বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

ট্রাম্ম্পের নিষেধাজ্ঞা: ভারতীয় ছাত্ররা কি করবে?

ট্রাম্ম্পের নিষেধাজ্ঞা: ভারতীয় ছাত্ররা কি করবে?

অশোক সরকার

photo

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গবেষণা জার্নাল নেচার একটি সূচক তৈরি করে, যার নাম নেচার ইনডেক্স। প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দুনিয়ায় সবচেয়ে প্রভাবশালী গবেষণাগুলি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার হচ্ছে তার হিসেব করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির র‍্যাঙ্ক করা হয়। এই সূচকে দুনিয়ার প্রথম দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়টি হল চীনের, তবে সবচেয়ে উপরে আছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গবেষণা সবই চীনা বিজ্ঞানীদের করা, কিন্তু হার্ভার্ডের গবেষণাগুলির লেখক অভিবাসী বিজ্ঞানীরা। অন্য দেশ থেকে আমেরিকায় এসে পড়াশোনা করে কর্মসূত্রে হার্ভার্ডে আছেন। অনেকেই হার্ভার্ডে তাদের গবেষণা শুরু করেছিলেন।
এই কথাগুলি বলছি কারণ ট্রাম্প প্রশাসন বিদেশি ছাত্র ছাত্রীদের হার্ভার্ডে পড়তে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা আপাতত আদালতের নির্দেশে মুলতুবী আছে। তবে তাই নিয়ে অনিশ্চয়তা এখন চরমে। বিদেশি ছাত্রদের আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরও ব্যাপক আকার নিয়েছে কারণ ট্রাম্প প্রশাসন ছাত্র ভিসার সংখ্যাই অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
আমদের তাতে মাথাব্যাথার কি কোনও কারণ আছে? আছে কারণ আমেরিকায় অন্য দেশ থেকে যত ছাত্র পড়তে যায় তার মধ্যে ভারত আর চীনের অংশ সবচেয়ে বেশি। ২০২৩-২৪ সালে ভারত থেকে আমেরিকায় পড়তে গেছে ৩ লক্ষ ৩১ হাজার ছাত্র, আর চীন দেশ থেকে পড়তে গেছে ২ লক্ষ ৭৭ হাজার। ওই সালেরই হিসেব অনুযায়ী মোট ১১ লক্ষ ছাত্রছাত্রী অন্য কোনও দেশ থেকে আমেরিকায় পড়তে গেছে। ভারত, চীন বাদ দিলে অন্য কোনও দেশ থেকে পড়তে যাওয়া ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। [১]
ট্রাম্প প্রশাসনের এই নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতীয় ও চীনা ছাত্র ছাত্রীরা।
এই ছাত্ররা কারা? কেনই বা আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার এত হুজুগ? ট্রাম্প প্রশাসন কেন বিদেশি ছাত্রদের পড়তে আসা বন্ধ করতে চাইছে? এতে কার কতটা ক্ষতি হতে পারে? আসুন দেখি এই সব প্রশ্নের কি উত্তর পেতে পারি।
আমেরিকায় যে ১১ লক্ষ বিদেশি ছাত্র ছাত্রী পড়তে যায় তার তিন চতুর্থাংশ এশিয়া থেকে। ভারত চীনের পরেই আছে দক্ষিণ কোরিয়া, তারপর কানাডাকে বাদ দিলে আছে তাইওয়ান, তারপরেই আছে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ইত্যাদি। এশিয়ার কি বিশেষত্ব আছে, যে আমেরিকায় পড়তে যাওয়া ছাত্রদের তিন চতুর্থাংশ এশিয়া থেকে? এই ১১ লক্ষ ছাত্র যে সবাই স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাচ্ছে তা নয়, ৯০ ভাগই পুরো ফি এবং থাকা খাওয়ার খরচা দিয়ে পড়তে যাচ্ছে। যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ছাত্ররা পড়তে যায়, তার প্রথম ২০টির মধ্যে ১২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আমেরিকান আর বিদেশি ছাত্রদের পড়ার ফি আলাদা, বিদেশিদের জন্য তা অনেক বেশি। ২০২৩-২৪ সালে এই ফি থেকে আমেরিকার ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। পড়ার খরচার নানা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন কোর্স অনুযায়ী তা বছরে ২৬,০০০ থেকে ৫০,০০০ হাজার ডলার পর্যন্ত। টাকার অঙ্কে বছরে ২২ থেকে ৪২ লাখ টাকা। বিএসসি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেই বেশি ছাত্র যায়, অর্থাৎ ৪ বছরে খরচা ৮৮ লাখ থেকে এক কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা। এশিয়ার এই সব দেশগুলিতে এই পরিমাণ অর্থ ও আরও আনুষাঙ্গিক খরচা দিয়ে আমেরিকায় পড়তে পাঠানোর মত একটি শ্রেণী আছে। শুধু টাকা দিলেই হয় না। যোগ্যতাও লাগে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ‘পাস’ করতে হয়। এশিয়ার এই সব দেশগুলিতে আন্তর্জাতিক সিলেবাসে পড়ার ব্যবস্থা আছে, যেখানে পড়লে তা সম্ভব হয় — আমেরিকায় পড়তে পাঠানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক মানসিকতাও তৈরি হয়েছে। গত তিরিশ বছরে ভারত ও চীনে নিঃসন্দেহে একটি শ্রেণীর হাতে সম্পদ ও অর্থ এতটাই জমা হয়েছে যে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের জন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিতে চাইছেন।
এঁরা কারা? এঁরা সমাজের আধুনিক শিক্ষিত পেশাদার শ্রেণী — তথ্যপ্রযুক্তি, ফাইনান্স, ডাক্তারি, আইন, প্রাইভেট ব্যাঙ্কিং পেশায় যুক্ত অথবা শিল্পপতিদের এক অংশ। আর্থিক উদারীকরণ নীতির ফলে ভারতের জনসংখ্যার যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সত্যিই তরক্কি হয়েছে, এঁরা সেই অংশের মানুষ। এঁদের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই সামাজিক মানসিকভাবে তৈরি হয় বিদেশে যাবার জন্য। ব্যাঙ্গালোরে ১০ বছর কাটানোর সুবাদে এই রকম কিছু মানুষকে সচক্ষে দেখেছি। এঁদের ছেলে মেয়েরা ইন্টারনাশানাল স্কুলে পড়ে, অথবা আন্তর্জাতিক বোর্ডের সিলেবাস পড়ানো হয় এমন স্কুলে পড়ে, তারপর বিএসসি বা ইঞ্জিনিয়ারিং করতে আমেরিকায় চলে যায়। বেশিরভাগই শিক্ষা শেষে আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে চাকরি নেয়, এবং আমেরিকাতেই স্থায়ীভাবে থেকে যায়। আমেরিকাতে বসবাসকারী ৫২ লক্ষ ভারত আর ৫৫ লক্ষ চীন থেকে আসা মানুষের একটি বড় অংশ শিক্ষিত অর্থবান এলিট বর্গের মধ্যে পড়ে। তারই প্রতিফলন আমেরিকার রাজনীতিতেও দেখতে পাওয়া যায়। সার্ভেতে দেখা গেছে ভারতীয় আমেরিকানরা এখনো মূলত ডেমক্রাটদের সমর্থন করে, তবে ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতি ভারতীয়দের সমর্থন কিছুটা বেড়েছে। [২] চীনাদের ক্ষেত্রেও তাই, গত বছর একটু বেশি সংখ্যায় চীনারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই নীতির উদ্দেশ্য কি? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কেন তিনি আক্রমণ করতে চাইছেন? এর একাধিক উত্তর আছে। প্রথমত তাঁর সমর্থন বলয় এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারেনি। তারা আমেরিকার জনসংখ্যার সেই অংশ যারা কলেজে পড়তে যায়নি। স্কুল পাশ করে পারিবারিক ব্যবসা বা কোনও রোজগারি কাজে ঢুকে গেছে, কলেজে পড়ার দরকার বোধ করেনি। তারা আমেরিকার বয়স্ক জনসংখ্যার ৬০-৬৫ শতাংশ। দুনিয়াখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতি এই সমর্থন বলয়ের মানুষগুলির যে বিতৃষ্ণা আছে তার এক নিদর্শন পাওয়া যায় প্রখ্যাত দার্শনিক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মাইকেল সান্দাল-এর জবানিতে। ট্রাম্প সমর্থক রাজ্য আইওয়ার এক শহরে হোটেলের লিফটে এক মহিলা কর্মীর সঙ্গে তাঁর দেখা। কোথা থেকে এসেছেন জিগ্যেস করাতে যেই না মাইকেল বলেছেন বোস্টন, সেই মহিলা বলে উঠেছিলেন, “আমরা এখানে লিখতে পড়তে জানি প্রফেসর!”। তাঁর সমর্থন বলয়কে খুশি করতে গেলে ট্রাম্পকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে খোঁচা দিতেই হয়।
