বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
১৯৯১ সালে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিলুপ্তি হয় আর ১৯৯২ সালে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা লেখেন ‘দি এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দি লাস্ট ম্যান’। প্রচারিত হয় সাম্যবাদ ইতিহাস। মার্কসবাদ মৃত, ভূত হয়ে গেছে। বিশ্ব এখন এক মেরু। ১৯৯৩ সালে বিশিষ্ট ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদার ‘দি স্পেকটার অফ মার্কস’প্রকাশিত হয়। এই বইতে ১৮৪৮ সালে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের লেখা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর বিখ্যাত বাক্যবন্ধ ‘ইউরোপ আজ ভূত দেখেছে, কমিউনিজমের ভূত’-উদ্ধৃতি দিয়ে দেরিদা বলেন এই মার্কসবাদ নামক ভূত কখনও মারা যায় না। সে ‘হ্যামলেট’নাটকের ভূতের মতো সবসময়েই সমাজে, অর্থনীতিতে বিচরণ করে। এরই বহিঃপ্রকাশ হল সাম্প্রতিক কালের একমেরু যুগের অবসানে বহুমেরু তথা ব্রিকসের উত্থান। বর্তমান নিবন্ধে এই ব্রিকসের উত্থানের পটভূমি ও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অনুধাবন করার চেষ্টা করা হবে।
সকলেই জানেন ব্রিকস হল প্রাথমিক ভাবে ৫টি দেশের সমাহার। দেশগুলি হল ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশগুলি আয়তনের দিক থেকে অসম, আবার মানব উন্নয়নের নিরিখেও অসম। তবে অসাম্য, অভিবাসন ও দারিদ্র্যের মাত্রার নিরিখে কিছুটা সমগোত্রীয়। ব্রিকসের সূত্রপাত ২০০৯ সালে। বর্তমানে এই দেশগুলোর সংখ্যা হয়েছে ১০ এবং ‘কাজান’সম্মেলন থেকে আরও ১৩টি দেশ ব্রিকসের ‘পার্টনার নেশন’। দেখা যায় অধিকাংশ দেশই হল আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার পুরানো উপনিবেশ, আধা উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশগুলি যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন তা ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। দেশগুলির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে নয়া উপনিবেশবাদ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উত্তরোত্তর বাড়ছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে রাশিয়ার কাজানে ব্রিকস সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল ডি–ডলারাইজেশন অর্থাৎ মার্কিন ডলারের আধিপত্য থেকে মুক্ত হওয়া এবং নিজেদের মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করা। ‘ডলার’এর আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যের প্রচেষ্টা যে ইতিপূর্বে হয়নি তা নয়। ১৯৫৭ সালের ইউরোপীয় কমন মার্কেট ও ১৯৫৬ সালের বান্দুং সম্মেলন তার উদাহরণ। তবে কাজানের লক্ষ্য ছিল বিশ্ব বাণিজ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ আরও বড় পরিসরে ‘ডি ডলারাইজেশন’ করা। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ১৯৬৪ থেকে ২০২৩–এর পরিসরে বিশ্ব পণ্য বাণিজ্যে এই দেশগুলোর অংশ ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৪ শতাংশ হয়েছে, অর্থাৎ বিগত ৬০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। তত্ত্বগত ভাবে এটা হল আমদানি প্রতিস্থাপন উন্নয়নের মডেলের বিপরীতে রপ্তানি বাণিজ্য নির্ভর উন্নয়নের মডেল। এই মডেলের সঙ্গে ডি-ডলারাইজেশন যুক্ত করা হয়েছে, যা ইতিপূর্বে হয়নি। বাণিজ্যজাত পণ্যগুলি কী ধরনের হবে, তাদের উৎপাদন পদ্ধতি কী ধরনের এবং এই বাণিজ্যের ফলে তাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার রূপান্তর কী ঘটছে তা অনুধাবন করা দরকার। এই অনুধাবনের জন্য বিভিন্ন গবেষক এবং ব্রিকসের জয়েন্ট স্ট্যাটিস্টিক্যাল পাবলিকেশনস, ২০২৩এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
