বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

২১ শতকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বিশ্ব

২১ শতকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বিশ্ব

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পর দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শিবির কী অবস্থায় রয়েছে, তার হিসাবনিকাশ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমত, দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর সাড়ে তিন দশক কেটে গেছে। তারপরেও এই বিশ্বে পাঁচটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ধারাবাহিকভাবে তাদের জোরদার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে সাম্রাজ্যবাদের সবরকম বিরোধিতা ও হুমকি অগ্রাহ্য করে। এই দেশগুলি হল চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া ও লাওস। এদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চীন সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পর্য়ায়ে পৌঁছে গেছে। ভিয়েতনামের আর্থিক বৃদ্ধির হার দ্রুততম। ৬৭ বছরের কঠোরতম মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের পরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কিউবা। ছোট দেশ হলেও কমলা বিপ্লব ঘটিয়ে উত্তর কোরিয়াকে বাগে আনতে পারেনি আমেরিকা। এসব কারণে, সোভিয়েতের পতনের ৩৫ বছর পরে এসে আমরা বলতে পারি, সোভিয়েতের পতন মানে সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নয়। আসলে এ ছিল সমাজতন্ত্রের সোভিয়েত মডেলের পতন। বাকি পাঁচটি সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েতের সঙ্কট থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার ও বিকশিত করার পথ খুঁজে পেয়েছে। এবং তা নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছে। সুতরাং, বর্তমান বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তার সংঘাতও বিদ্যমান। তাই বিশ্বজুড়ে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লড়াই একটি শক্তিশালী ধারা হিসাবেই বিদ্যমান রয়েছে, যাকে রেয়াত করে চলতে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে চীন সমাজতন্ত্রের একটা নতুন মডেল তৈরি করেছে। যেখানে শুধুমাত্র পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে সরে এসে বাজার ও পরিকল্পনাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এনে কাজে লাগানো হচ্ছে। এবং কিউবা সহ বাকি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি এখন সেই মডেলকেই কাজে লাগাচ্ছে। অর্থনৈতিক ফ্রন্টে চীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, চীনের সমস্যাটা ১৪০ কোটি লোকের জনসংখ্যা এবং তাদের সম্পদ লুঠ করার মতো কোনও উপনিবেশ নেই। অন্যদিকে, আমেরিকার রয়েছে সারা বিশ্ব থেকে লুঠ করা সম্পদ, বিপুল সামরিক শক্তি এবং জনসংখ্যা মাত্র ৩৪ কোটি। বিপুল সম্পদ ও সামরিক শক্তি নিয়ে এবং লুঠ করা সম্পদের জোরে দুনিয়া শাসন করা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে যেভাবে কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ১৪০ কোটি লোকের দেশ সমাজতান্ত্রিক চীন, তাতে আবারও সমাজান্ত্রিক ব্যবস্থার এবং অর্থনীতির চীনা মডেলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হচ্ছে। ওপরে উল্লেখ করা পাঁচটি দেশের জনসংখ্যা ১৫৬ কোটির কাছাকাছি। অর্থাৎ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। এই সব মানুষেরা থাকেন উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন এক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে।
তৃতীয়ত, সোভিয়েতের পতন হলেও সাম্রাজ্যবাদ এখনকার বিশ্বে আর আগের মতো উপনিবেশবাদের পর্বে ফিরে যেতে পারেনি। পূর্বতন উপনিবেশগুলি এখন তাই পিছিয়ে পড়া বা উন্নয়নশীল দেশ। এই সব দেশে দেশি ও বিদেশি পুঁজির আধিপত্য রয়েছে। তবে কোনওটা সাম্রাজ্যাবাদের প্রত্যক্ষ উপনিবেশ নয়। সাম্রাজ্যবাদ এসব দেশকে শোষণ ও লুন্ঠন করে পুঁজিবাদী নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার মাধ্যমে। এমনকী আফ্রিকার যে সব দেশে সরাসরি উপনিবেশের শেষ চিহ্নগুলি রয়ে গেছে সেগুলির অবসানের লক্ষ্যেও চলছে সংগ্রাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পর ও সোভিয়েতের পতনের সাড়ে তিন দশক পরেও উপনিবেশবাদ যে তার সনাতনী চেহারায় পৃথিবীতে ফিরতে পারল না, এটা দুনিয়াজুড়ে শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিঃসন্দেহে বিরাট অগ্রগতি, যা অর্জিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী পর্বে। একমাত্র প্যালেস্তাইনে পুরনো চেহারায় উপনিবেশবাদ টিকিয়ে রাখতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অর্থ, অস্ত্র ও সমর্থনপুষ্ট ইজরায়েল।
