বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

বদলে যাওয়া পৃথিবীতে ট্রাম্পের আমেরিকা

বদলে যাওয়া পৃথিবীতে ট্রাম্পের আমেরিকা

সমুদ্র দত্ত

photo

১৮ অক্টোবর, ২০২৫। আমেরিকা জুড়ে বৃহত্তম বিক্ষোভের সাক্ষী হলেন বিশ্ববাসী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বৈরতান্ত্রিক-একনায়কতন্ত্রী নীতির বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রধান প্রধান শহর সহ ২,৫০০ এর বেশি শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষ ‘নো কিংস’ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় এটি ছিল দেশজুড়ে সর্ববৃহৎ আন্দোলন। ওয়াশিংটন ডিসি, নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, আটলান্টা এবং শিকাগোর মতো বড় শহর থেকে ছোট শহরগুলিতে বিপুল সংখ্যক প্রতিবাদী মানুষ বিক্ষোভে সামিল হন। লস অ্যাঞ্জেলেসের বিক্ষোভে প্রতিবাদী মানুষ অভিবাসীদের সমর্থনে আমেরিকা এবং মেক্সিকোর পতাকা বহন করছিলেন। এই শহরেই জুন মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশে ফেডারেল গার্ড মোতায়েনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এর আগে গত ১৪ জুন ‘নো কিংস’ বিক্ষোভে আমেরিকা জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
বিক্ষোভকারীরা ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সমতা, স্বাধীনতা এবং জনগণের অধিকারকে পদদলিত করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব ছাঁটাই করা, কঠোর অভিবাসন নীতি, ফেডারেল সেনা মোতায়েন, ‘শাট ডাউন’ (প্রায় ৯ লক্ষ ফেডারেল কর্মীকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। অতিরিক্ত ৭ লক্ষ কর্মী বেতন ছাড়াই কাজ করছেন।), জনশিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য ধ্বংস, বাইডেনের যুদ্ধ নীতির সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান তাঁরা — তাদের স্লোগান ছিল ‘কোনও রাজা নেই’।
***
বাইডেন জামানায় গাজ়া, ইউক্রেন সহ বিশ্ব জুড়ে আমেরিকার যুদ্ধ নীতির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান মার্কিন জনমতকে কাজে লাগাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং চলমান যুদ্ধগুলো শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতায় আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ করে ইউরোপে শান্তি ফেরাবেন। গাজ়া যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করবেন।
সমস্যা হল বারাক ওবামা, জো বাইডেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প বা আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’ মেনে নিতে পারেন না যে, পৃথিবীটা পাল্টে যাচ্ছে। আমেরিকার একাধিপত্য বা এক মেরু বিশ্বের অবসান ঘটেছে। বহুপাক্ষিক বিশ্বের বিকাশ ঘটেছে। চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোগে ব্রিকস অন্যতম অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক মঞ্চ হিসেবে উঠে এসেছে। মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আমিরশাহী, ইরান, ইথিওপিয়া সহ একের পর এক দেশ ব্রিকসের অংশীদার হচ্ছে। এই দেশগুলি ডলার নয়, নিজ নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য করছে। মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্য ভাঙছে। সেকারণে ট্রাম্প ভীষণ চটেছেন ব্রিকসের উপর। তিনি ব্রিকস সদস্য দেশগুলির উপর সব থেকে বেশি হারে শুল্ক চাপিয়েছেন। এছাড়া গড়ে উঠেছে সাংহাই কোঅপারেশন সংগঠন। তাতেও অংশীদার চীন, রাশিয়া, ভারত। গড়ে উঠেছে আফ্রিকান ইউনিয়ন। লাতিন আমেরিকার দেশগুলি গড়ে তুলেছে একাধিক মঞ্চ। ইউরোপ-আমেরিকার পুরানো উপনিবেশবাদী দেশগুলির কর্তৃত্বের বাইরে পারস্পরিক আর্থিক-বাণিজ্যিক-প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা যথার্থই বলেছেন, আমাদের কোনও সম্রাটের প্রয়োজন নেই — যে তার আদেশে পৃথিবীকে চলতে হবে। আমেরিকান জনগণের ‘রাজা চাই না’ বিক্ষোভের সুরের সঙ্গে মিলে যায় লুলার কথা।
