বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

বাংলাদেশের পালাবদল: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ক্ষতচিহ্ন

বাংলাদেশের পালাবদল: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ক্ষতচিহ্ন

দীপক পিপলাই

photo

‘ওপার বাংলা’ আবার নতুনভাবে উত্তাল। তীব্র গণবিক্ষোভের মুখে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতের আশ্রয়ে। মিলিটারি সেদেশের শাসনভার নিয়েছে। গত ৫৩ বছরের মধ্যে ১৮ বছরই মিলিটারি শাসন দেখলো বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহম্মদ ইউনিস প্যারিস থেকে ঢাকায় এসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তিনি আমেরিকা সহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ।
প্রচলিত রাজনীতির ব্যাকরণ মেনে, এই ক্রান্তিকালে ঘটনাবলীর সব হিসেব মেলাতে যাওয়া অর্থহীন। আমরা সামাজিক ঝঞ্ঝার কেন্দ্রে নেই। দূরের দর্শক মাত্র। তবে যা দেখছি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর! ‘এপার বাংলা’ শুধু না, ভারত তথা সমগ্র মানবসমাজের কাছেই বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনার পরিচালিত আওয়ামী লীগের জোট সরকারের অজস্র অন্যায় এবং ভুলভ্রান্তি ছিল। সেইসব নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভবিক্ষোভ নিঃসন্দেহে জমা হয়েওছিল। এই গণবিক্ষোভকে হাতিয়ার করে যেমন সাম্যবাদী শক্তিরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীল-মৌলবাদী বিএনপি-জামায়েতে শক্তিও দেশকে পিছিয়ে দিতে পারে।
প্রাক্তন সেনা প্রধান জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যূত্থানে তিনি নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া বিএনপি-র কর্ণধার হন। বাংলাদেশে বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। পূর্বতন সরকার খালেদা জিয়াকে বন্দী করেছিলেন। বাংলাদেশের পালাবদলের পর খালেদা জিয়া মুক্ত হন। বিএনপি-র সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা আছে। জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং পাকিস্তান বিভক্তির বিরোধিতা করেছিল। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের শীর্ষ আদালত জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১ আগস্ট ২০২৪ সরকার জামায়েতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এবার বিএনপি-জামায়াতের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিই আবার ‘ওপার বাংলা’-তে শাসনক্ষমতা দখল করার পথে। হত্যা, ধ্বংস, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদির তাণ্ডবও চলছে। ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিব এবং তাঁর কন্যা হাসিনাও বাংলাদেশ থেকে উৎপাটিত।
আপাতদৃষ্টিতে যে ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বর্তমান উথালপাথালের শুরু, তার ঘন্টা বাজিয়েছিল সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা। অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলনের শুরুটা ছিল সম্পূর্ণ অহিংস এবং ‘বৈষম্য-বিরোধী’ দাবিতে। “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন”এর প্রতিধিদের ভাষায়, “আমরা কোনও বৈষম্য চাইছি না।” তাদের দাবিগুলোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল অন্যায় ‘কোটা’-র প্রতিবাদে। যেমন, ১৯৭১ সালের মহৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-নাতি-পুতি সহ বংশপরম্পরায়, সরকারি চাকরির ৩০% ‘কোটা’-র সুবিধা ভোগের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধারা বা তাঁদের সন্তানরা ‘কোটা’-র সুবিধা পাওয়া, সাধারণভাবে সকলেই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু নাতি-পুতি সহ সকলেই এই সুবিধা ভোগ করতে থাকবে বংশপরম্পরায়, এটা নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল জনমানসে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরও। যে দেশে হিসেব মতোই কর্মহীনের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার (‘প্রথম আলো’, ০৬ মে ২০২৪), সেখানে এই ৩০% ‘কোটা’ কী একধরনের সামাজিক অশ্লীলতা ছিল না? এর বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের দাবি অবশ্যই ন্যায্য এবং সমর্থনযোগ্য। শেখ হাসিনা হঠাৎ বলে বসলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে নাতো কী রাজাকারদের নাতি-পুতিরা পাবে?” তাঁর এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অপমানজনক মন্তব্য বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। আন্দোলনরত একটি ছাত্রীর জিজ্ঞাসা, “আমার বাবার জন্ম ১৯৭৩ সালে। আমিও রাজাকার!”