চতুর্থত, ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে পুরোপুরি মদত দিচ্ছে আমেরিকা সহ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ, তাতে স্পষ্ট সোভিয়েতের পতন হলেও রাশিয়াকে ভাগ করে লুঠ করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সফল হতে পারেনি। বরং পুতিনের নেতৃত্বে প্রাথমিক সঙ্কট কাটিয়ে রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদী দখলদারির বিরোধিতা করে চলেছে। সোভিয়েতের পতনের পরের রাশিয়া নিঃসন্দেহে পুঁজিবাদী। তবে সেখানে অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক উপাদানের অনেক কিছুই টিকে রয়েছে। রাশিয়ার অর্থনীতিতে যে বিরাট রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র রয়েছে, যার বেসরকারিকরণ করতে দেয়নি সেখারকার রাষ্ট্র, সেটাই এই দেশটাকে একটা মিশ্র অর্থনীতির চেহারা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলে, পরাজিত করে লুঠ করার লক্ষ্যে আমেরিকা সহ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ যে চক্রান্ত, তা আপাতত ব্যর্থ। বরং, শক্তিশালী রাশিয়া পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের মাথাব্যথার কারণ হিসেবে রয়েই গেছে।
পঞ্চমত, সোভিয়েত পরবর্তী দুনিয়ায় বহুপাক্ষিক বিশ্বের উত্থান। ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ধ্বংস করার মধ্যে দিয়ে এই বিশ্বকে একমেরু করে তুলতে চেয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তবে গত তিন দশকে তাদের সেই প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। কার্যত বিশ্ব এখন তিন শিবিরে বিভক্ত। একদিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিন্তু সামরিক ভাবে শক্তিশালী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। দ্বিতীয় শিবিরে রয়েছে, পশ্চিম ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্ষয়িষ্ণু। কিন্তু তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের যুদ্ধ, দখলদারি, শোষণ ও লুন্ঠনের আকাঙ্ক্ষার ওপর, যা পূরণ করার শক্তি তাদের নেই। আবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেও এদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। অন্যদিকে, তৃতীয় শক্তি হিসাবে উত্থান হয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধের বহু দেশের একটা সম্মিলিত শক্তির, যারা নানা ভাবে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বাইরে আসার চেষ্টা করছে। এই শক্তির নেতৃত্বে রয়েছে মূলত চীন ও রাশিয়া। ব্রিকস, শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেসন, কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলির একাধিক নিজস্ব মঞ্চ — এসবের মধ্যে দিয়েই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিপরীতে একটা বিকল্প বিশ্ব গড়ে তোলার চেষ্টা জারি রয়েছে। যেহেতু বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আইএমএফের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে আধিপত্য পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির, তাই এর বিকল্প হিসাবে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে (নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক ফোরাম অন লাতিন আমেরিকা অ্যান্ড দ্য ক্যারিবিয়ান, ওয়ার্লড ইকনমিক ফোরাম অন আফ্রিকা, ইকনমিক কমিউনিটি অফ ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস ইত্যাদি)। লক্ষ্য হল, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত এই সব সংস্থার দাপট শিথিল করা এবং সহজ শর্তে ঋণদানের ব্যবস্থা করে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করা। সবচেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য খর্ব করাটা তাদের অন্যতম লক্ষ্য করেছে ব্রিকস। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের বিপরীতে এই যে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলির উত্থান, এটাই বহুপাক্ষিক বিশ্বের অস্তিত্বকে জোরদার করছে এবং বিশ্বের একটা বড় অংশ সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করছে।
আজকের বহুমেরু বিশ্বকে বুঝতে হলে ওপরে উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ের প্রেক্ষিতে বুঝতে হবে। যদিও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে এই বিকল্প দুনিয়ার আলোচনাকে একেবারেই সামনে আনা হয় না। তাই জনমানসে এর অস্তিত্ব জোরদার নয়। কারণ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির কুক্ষিগত করা মিডিয়া এই দুনিয়ার খবরকে সামনেই আনে না।