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে আমেরিকা আর তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারছে না। চীন ও ভারতের মতো দেশগুলি অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করেছে। শিল্প সক্ষমতা ও প্রযুক্তির কোনও কোনও ক্ষেত্রে চীন আমেরিকাকে ছাপিয়ে গেছে। যেমন, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন, দূষণহীন ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদন, শূণ্য নির্গমন সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
বাস্তব হল, আমেরিকার অর্থনীতি অধোগতির দিকে চলেছে। সেই অর্থনীতির উপর ভর করে বিশ্বে একাধিপত্য করা সম্ভব না। ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ আমেরিকার জিডিপি ও জাতীয় ঋণের অনুপাত ছিল ১০০:১২৫ — জাতীয় ঋণ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে (জিডিপি) ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের ঋণ এক বছরে উৎপাদিত পণ্য ও পরিষেবার মোট মূল্যের চেয়ে বেশি। আমেরিকার ঋণ প্রতি ১০০ দিনে ১ ট্রিলিয়ন (১ লক্ষ কোটি) ডলার বেড়ে চলেছে। আমেরিকার অর্থনীতি ঋণের ফাঁদে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৭৮.৩ বিলিয়ন (৭,৮৩০ কোটি) ডলার। ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় বাণিজ্য ঘাটতি ৩০.৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন অর্থনীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা। মার্কিন সরকার ও বহুজাতিকগুলি অধিক মুনাফা ও সস্তা শ্রমের খোঁজে দেশে দেশে পণ্য উৎপাদন আউট-সোর্স করার ফল ভুগতে হচ্ছে তাদের।
ট্রাম্প যেন ২১ শতাব্দীর রাজা। অর্থনীতির এই হাল হকিকতের হিসেবে না রেখে বাণিজ্য ঘাটতির দায় পৃথিবীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। ২০২৪ সালে চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২৯৫.৫ (২৯,৫৫০ কোটি) ডলার। ট্রাম্প বলেছেন, ‘চীন আমাদের পথে বসাচ্ছে। আমরা তোমাদের উপর ২৪৫% আমদানি শুল্ক ধার্য করলাম।’ এতে চীনের রপ্তানি বাণিজ্য মার খাবে শুধু এমনটা নয়, মার্কিন বাজারে চীনা সস্তা পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্থ হবেন আমেরিকার ক্রেতারা। চীনও এই সম্ভাবনার কথা আগাম অনুমান করে ব্রিকস, সাংহাই কোঅপারেশন সংগঠন ইত্যাদি সংস্থার সদস্য ও সহযোগী দেশগুলির বিকল্প বাজার খুঁজে নিয়েছে। চীন পাল্টা আমেরিকার উপর ১৪৫% শুল্ক চাপালে আমেরিকা দ্রুত আপোষ রফা করে। দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে চীনা পণ্যে ৩৫% শুল্ক ধার্য করে আমেরিকা। কিন্তু চীন বিরল খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করলে ক্ষিপ্ত ট্রাম্প চীনের উপর আবার ১০০% শুল্কের হুমকি দিয়েছেন।
২০২৪ সালে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৫.৮ বিলিয়ন (৪,৫৮০ কোটি) ডলার। ট্রাম্প ভারতকে আদেশ দিচ্ছেন, তোমাদের অবশ্যই রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে হবে। রাশিয়ার সস্তা তেলের বদলে বেশি দামে মার্কিন তেল কিনতে হবে। না হলে আমরা তোমাদের কাছ থেকে ২৫% আমদানি শুল্ক এবং ২৫% জরিমানা আদায় করবো। তোমরা আমার কথা না শুনলে শুল্ক ১০০% করতে পারি। ভারতের বাজার বিপুল ভর্তুকি পাওয়া ও ‘জিনগতভাবে পরিবর্তিত’ আমেরিকার ভুট্টা, সোয়াবিন, দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য খুলে দিতে হবে। তাতে ভারতের কোটি কোটি কৃষক ও দুধ উৎপাদনের কাজে যুক্ত মহিলাদের সর্বনাশ হলে তার দায় তোমরা সামলাবে।
***
সোভিয়েতের পতনের পর প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির শীর্ষ নেতাদের কাছে শান্তি ও সমঝোতা চেয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, জার্মানি ন্যাটোভুক্ত হলে রাশিয়ার আপত্তি থাকবে না। কিন্তু ন্যাটো জার্মানির এক ইঞ্চি পূর্বে অগ্রসর হলে রাশিয়া তীব্র আপত্তি জানাবে। ন্যাটো যখন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে সদস্যপদ দিতে শুরু করে, তখন থেকে রাশিয়া তীব্র আপত্তি জানাতে থাকে। আমেরিকা ও পশ্চিমী শক্তি রাশিয়ার সীমান্তে ইউক্রেনে শাসন পরিবর্তন করে জেলিনেস্কিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বসায় এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার দিকে এগোয়। রাশিয়া এই ঘটনাক্রমকে তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর বিপদ হিসেবে দেখে। রাশিয়ার তরফে সমঝোতার সমস্ত চেষ্টা আমেরিকা, পশ্চিমী শক্তি ও জেলিনেস্কি উপেক্ষা করে। আমেরিকা, পশ্চিমী শক্তি জেলিনেস্কির ইউক্রেনকে দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করে এবং রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ঠেলে দেয়।