মনে রাখতে হবে, ছাত্র আন্দোলন শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই শহীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নিহত ২৬৬ জনের তালিকা বেরোয়। ছাত্র আন্দোলনের শহীদের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। সত্যিকার সংখ্যা কোনওদিনই জানা যাবে না; যায় না!
শুরুতে শিক্ষার্থীদের পেশ করা ৮ দফা দাবির প্রত্যেকটাই ছিল ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব যখন দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা, হাসিনা সরকার প্রথমে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে নাকচ করেছিল। পরে শতশত লাশের উপর এবং রক্তস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আইনমন্ত্রী ‘গণতান্ত্রিক’ (!) মনোভাব দেখিয়ে একদিন বললেন, “সরকার আজই আলোচনায় বসতে রাজি।” তখন আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে বলা হয়, “আলোচনায় তো আগেও বসা যেতো! কেন এতো মৃত্যূর পর?” আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তীব্র ক্ষোভে ও অভিমানে মিছিলে একযোগে স্লোগান তুলেছে, “চেয়েছিলাম স্বাধীকার, হয়ে গেলাম রাজাকার”।
যে ‘কোটা’ ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে এতো হৈচৈ, এতো চাপান-উতোর, সেই ‘কোটা’ কিন্তু চিরস্থায়ী, অপরিবর্তনীয় কোনও ব্যবস্থা না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি সব সরকারের আমলেই তার পরিবর্তন ঘটেছে। অতি সম্প্রতি (২০২৪) তা আবার বদলালো। তাহলে, শিক্ষার্থী আন্দোলনের তরফ থেকে যখন অন্যায় ‘কোটা’-র বিরুদ্ধে দাবি তোলা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অসুবিধা কী ছিল? হাসিনা হঠাৎ ‘সুপ্রীম কোর্ট’ দেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু ‘নির্বাচিত’ প্রশাসনের তরফ থেকে সুবিধামতো আদালতে যাওয়া এবং প্রয়োজনমতো আদালতের রায়কে অগ্রাহ্য করা, শাসকদের এই ধরনের সুবিধাবাদী খেলা দেখতে ‘এপার বাংলা’ তথা ভারতও অভ্যস্ত। বহুবার তা ঘটেছে। হাসিনা সরকারের সদিচ্ছা থাকলে, বহু আগেই তা বদলাতে পারতো।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর সমন্বয়কারীরা সাংবাদিক সম্মেলনে (২০ জুলাই, ঢাকা) আবার ঘোষণা দিলেন, “আমরা দেখছি, বিভিন্ন মিডিয়াতে এবং নানা জায়গায় ভুল বা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। আমরা শুধু আমাদের দাবিগুলো কী কী রয়েছে, তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এখানে এসেছি। অর্থাৎ আলোচনার যে দ্বারটি রুদ্ধ করে দিয়েছে, বন্ধ করে দিয়েছে, কী কী দাবি বা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করলে সেই দ্বারটি উন্মুক্ত হতে পারে, তা স্পষ্ট করার জন্য, আমাদের দাবি পেশ করার জন্য আমরা এখানে এসেছি। প্রথমেই একটা জিনিস স্পষ্ট করি। আমরা দেখেছি ঢাকা শহর সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও এইসব হয়েছে। সহিংসতা হয়েছে। আমরা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কতগুলি যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছি। আমাদের এই ব্যানারটিকে ব্যবহার করে কেউ যদি তার রাজনৈতিক দাবি হাসিলের অপচেষ্টা করে, এইসব জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর এইসব সহিংসতাগুলো করে, আমরা তাকে কখনোই সমর্থন করি না। সেই দায় তাদের।”
কিন্তু ঘটনা গতিপ্রকৃতিতে, শিক্ষার্থীদের এই কথার গুরুত্ব ক্রমশই কমে এলো! বাংলাদেশ জুড়ে অহিংস আন্দোলনে ভয়ঙ্কর সহিংসতা বেড়েই চললো। বোঝাই যাচ্ছে, ১৯৭১ সালে তিরিশ লক্ষ বাঙালি নিধনকারী পাকিস্তানি সেনার দোসর জামায়াতের মতো চূড়ান্ত ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি – যারা ঘাপটি মেরে ছিল – তারা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পোড়ানো এবং ধর্মস্থানের উপর আক্রমণ হয়েছে। আবার, মুসলমানরা হিন্দুদের এবং মন্দির রক্ষা করছে, এরকম খবরও জানা যাচ্ছে। মৌলবাদীরা স্লোগান তুলছে, “ভারত যাদের মামাবাড়ি/ বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি”। কোথাকার জল কোথায় এসে দাঁড়ালো!