আরও একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার। গত শতকের সত্তর ও আশির দশকের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে বিপ্লবের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলা, সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলার ধারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তার জায়গায় বাম ও প্রগতিশীল শক্তিগুলির জোট গড়ে নির্বাচনে জিতে সরকার গড়ে এবং সমাজের নীচের দিকে সংস্কার কর্মসূচিকে প্রসারিত করার ধারা শক্তিশালী হয়েছে। বিশেষত ভেনেজুয়েলায় হুগো শাভেজের নেতৃত্বে মার্কিন বিরোধী সরকার গঠনের পর থেকেই লাতিন আমেরিকায় এই ধারাটি শক্তিশালী হয়। ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, ইকোয়েডর, চিলি, নিকারাগুয়া সহ লাতিন আমেরিকার বহু দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে একাধিক বার বাম ও প্রগতিশীল শক্তি সরকারি ক্ষমতায় এসেছে এবং জনমুখী সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজির জোয়ালকে লঘু করার প্রয়াস চালিয়েছে। এসব দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল হয়নি, কিন্তু সরকার বদলের প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজি বিরোধী লড়াইয়ের অগ্রগতি ঘটেছে।
আফ্রিকায় উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে অগ্রগতি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্বে। এখন পশ্চিম আফ্রিকায় মালি, নাইজার ও বুরকিনা ফাসো প্রত্যক্ষ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কাজে নেমেছে। তাদের সইতে হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের আর্থিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ। আবার প্যালেস্তাইন, গাজা, লেবাননের মতো পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি একেবারে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী হামলার শিকার। গাজায় নতুন করে উপনিবেশবাদ জাঁকিয়ে বসতে চাইছে। আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার এই অংশগুলিতে এখন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই সশস্ত্র ও হিংসাত্মক হয়ে রয়েছে। কিউবায় অবরোধ জারি রাখার পাশাপাশি ভেনেজুয়েলায় অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। তাদের লক্ষ্য, ভেনেজুয়েলাকে পদানত করে তাদের তেলের ভাণ্ডার দখল করা। এ হল সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি ও তার বিরোধিতার আরেক ধরন।
দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলির ক্ষেত্রে অনেকটা পরিসর জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধ লড়াই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছে। আবার আফ্রিকার একাংশে এবং পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন, হিংস্র চেহারা সামনে এসেছে। ফলে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি সংগ্রামের নানা রূপকে কাজে লাগাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির — সোভিয়েত, চীন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে নিয়ে বিকল্প অর্থনীতি গড়ার লড়াই চালাচ্ছিল। যেখানে সাম্রাজ্যবাদ তথা পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মগুলো খাটে না। অন্যদিক, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করত সোভিয়েত রাশিয়া। তখনও সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধিতার দুটি ধারা বিদ্যমান ছিল।
আজকের বিশ্বের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাব মার্কিন তথা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলির একটা বড় অংশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অর্থনীতি ও রাজনীতি গড়ে তোলায় সামিল হয়েছে। এবং এভাবে অর্থনৈতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদকে দুর্বল করার লড়াই ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। সাম্রাজ্যাবাদ বিরোধিতার এ এক নতুন পর্ব। সমাজতান্ত্রিক শিবির হয়ত নেই, কিন্তু সেই শিবিরের অর্থনৈতিক লড়াইয়ের নির্যাসটা পুনর্জীবিত হয়েছে।