ব্রিকসের উপর বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে এই দেশগুলোর নিম্মলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ সহজেই নজরে আসে।
ক) চীন বাদে অপর ৪টি দেশের অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র সেবাক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদনের মধ্যে নিহিত। ২০০৪ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে সেবাক্ষেত্রের অবদান ব্রাজিলে ছিল ৪৬.৬ শতাংশ, রাশিয়ায় ৫৯.২ শতাংশ, ভারতে ৫৩.২ শতাংশ ও চীনে ছিল ৪০শতাংশ। উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর উৎপাদনে চীনের ভরকেন্দ্র নিহিত ছিল শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনে। ২০০৪ সালেই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪৬.২ শতাংশ শিল্পজাত পণ্য থেকে আসত। বর্তমানে এটা বহুগুণ বেড়েছে। ইউনাইটেড নেশনসের এক হিসেবে দেখা যায়, ২০২২ সালে চীন সারা বিশ্বের ৩১.১ শতাংশ শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করেছে, যা আমেরিকার তিনগুণ।
খ) ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে উৎপাদনের উপকরণের ব্যবহার বিভিন্ন ধরনের। ব্রাজিল ও রাশিয়ায় খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যের জন্য পণ্য উৎপাদনে খনিজ সম্পদের ব্যবহার বেশি। এই দুটি দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির চালিকা শক্তি হল এই খনিজ সম্পদ অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস ও লিথিয়াম। অপরদিকে চীন ও ভারতের অগ্রগতির চালিকা শক্তি হল সস্তা শ্রম ও খনিজ সম্পদ। ব্রিকস রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে, ২০২২ সালে ভারতের শ্রমশক্তি ছিল ৫৯.৯ কোটি আর চীনের শ্রমশক্তি ছিল ৭৩.৫ কোটি। সম্মিলিতভাবে এই শ্রমশক্তি বিশ্বের শ্রমশক্তির এক–চতুর্থাংশের বেশি।
গ) অর্থনীতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের পরিপূর্ণতা ও রপ্তানি বাণিজ্যের মধ্যে একটা সম্পর্কের কথা বলা হয়। বলা হয়, অভ্যন্তরীণ বাজার পরিপূর্ণ হলেই রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাসঙ্গিকতা আসে। এই বিষয়টা যদি অনুধাবন করা যায় তাহলে দেখা যাবে ব্রিকস, ২০২৩এর রিপোর্ট অনুসারে, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বিগত দশকে ‘ফাইনাল কনজামপশন রেট’ (অভ্যন্তরীণ বাজারের সূচক)বাড়ার সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য বেড়েছে। ব্রাজিল ও চীন–এ ‘ফাইনাল কনজামপশন’হ্রাস পেয়েছে। এবং রপ্তানি বাণিজ্য বেড়েছে। ভারতে ফাইনাল কনজামপশন কমেছে, এবং মোট রপ্তানি বাণিজ্য ঋণাত্মক হলেও রপ্তানি বেড়েছে। এক কথায় বললে, ৫টি দেশেই বিগত দশকে রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের ঝোঁক সুস্পষ্ট।
ঘ) রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘পণ্য নির্ভরতা’অর্থাৎ রপ্তানির জন্য মাত্র কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভরতা।
ওপরের আলোচনা থেকে একথা সহজেই প্রতিভাত হয় যে, ব্রিকস ভুক্ত দেশগুলোর ডি–ডলারাইজেশন–এর প্রেক্ষাপট হল সম্প্রসারিত রপ্তানি বাণিজ্য। এই রপ্তানি বাণিজ্যের চালিকাশক্তি চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে হচ্ছে সস্তা শ্রমশক্তি ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য্য। এই ধরনের রপ্তানি বাণিজ্যের দুর্বলতা হল রপ্তানি বাণিজ্যে পণ্যের বৈচিত্র কম। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির অর্থনৈতিক অগ্রগতির হার সারা বিশ্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতির হারের তুলনায় বেশি।