শুধু সমর্থন বলয়কে খুশি করাই যদি উদ্দেশ্য হতো তাহলে অল্প কিছু খোঁচাতেই কাজ চলত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের আক্রমণ অনেক গভীর ও ব্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আমেরিকায় চিরকালই স্বাধীন ভাবনার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত, ট্রাম্প বিরোধী কণ্ঠস্বরের অন্যতম উৎস হল এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেই ভারত বা চীনের ছাত্র গবেষকরা শিক্ষালাভ করে, এবং তারপরে বিশ্বের প্রথম সারির গবেষণা, আবিষ্কার কারিগরিতে অবদান রাখছে যার ফলে আমেরিকার বিজ্ঞান ও কারিগরি আধিপত্য খর্ব হচ্ছে। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া গবেষণালব্ধ ফল সারা দুনিয়ার কাজে লাগছে, শুধু আমেরিকার নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে যে
সব আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলি লাভবান হচ্ছে, তারা তাদের ব্যবসা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে যাতে আমেরিকার বিশেষত ট্রাম্পের সমর্থন বলয়ের মানুষগুলি কাজ হারাচ্ছে। এছাড়া আরও একটা গভীর উদ্দেশ্য আছে। ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ট্রাম্পের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভাবনার কণ্ঠস্বর হোক। সেইজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ চাইছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর আঘাত হানার তিনটি অস্ত্র। বিদেশি ছাত্র ছাত্রীদের আসা বন্ধ করা, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আয় কমবে। দ্বিতীয়, কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ করে দেওয়া। তাতে যে উচ্চ স্তরের গবেষণাগুলি বন্ধ হবে। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তার পরিসরকে স্তব্ধ করে দেওয়া যাতে ট্রাম্প বিরোধী কণ্ঠস্বর সাড়া না পেতে পারে। এর ফলে তাঁর আশা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ট্রাম্পনীতি ও রাজনীতির কাছে নত হবে, তিনি তখন এদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন।
কে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণার সর্ববৃহৎ আর্থিক সহায়তা আসে কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে, ফলে গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে উচ্চ শিক্ষা জগতে আমেরিকার আধিপত্য কমবে। চীনাদের আধিপত্য বাড়বে। চীনের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই দুনিয়ার প্রথম ১০০টির মধ্যে উঠে এসেছে, বিজ্ঞানের গবেষণায় তো চীন ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে।
আমাদের কাছে তার চেয়েও প্রাসঙ্গিক হল আমাদের প্রায় ৩ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীর কি হবে? ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে যে ইংলন্ডে পড়তে যাবার প্রবণতা বেড়েছে এবং আমেরিকায় যাবার প্রবণতা কমেছে। গত এক বছরেই ১১% কম ছাত্র আমেরিকায় পড়ার আবেদন করেছে। অর্থাৎ এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়বে। ভারতের যে সব স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে পড়তে যায়, সেখানে ইউরোপিয়ান ভাষাও পড়ানো হয়, তাই আশা করা যায় ইউরোপের দেশগুলিতেও পড়তে যাবার প্রবণতা বাড়বে।
এই সংকট থেকে ভারতে অতি উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার হবে এমন সম্ভাবনা কম। এমনকি আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভারতে তাদের শাখা খুলবে এ হেন সম্ভাবনাও নেই, কারণ ভারতেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি একই আক্রমণের শিকার। ফলে ভারতের এলিটের দেশ ত্যাগের কাহিনী চলতেই থাকবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.