ঘটনাবলী নিংসন্দেহে প্রমাণ করছে, বিশাল কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কাজ করেছে ‘ওপার বাংলা’র পটপরিবর্তনে। শুরুতে আন্দোলনকারী ছাত্রশক্তির উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহেই ছিল সমাজের বৈষম্য-বিরোধিতা। আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকা মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল জামায়েতে-বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল, যেনতেনভাবে সরকারি ক্ষমতায় আসা। আওয়ামী লীগ সরকারের যতোই অপরাধ, অন্যায় ও দোষত্রুটি থাক, তাঁরা কখনোই উগ্র ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক শক্তি না‌। যদিও, বাংলাদেশের ঘোষিত “রাষ্ট্রধর্ম” ইসলাম। তবে বাঙালি সমাজের ঐতিহাসিক ও সদর্থক পরম্পরার প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তিরিশ লক্ষ বাঙালি নিধনের হোতা বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ‘রাজাকার’-দের উত্তরসূরি সাম্প্রদায়িক জামায়াতে বা তার সহযোগী বিএনপি-র মতো শক্তি আওয়ামী লীগ কখনোই না। একথা ভুলে গেলে সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি হবে বিশ্বের নানা দেশে বসবাসকারী বাঙালি সমাজের তথা সকল বঙ্গবাসীর।
বাংলাদেশের কক্সবাজার বন্দরের কাছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আমেরিকা নৌসেনা ঘাঁটি বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু হাসিনা রাজি হননি বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ন্যাটো সেনাঘাটি তৈরি করতে দিতে। তিনি চাননি বাংলাদেশকে বিক্রি করে দিতে আমেরিকার কাছে। চোখে দেখা ‘বাংলাদেশী’ ঘটনাবলীর ঝড়ে যেন এই ভয়ঙ্কর ‘আন্তর্জাতিক’ দিকগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে না যায়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪-দলের জোটের একটা সভায় বলেন, “বাংলাদেশ এবং মায়ানমার থেকে অংশ কেটে নিয়ে, ‘পূর্ব টিমোর’-এর মতো একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র তৈরির এক পরিকল্পনা জারি আছে।” তিনি আরও বলেছেন, কোনও এক “সাদা চামড়া” (White man) বিদেশি তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল – ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের নির্বাচন “ঝামেলাহীন” (hassle-free) হবে, যদি বাংলাদেশের সীমার মধ্যে একটি “বিদেশি রাষ্ট্রকে বিমান ঘাঁটি বানাতে দেওয়া হয়।” বলাবাহুল্য, কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি আমেরিকার নাম বলতে পারেন নি‌। শেখ হাসিনার ভূতপূর্ব প্রচার উপদেষ্টা ইকবাল শোভান চৌধুরী বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী কখনোই উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কথা বলেন না। আমি নিশ্চিত, এই বিবৃতির আগে তিনি যথেষ্ট ভালোভাবেই চিন্তাভাবনা করেছেন।” তিনি সাবধান করে দিয়ে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় আরও একটি ইউএস ঘাঁটি হলে শুধু বাংলাদেশের না, নতুন দিল্লীরও নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে যাবে।