পশ্চিমের চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করতে ব্যর্থ হয়। রাশিয়া – চীন, ভারত সহ ব্রিকস দেশগুলিতে তেল-গ্যাস রপ্তানি করে অর্থনীতি সচল রাখতে সফল হয়। বিপরীতে, আমেরিকা ও ন্যাটোর যুদ্ধ নীতির ফলে ধ্বংসের মুখে ইউক্রেন। হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনা ও অসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ৫.৭ মিলিয়ন (৫৭ লক্ষ) দেশ ত্যাগ করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জেলেনেস্কির জবরদস্তি সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ককে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর নীতিতে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কামানের গোলা, যুদ্ধাস্ত্রের ঘাটতি মেটাতে ইউরোপ ও আমেরিকার কাছে আর বার হাত পাততে হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটাতে সমর্থ হয়েছে।
রাশিয়াকে বাগে আনতে ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় রুশ তেলের ওপর আরও বড় নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছেন। এবং ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার গভীর অভ্যন্তরে আক্রমণ করার অনুমতি দিয়েছেন। এখন দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়।
***
ইজ়রায়েলের গাজ়া যুদ্ধ পশ্চিমী গণতন্ত্রের প্রতারণার স্বরূপ বারবার উন্মোচিত করছে। ‘সর্বশক্তিমান’ আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলির অর্থ, সামরিক সাহায্য, গোয়েন্দা তথ্য, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মদতে ‘গণতান্ত্রিক’ ইজ়রায়েল দীর্ঘ দু’ বছর ধরে প্যালেস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে নির্বিচার গণহত্যা, শিশু ও নারী হত্যা চালিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ বন্ধ করে প্যালেস্তিনি জনগণকে গণঅনাহারের মুখে ঠেলে দিয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, নিকাশি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে গোটা প্রজন্মকে নিকেশ করার অভিযানে নেমেছে এই ‘গণতান্ত্রিক’ যুদ্ধবাজরা।
আমেরিকা যে ইজ়রায়েলের প্রধান মুরুব্বি বারবার প্রমাণ করেছে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে আমেরিকা ইজ়রায়েলের পাশে থেকে ৬ বার রাষ্ট্রসঙ্ঘে গাজ়ায় যুদ্ধ বিরতি, আন্তর্জাতিক ত্রাণ পাঠান, স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে। এবিষয়ে জো বাইডান ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার কোনও পার্থক্য নেই।
অবশ্য রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্প, নেতানিয়াহুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্যালেস্তিনিদের গাজ়া থেকে অন্যত্র সরে যেতে পরামর্শ দেন। ট্রাম্প বিস্ময় প্রকাশ করেন, ভূমধ্যসাগরের তীরে এই মনোরম জায়গায় পর্যটনের কেন্দ্র গড়ে তোলায় কেউ উদ্যোগ নেয়নি। তিনি নিজে এর জন্য উদ্যোগ নেবেন বলে জানান।
এই পরিস্থিতিতে নতুন করে যুদ্ধ বিরতি, বন্দি প্রত্যর্পণ এবং গাজ়ায় ত্রাণ পাঠানোর প্রস্তাব নিয়ে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় কাতার। আলোচনা ভেস্তে দিতে ৯ সেপ্টেম্বর ইজ়রায়েল কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় পাঁচজন হামাস সদস্য এবং একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন। কাতার এই হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। এবং যুদ্ধ বিরতির প্রধান মধ্যস্থতাকারীর ভুমিকা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। এই হামলা কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উপরও প্রভাব ফেলে।