মনে রাখতে হবে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলির মোট জনসংখ্যা ৬০০ কোটির কিছু বেশি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার তিন চতুর্থাংশ। এই দেশগুলিকে নিয়েই গড়ে উঠেছে নানা বহুজাতিক মঞ্চ যা সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত মঞ্চগুলির বিকল্প হিসাবে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ব্রিকস। ব্রিকস কোনও জোট নয়, তবে একটা অর্থনৈতিক মঞ্চ যার লক্ষ্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আর্থিক আধিপত্যের বিরোধিতা করা। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির জনসংখ্যা ৩৩০ কোটি। মানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ। জি-৭ রয়েছে নিখাদ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি — আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও জাপান। এদের মোট জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার মোট ১০ শতাংশ। উল্টোদেক ব্রিকসে রয়েছে চীন, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল। এখানে সম্প্রতি যোগ দিয়েছে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। ন্যাটো সদস্য তুর্কিয়ে ও ইন্দোনেশিয়া সহ মোট ৪০টি দেশ ব্রিকসে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের মোট জিডিপির ৪০ শতাংশ ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির। অন্যদিকে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলির বিশ্বের জিডিপিতে অনুপাত ৩০ শতাংশ। দেখাই যাচ্ছে কী জনসংখ্যার বিচারে, কী জিডিপির অনুপাতের বিচারে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলি ছাপিয়ে গেছে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলিকে।
ব্রিকসের নথিতে বলা হয়েছে, “২০২৪ সালের শুরুতে সম্প্রসারণের নিরিখে উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে ব্রিকসের আকর্ষণ বাড়ছে। এই গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি চাইছে একটা বহুমেরু ভিত্তিক বিশ্ব গড়ে তুলতে। চাইছে এমন একটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যাতে বিকাশশীল বাজারগুলির সুবিধা হয় এবং যে সব উন্নয়নশীল দেশ আরও ভারসাম্য সম্পন্ন একটা বিশ্ব ব্যবস্থা চায় তারাও ব্রিকসের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে দারিদ্র, সুস্থায়ী বৃদ্ধি, উন্নয়নের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার বিষয়গুলি ভাগ করে নেওয়ার কথা বলে ব্রিকস। সংশ্লিষ্ট দেশগুলির জন্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করতে চায়। ব্রিকস সম্প্রসারিত হচ্ছে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভারসাম্যসম্পন্ন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা জন্য। সেজন্যই গ্লোবাল সাউথকে ব্রিকস দিচ্ছে একটা মঞ্চ।”
আপাত দৃষ্টিতে খুবই নিরীহ, সাদামাটা ভাষায় ওপরের কথাগুলো বলা হয়েছে। তবে আসলে বলা হয়েছে অনেক গুরুতর বিষয়ে, যার কেন্দ্রে রয়েছে বহুপাক্ষিক বিশ্ব এবং আরও ভারসাম্যসম্পন্ন বিশ্বব্যবস্থা, যা আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং জি-৭ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত চালু বিশ্ব ব্যাবস্থাকে নিঃশব্দে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। সবচেয়ে বড় কথা, সাম্রাজ্যাবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার হাতিয়ার যে মার্কিন ডলার, তারও অধিকার খর্ব করার পথে হাঁটতে চায় ব্রিকস। ২০০১ সালে বিশ্বের মোট সঞ্চয়ে ডলারের ভাগ ছিল ৭১ শতাংশ। ২০২৫এ তা কমে হয়েছে ৫৪ শতাংশ। ডলারকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যাতে খুশিমতো যে কোনও দেশরি বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে না পারে, তাই ডলারের বদলে ব্রিকস দেশগুলি তাদের নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালু করেছে। সেকারণেই ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর এত চড়া হারে শুল্ক চাপিয়েছেন ট্রাম্প।
দীর্ঘকালীন পরিসরে ডলারকে দুর্বল করা, বহুপাক্ষিক বিশ্ব গড়ে তোলা এবং আরও বেশি ভারসাম্যসম্পন্ন বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা — এই তিনটি দিশায় এগোতে চায় ব্রিকস। এবং সেটাই মার্কিন সহ পশ্চিমী পুঁজিবাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ এর প্রতিটি পদক্ষেপই সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে। সুতরাং, একথা বলাই যায়, ব্রিকস এবং এই ধরনের উন্নয়নের মঞ্চগুলিকে ঘিরে আগামী দিনে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের সংঘাত তীব্র হবে। এটাই একবিংশ শতকের অর্থনীতি ও রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.