বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ আগস্ট, ২০২২— গর্ভপাত আর নারীর আইনি অধিকার নয় আমেরিকায়। ২৫ জুন আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট পঞ্চাশ বছরের পুরোনো ১৯৭৩ সালের ‘রো বনাম ওয়েড’ রায় খারিজ করে দিয়ে জানিয়েছে যে, গর্ভপাতের বৈধতা-অবৈধতা নির্ণয় করবে প্রশাসন বা রাষ্ট্র। যে নারীর গর্ভপাত করা দরকার তাঁর নিজস্ব কোনও মতামত থাকবে না। রাষ্ট্র ঠিক করে দেবে আদৌ গর্ভপাতের কোনও প্রয়োজন আছে কি না। আমেরিকার মতো উন্নত দেশের এই পদক্ষেপ ভাবাচ্ছে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশসহ উন্নত বা উন্নয়নশীল অনেক দেশকেই। গর্ভপাতের আইন নিয়ে আমেরিকায় বেশ কিছু বছর ধরে চলছে নানা কথা, আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং সম্প্রতি সে দেশের শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছে, গর্ভপাত আর নাগরিকের জন্য সাংবিধানিক অধিকার থাকবে না। আমেরিকার যে কোনও স্টেট এ নিয়ে নিজের মতো আইন তৈরি করে নিতে পারে। পৃথিবীর অনেকগুলি দেশে যেমন, আফগানিস্থান, ভ্যাটিকান সিটি, পোল্যাণ্ড, কঙ্গো, মিশরের মতো দেশে গর্ভপাত বিরোধী আইন বলবৎ রয়েছে। এবার আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটেও একই রকম ঘটনা ঘটতে চলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। নাগরিকদের একাংশের অভিমত, গর্ভপাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হতে পারে একাধিক স্টেটে এবং এই কাজ অপরাধ বলেও বিবেচিত হতে পারে কোথাও কোথাও।
১৯৭৩ সালে ‘রো বনাম ওয়েড’ রায় গর্ভপাত বৈধকরণ আইনকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, যার ফলে নারীর অধিকার এবং সুরক্ষা দুই-ই রক্ষিত হয়। ২৫ জুন ২০২২ এর আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টের রায়, রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার শাখার প্রধান মিশেল বাচেলেটের মতে, “পাঁচ দশকের মার্কিন নারী সুরক্ষা সুপ্রীম কোর্টের এই রায়ে ধাক্কা খেলো, এই রায় নারীর মানবাধিকার, লিঙ্গসমতার উপর চরম আঘাত হানল।” আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই রায়কে সমালোচনা করে বলেছেন, “আজ সুপ্রীমকোর্ট শুধুমাত্র প্রায় ৫০ বছরের নজিরকে উল্টে দেয়নি, এটা রাজনীতিবিদ এবং মতাদর্শীদের ইচ্ছাকে তীব্রভাবে খারিজ করে দিয়েছে— লক্ষ লক্ষ আমেরিকানদের অপরিহার্য স্বাধীনতাকে আক্রমণ করেছে।” আমেরিকার বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এই রায়কে ‘দুঃখজনক ভ্রান্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। অপর দিকে আরেক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” অর্থাৎ সুপ্রীম কোর্টের একটি রায় সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ঝড় তুলেছে, অঙ্গরাজ্যগুলিতে (স্টেটস) শুরু হয়ে গেছে মিছিল-জমায়েত, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। ২৫ জুন তারিখেই সুপ্রীম কোর্ট চত্বরে বিভিন্ন সংগঠন এই রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। রায়টি আমেরিকার রাজনৈতিক মহলকে সম্পূর্ণভাবে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে। ৩১টি স্টেটে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হতে চলেছে। ওকলাহোমা, ফ্লোরিডা, কেন্টাকি, আরিজোনা, ইডাহো, ইওমিন্গ, আলবানা, আরকানসাস, জর্জিয়া প্রভৃতি স্টেটগুলিতে যেখানে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় রয়েছেন অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ সে সকল জায়গায় গর্ভপাত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। অপরদিকে ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, কলম্বিয়া, কানেক্টিকাট ইত্যাদি রাজ্যগুলি যেখানে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাধিক্য, সেইখানে ২৫ জুনের রায়ের বিপক্ষে সোচ্চার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। এমনকি বিভিন্ন রাজ্য থেকে মহিলারা ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসছেন গর্ভপাত করানোর জন্য। প্ল্যানড পেরেন্টহুড-এর সমর্থকরা এবং ১৯৭৩-এর গর্ভপাত আইনের