনধ সমর্থন করেছে। এই সমস্ত রাজ্যে বনধ সফল করতে বামপন্থী দলগুলির সক্রিয়তা সকলের নজর কেড়েছে এবং বনধের ভাল প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। ভোটে পিছিয়ে না পড়তে একেবারে শেষ মুহুর্তে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টিও বনধ সমর্থন করেছে। কর্ণাটক, উড়িষ্যা, পশ্চিমবাংলা ও ত্রিপুরায় কৃষক সংগঠনগুলি এবং বামপন্থী দলগুলি রাস্তা রোকো, ট্রেন অবরোধ, মিছিল করে মোদি সরকারের দেশবিরোধী নীতির প্রতিবাদ করেছেন।
কিসান মোর্চার শীর্ষ নেতা রাকেশ টিকায়েত বাংলার নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জীকে সমর্থন জানিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলির ডাকা ভারত বনধের দিনে তৃণমূল দল সযত্নে বনধ সমর্থন করা থেকে বিরত থাকলেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল কর্পোরেটদের কাছে তাদের বনধ বিরোধী নৈতিক অবস্থানকে আরও একবার জানান দিয়ে রাখলেন।
২৭ সেপ্টেম্বরের বনধের সাফল্য মোদি সরকারের বিভাজনের নীতি এবং কর্পোরেটের স্বার্থবাহী আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী জনগণের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছে। যে ঐক্যবদ্ধ মঞ্চের অভিমুখ হবে কর্পোরেট লুন্ঠন মুক্ত, বিভাজনের বিদ্বেষ মুক্ত, গণতান্ত্রিক ভারত গড়ে তোলা। তবে যেতে হবে আরও বহু পথ।