কাতারে ইজ়রায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ১৫ সেপ্টেম্বর দোহায় আরব ও ইসলামি দেশগুলি জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়। আরব লীগ এবং ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার প্রায় ৬০টি সদস্যরাষ্ট্র এতে অংশ নেয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি এই হামলার তীব্র নিন্দা করে এবং কাতারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। যৌথ বিবৃতিতে ইজ়রায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানানো হয়। আরব ও মুসলিম দেশগুলি ইজ়রায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বার্তা দিতে সক্ষম হয়। এই বার্তা আমেরিকার ইজ়রায়েল নীতির বিরুদ্ধেও সতর্কতা।
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইজ়রায়েলের প্রধানমত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদিক সম্মেলন করে ইজ়রায়েল এবং হামাসের মধ্যে সংঘাতের অবসানের উদ্দেশ্যে তথাকথিত শান্তি প্রস্তাব পেশ করেন। ট্রাম্প হুমকি দেন হামাস যদি এই প্রস্তাবে সম্মত না হয়, অবশিষ্ট ইজ়রায়েলি পণবন্দিদের না ফেরত দেয়, অস্ত্র না নামিয়ে রাখে — তাহলে তাদের উপর নরক নেমে আসবে। এ এক নির্লজ্জ পক্ষপাত ও ঔদ্ধত্যের ধৃষ্টতা। যুদ্ধ অপরাধের নায়ককে সঙ্গে নিয়ে শান্তি প্রস্তাব! ট্রাম্পের প্রস্তাব গাজ়া পুনর্গঠনে তার সভাপতিত্বে একটি বোর্ড গঠন করা হবে এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার
সেই বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। এই সেই টনি ব্লেয়ার যিনি ইরাক গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুত করেছে বলে মিথ্যা প্রচার করে ইরাক যুদ্ধ ও ধ্বংসের অন্যতম ষড়যন্ত্রী ও মার্কিন সহযোগী। গাজ়া পুনর্গঠন ও শাসনে হামাস বা প্যালেস্তিনিদের কোনও ভূমিকা থাকবে না।
১০ অক্টোবর মিশরে অনুষ্ঠিত মিশর, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতার, তুর্কিয়ের মধ্যস্থতায় আলোচনায় ইজ়রায়েল ও হামাস যুদ্ধ বিরতি, বন্দি প্রত্যর্পণ এবং গাজ়ায় ত্রাণ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছায়। বিরোধ থেকে যায় গাজ়া থেকে ইজ়রায়েলি সেনা প্রত্যাহার, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজ়া পুনর্গঠন ও শাসনে হামাস বা প্যালেস্তিনিদের ভূমিকা নিয়ে। ভঙ্গুর হলেও যুদ্ধ বিরতি চালু হয়। সমঝোতা মতো হামাস ২০ জন জীবিত বন্দীদের মুক্তি দেয়। ইজ়রায়েল ২৫০ জন কারাবন্দি এবং যুদ্ধের সময় আটক থাকা ১,৭০০ জনেরও বেশি প্যালেস্তিনিদের মুক্তি দেয়। গাজ়া থেকে ইজ়রায়েল আংশিকভাবে সেনা প্রত্যাহার করে।
এই চুক্তি প্রমাণ করল, ইজ়রায়েল ব্যর্থ হয়েছে প্যালেস্তিনিদের গাজ়া থেকে উৎখাত করতে — ব্যর্থ হয়েছে প্যালেস্তিনিদের প্রতিরোধের শক্তিকে ধ্বংস করতে। পৃথিবী জুড়ে ইজ়রায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে, স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের সপক্ষে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। ১৫৭টি দেশ স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইতিমধ্যেই ইজ়রায়েল যুদ্ধ বিরতি ভেঙে গাজ়ায় বিমান আক্রমণ শুরু করেছে। প্যালেস্তিনিদের হত্যা নতুন করে শুরু করেছে। এখনও আইডিএফ ৫৩% গাজ়া ভূমি দখল করে আছে। রাফাহ এবং মিশর সীমান্ত প্যালেস্তাইনের অন্য অংশ ও বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে গাজ়ার সংযোগের এক মাত্র জায়গা। সেখানে ফিলাডেলফি করিডোর দখল করে রেখেছে ইজ়রায়েল। সমঝোতা অনুযায়ী প্রতি দিন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ৬০০ ট্রাক প্রবেশে বাধা দিচ্ছে আইডিএফ। তথাকথিত গাজ়া শান্তি চুক্তির পরিণতি বোঝা যাচ্ছে। প্যালেস্তিনিদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
মধ্য প্রাচ্যের তেল ও মূল্যবান খনিজ সম্পদের উপর দখলদারী এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ রাখতে আমেরিকা নয়া ঔপনিবেশিক স্বার্থের উত্তরাধিকার চালিয়ে যেতে ‘গণতান্ত্রিক’ ইজ়রায়েলকে মদত দিয়ে চলেছে।
নিছক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিকভাবে আমেরিকা তার আধিপত্য রাখতে পারছে না — অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মন্দা থেকে বার হতে পারছে না। তাই তাদের অস্ত্র হল যুদ্ধ — যুদ্ধ অর্থনীতি। তাতেই সচল থাকে আমেরিকার প্রতিরক্ষা শিল্প।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.