সমর্থকেরা সমগ্র আমেরিকা জুড়ে আন্দোলনে নেমেছেন। ওয়াশিংটন, শিকাগো, নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলস, ডেট্রয়েট প্রভৃতি বড় বড় শহরগুলো প্রতিবাদ-আন্দোলনের ঢেউ এ উত্তাল হয়ে উঠেছে। মানুষ সোচ্চারে বলছেন, “আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত”। এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে যে, আমেরিকায় যদি গর্ভপাতের অধিকার নিষিদ্ধ হয়, তাহলে পরবর্তীকালে অভিবাসীদের অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং অন্যান্য অনেক অধিকারের উপর রাষ্ট্রীয় কোপ নেমে আসতে পারে।
গর্ভপাতের মতো একটি বিষয় যখন আইন করে নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্ঠা নেওয়া হয় তখন তা সামগ্রিকভাবেই আলোচনার এবং প্রতিবাদের বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহিলাদের শারীরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার ও সুরক্ষার প্রশ্ন। নারীর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনেও কখনও কখনও গর্ভপাত জরুরি হয়ে পড়ে। সমাজের নানা স্তরে নারীর ইচ্ছায় গর্ভপাত নিয়ে নানা ধরনের মতামত রয়েছে, যদিও নারীর শরীরের উপর নারীর অধিকারই শেষকথা হওয়া উচিত বলে মনে করেন সংখ্যাগরিষ্ঠ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষ। কী কারণে একজন নারী গর্ভপাত করাবেন তা একেবারেই তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন, এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা বা নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত নয়, তাহলে সমাজে নারীর অধিকার, আরও একটু সঠিকভাবে বললে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। আমাদের দেশে আজও কন্যাভ্রূণহত্যা একটি নিয়মিত অপরাধ। ভ্রূণের লিঙ্গনির্ধারক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ আইন বলবৎ করেও এই সামাজিক অপরাধ সম্পূর্ণ নিবারণ করা যাচ্ছে না। অথচ যদি কোনও নারী সিদ্ধান্ত নেন যে বিশেষ কোনও কারণে সে তাঁর আগত সন্তানটি ধারণ করবে না, এই বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনও অধিকার থাকবে না! কী আশ্চর্য সামাজিক ব্যবস্থা! বিভিন্ন কারণে গর্ভপাত করানোর প্রয়োজন হয় মেয়েদের। নাবালিকা বিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ, যা নারীর স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বাড়ছে ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণের সংখ্যাও। এই সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত মাতৃত্বের ক্ষেত্রগুলিতে গর্ভপাত অনেক সময় অনিবার্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও আছে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক অসুস্থতা বা অর্থনৈতিক সঙ্কট, সন্তান প্রতিপালনে আর্থিক অক্ষমতা ইত্যাদি যার ফলে অনেক সময় নারীকে বাধ্য হয়েই গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং এক্ষেত্রে একজন সুচিকিৎসকের পরামর্শই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য, কোনও রাষ্ট্রীয় চোখরাঙানী নিশ্চয়ই নয়। আইনগতভাবে, নারীর শারীরিক প্রয়োজনে গর্ভপাত যদি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, ভয় হয়, বিপথে, বেআইনিভাবে গর্ভপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, বেড়ে যাবে নারীর স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কাও।
একবিংশ শতাব্দিতে এসে নারীর সমানাধিকারের দাবিকে নস্যাৎ করে, নারীর এযাবৎকালে অর্জিত সব অধিকারকে খর্ব করে, নারীর অবমূল্যায়ন, নারীর অধিকার হননের শক্তি সারা বিশ্ব জুড়ে প্রকট হয়েছে, লিঙ্গবৈষম্যের রাজনীতি তার জাল ছড়িয়েছে দেশে দেশে, আমেরিকার ২৫ জুনের গর্ভপাত নিরোধক আইনটি তার একটি দৃষ্টান্তমাত্র। আমেরিকার মতো উন্নত দেশের এই আইন অন্যান্য অনেক দেশকেও প্রভাবিত করবে না তার নিশ্চয়তা কি? আমরা, ভারতবর্ষের মেয়েরা মনে করি, “আমার শরীর, আমারই অধিকার।” তাই সজাগ থাকতে হবে, আমেরিকা-অনুকরণপ্রিয় আমাদের সরকার যেন সমধর্মী কোনও আইন লাগু করতে না পারে। দুর্বল নারীস্বাস্থ্যের উপরে যেন উদ্যত না হয় রাষ্ট্রীয় খাঁড়া।