সারণী–১ জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার (শতাংশ)
বছর ব্রিকস সারা বিশ্ব আমেরিকা
------ ------ --------- --------
১৯৯৬ ৪.২৬ ৩.৬৭ ৩.৮
২০০০ ৭.১৬ ৪.৫৫ ৪.১
২০০৫ ৮.৪৬ ৫.০৬ ৩.৮
২০১০ ৮.৮০ ৫.৫০ ২.৫
২০১৫ ৪.৯৯ ৩.১৮ ২.৯
২০১৭ ৫.৭১ ৩.৩১ ২.৩
----------------------------------------
সূত্র: রাদুলেস্কু (২০১৪)
সারা বিশ্ব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতির হার ১৯৯৬ থেকে ২০১৭এর পরিসরে অনুধাবন করা হয়েছে। এটা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ২০১০ সালে দেশগুলো একত্রিত হবার আগে ও পরে কী পার্থক্য হল। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও বিশ্বে তার কী প্রভাব পড়ল? এখানে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর অগ্রগতির হার ছিল ৪.২৬ শতাংশ। তারপর ২০১০ পর্যন্ত টানা বেড়ে হয় ৮.৮০ শতাংশ। এরপর ২০১৫ সালে হ্রাস পেয়ে হয় ৪.৯৯ শতাংশ। ২০১৭ সালে সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৭১ শতাংশ (সারণী–১)।কাজেই একথা বলা যায় যে, ২০০৯ সালে ব্রিকস গঠিত হবার সময়ে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার যা ছিল পরবর্তী পর্যায়ে তা হ্রাস পায়। তবে বৃদ্ধির হার তুলনামূলক ভাবে সারা বিশ্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। প্রসঙ্গত বলা দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃদ্ধির হার ২০০০ সাল থেকে প্রায় ধারাবাহিক ভাবে ক্রমহ্রাসমান।
কিন্তু ২০০৯ সালে ব্রিকসের সূত্রপাত হলেও এক দশক বাদে জনজীবনে তার প্রতিফলন পড়েছে শুধুমাত্র রাশিয়া ও চীনে, অন্যত্র পড়েনি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সদ্যসমাপ্ত কাজান সম্মেলনে ডি-ডলারাইজেশনের প্রস্তাব এর উদাহরণ। ডলারের আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত হতে চায় ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো। পুঁজিবাদের সীমানার মধ্যেই নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতির আধিপত্য তথা একমেরু বিশ্বের আধিপত্যবাদের বিকল্প মঞ্চ হিসেবে বহুমেরু বিশ্বের সন্ধানে কাজান সম্মেলন। দক্ষিণপন্থার উগ্র আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকা যেমন বাম অভিমুখী সরকার তৈরি করেছে, তেমনি আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি বিকল্প খুঁজছে বাঁচার তাগিদে। একই ভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কার মতো দেশে দুর্নীতির জাল থেকে বাঁচতে জনগণ নির্বাচিত করেছে বামপন্থীদের। এসবই হল দেরিদার দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘মার্কসের ভূত’। আমেরিকার আধিপত্যবাদের বিপরীতে দেশগুলি বিকল্প হিসেবে ব্রিকসকে পছন্দ করছে। কাজান সম্মেলন তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ডি-ডলারাইজেশনের ভিত্তি হল বিশ্ববাণিজ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব। এক অর্থে এটা বহু বিতর্কিত রপ্তানি বাণিজ্য নির্ভর উন্নয়নের মডেল। এখানে দুটি বিষয় পরিষ্ফুট। প্রথমত, রপ্তানিজাত পণ্যগুলির বৈচিত্র্য কম। পণ্যগুলি চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে সস্তা শ্রমনির্ভর আর রাশিয়া ও ব্রাজিলের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর। এই সাবেকি পণ্য নির্ভর রপ্তানি বাণিজ্য নীতি আজকের যুগে বিসদৃশ। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি বাণিজ্যের ঝোঁক দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে ‘অভুক্ত’করে রাখছে। এই বিসদৃশ অবস্থার অবসানের মধ্যে নিহিত আছে ডি-ডলারাইজেশনের সাফল্য।