বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

শ্রমিক-কৃষকের জীবন জীবিকার এজেন্ডা

শ্রমিক-কৃষকের জীবন জীবিকার এজেন্ডা

সম্পাদকীয়, ১ অগাস্ট, ২০২৫

photo

ভারত এক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। এই বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের নানা ভাষা, ধর্ম, জাতি-জাতিসত্তা, বর্ণ, লোকাচার-সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্য রুচির বৈচিত্রের মধ্যে একতা ও বহুত্ববাদ আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। ভারতের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের অভিমুখ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আজ আক্রান্ত। সংবিধান নয়, মনুস্মৃতি বর্তমান শাসকদের কাছে দেশ চালনার আদর্শ। কেন্দ্রের শাসকেরা ভাষা, জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতির বৈচিত্রকে দুরমুশ করে ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান’ এর এক সর্বগ্রাসী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে জোট বেঁধেছে।
শাসকরা তাদের আধিপত্য কায়েম রাখতে ব্রিটিশ শাসকদের ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি অনুসরণ করছে। সারা দেশে ধর্মীয় মেরুকরণ, উগ্র হিন্দুত্বের চাষ, মুসলমানদের উপর নির্যাতন, তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া চলছেই। জাতি দাঙ্গার নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠেছে মণিপুর। দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রে বাংলা ভাষা বলার জন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ নেমে আসছে। তাদের ‘বাংলাদেশী’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হচ্ছে, সীমান্ত পার করে বাংলাদেশের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেকায়দায় পড়ে ফিরিয়ে নেওয়াও হচ্ছে।
সীমান্ত পার হয়ে ভিনদেশের মানুষদের ভারতে প্রবেশ আটকানোর দায়িত্ব সরকার ও বিএসএফ এর। সরকার এবং বিএসএফ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে ব্যর্থ।
কেন বাংলার লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়েরা কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন? এর উত্তর নেই রাজ্য সরকারের কাছে। ২৬ হাজার চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন, আরজিকর-এ চিকিৎসক কন্যার ভয়াবহ ধর্ষণ-হত্যা ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভয়া আন্দোলন, বকেয়া ডিএ-র দাবিতে রাজ্য সরকারি কর্মীদের আন্দোলনে জেরবার রাজ্যের শাসকরা বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের নির্যাতনের ঘটনাগুলিকে ইস্যু করে নিজেদের ব্যর্থতা ও অন্যায়কে আড়াল করতে চাইছেন। কেন্দ্রের শাসকরা উগ্র হিন্দুত্বের ভিত্তিতে মেরুকরণ করতে চেষ্টা করছেন আর এই রাজ্যের শাসকরা ভাষার ভিত্তিতে মেরুকরণ করতে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।
বিহারে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচন কমিশন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ এর প্রথম দফার কাজ শেষ করেছে। সংশোধিত ভোটার তালিকায় ‘স্থায়ী স্থানান্তরিত’ বলে ৩১ লক্ষ মানুষের নাম বাতিল করা হয়েছে। এরা অধিকাংশই পরিযায়ী শ্রমিক যারা কাজের খোঁজে অন্যত্র গেছেন। বিহার বিধানসভা নির্বাচনে জয় সম্পর্কে সংশয় থাকায় কেন্দ্রের শাসকরা তড়িঘড়ি ভোটার তালিকার সংশোধনের কাজে নামতে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করছেন।
বিহারের পর পশ্চিমবাংলাতেও ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। এরাজ্যের ভোটার তালিকা থেকে ‘রোহিঙ্গা’, ‘মুসলমান’, ‘অনুপ্রবেশকারী’দের বাদ দেওয়ার হুংকার শোনা যাচ্ছে। অবশ্য বিরোধী দলের নবনিযুক্ত রাজ্য সভাপতি বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান এক জোট হয়ে দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের অবসান করতে হবে। তিনি মুসলমান ভোটের একাংশ ঝুলিতে পুরতে চাইছেন। এটি কৌশল মাত্র। তিনি দাবি করেছেন, পশ্চিমবাংলায় দ্বি-মেরুকরণ অতি বাস্তব। কেন্দ্রের শাসকদলের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হচ্ছে রণনীতি। রাজ্যের শাসক দলের হাতিয়ার বাংলার অস্মিতা। যদিও তারা ইউসুফ পাঠান বা শত্রুঘ্ন সিনহা প্রার্থী করতে দ্বিধা করেননি।
শাসকদলগুলি নিজেদের এজেন্ডায় জনসাধারণকে সামিল ও বিভক্ত করতে চায়। বিকল্প হল শ্রমিক-কৃষকের জীবন জীবিকার এজেন্ডায় মেরুকরণ। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হল ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতৃত্বে দল-মত-পতাকার রঙ নির্বিশেষে কৃষক-ক্ষেতমজুরদের বহু সংগঠনের এক বছরের বেশি লাগাতার লড়াইয়ে পিছু হঠে কেন্দ্র সরকার — তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
৯ জুলাই দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটে শ্রম কোড বাতিল সহ বিভিন্ন দাবিতে সামিল হয়েছেন প্রায় ২৫ কোটি শ্রমজীবী। ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন নানা মত-পথের ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন। ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন সংযুক্ত কিসান মোর্চা। শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই ধর্মঘটে কেবল সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীরা নন, সামিল হয়েছেন গ্রাম-শহরের বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত শ্রমজীবী। ভারতের শ্রমশক্তির মোট সংখ্যা ৫০ কোটির ৫০ শতাংশ ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন। শ্রমশক্তির মাত্র ১০ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। যার অর্থ গ্রাম-শহরের অন্তত ২০ কোটি অসংগঠিত শ্রমজীবী ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন। একে পাথেয় করে আমাদের এগোতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.