এরকম আলোচনাও চলছে – ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চল, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং মায়ানমারের কিছু অঞ্চল নিয়ে, একটা আলাদা রাষ্ট্র তৈরির পরিকল্পনা আছে আমেরিকার। এটাই নাকি “সিআইএ-র আদর্শ (copybook) পরিকল্পনা” স্থানীয় যুবসমাজের ক্ষোভবিক্ষোভকে কাজে লাগানো, এই পরিকল্পনারই অঙ্গ। আমেরিকার কথার অবাধ্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই পরিকল্পনাই কাজে লাগানো হয়েছে। এই ধরনের আলোচনায়, ভারতকেও সিআইএ-র টার্গেট বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘উদ্বেগ’ এবং আমেরিকার ‘আগ্রহ’ অবশ্য আমাদেরও চোখ এড়ায়নি। শেখ হাসিনার ভিসা আমেরিকা বাতিল করে দিয়েছে শুধু না, তারা বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে তড়িঘড়ি স্বীকৃতিও দিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ মানে শুধু একটা “পৃথক দেশ” না। তা বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্ত্বার অবিচ্ছিন্ন অংশ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শয়তানদের পরিকল্পনা এবং হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন ভারতীয় মাতব্বরদের সহযোগিতা, এই দুইয়ের মিলে আমরা আজ ‘আলাদা’! কিন্তু ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক দিক থেকে “দুই বাংলা” আসলে যমজ ভাই। একই মায়ের সন্তান। একের বিপদ অপরের কাছে অশনি সংকেত। বৃহত্তর বাঙালি সমাজের কাছে তা ‘ঘরের কথা’, মনের জ্বালা।
চিরদিন ছাত্র ও যুবরাই সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – “এই দুঃসাহসিকের দল নিজের সমাজের মধ্যেও যে লক্ষ্মীছেলে হইয়া ঠাণ্ডা হইয়া বসিয়া আছে তাহা নহে। যাহা আছে তাহাই যে চূড়ান্ত একথা কোনওমতেই তাহাদের মন মানিতে চায় না। বিজ্ঞ মানুষদের নিয়ত ধমকানি খাইয়াও এই অশান্তের দল জীর্ণ বেড়া ভাঙিয়া পুরাতন বেড়া সরাইয়া কত উৎপাত করিতেছে তাহার ঠিকানা নাই। প্রাণের চাঞ্চল্য তাহাদের স্বভাবতই প্রবল বলিয়াই, তাহাদের সাহসের অন্ত নাই বলিয়াই, সেই বিপুল বেগেতেই তাহারা সমস্ত সীমাকে কেবলই ধাক্কা মারিয়া বেড়ায়। ইহা তাহাদের স্বভাব। এমনি করিয়াই আবিষ্কৃত হইয়া পড়ে যেখানে সীমা দেখা যাইতেছিল বস্তুতই সেখানে সীমা নাই। ইহারা দুঃখ পায়, দুঃখ দেয়, মানুষকে অস্থির করিয়া তোলে এবং মরিবার বেলায় ইহারাই মরে। কিন্তু বাঁচিবার পথ ইহারাই বাহির করিয়া দেয়।” (প্রবন্ধ: ‘বিবেচনা ও অবিবেচনা’)
অবিভক্ত এবং বিভক্ত বাংলায় বারবার ছাত্রছাত্রীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, এবং বাংলাদেশে বর্তমান ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাতও তার প্রমাণ।
শাসকরা ভুলে যায়, তথাকথিত ‘নির্বাচনে জয়লাভ’ কোনও রাজনৈতিক দলকেই যা-ইচ্ছে-তাই করার ছাড়পত্র দেয় না। সমাজে বিপুল কর্মহীনতা, অসহ্য সামাজিক বৈষম্য, ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধি, লাগামহীন চুরি-জালিয়াতি, লুটতরাজ জনমানসকে ক্ষুব্ধ করে তুলবেই। সেইরকম অবস্থায় যাহোক কিছুকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভ একসময়ে ফেটে পড়বেই। তখনও সমাজের সমস্যা দূর করার দিকে নজর দেবার বদলে, সশস্ত্র শক্তি এবং দলীয় কর্মীদের দিয়ে শতশত মানুষকে হত্যা ও দমন-পীড়ন চালিয়ে রক্তাক্ত ‘শান্তি’ আনলেও, সমাজের কাছে সেই ‘শান্তি’ কখনোই গ্রহণযোগ্য হয় না। বরং শাসকের এইসব দুর্বিনীত কাজকর্ম চরম প্রতিক্রিয়াশীলদেরই সুবিধা করে দেয় তাদের শক্তি বাড়াতে, শাসনক্ষমতার দিকে এগিয়ে যেতে।
বাংলাদেশে ঠিক এভাবেই বিএনপি-জামায়াতে আবার শক্তিশালী হয়ে উঠলো শেখ হাসিনার জোট সরকারের অদূরদর্শিতায়। এবং চরম খেসারতও দিতে হল তাঁদের!

বাংলাদেশ আমাদের থেকে অনেক দূরের কোনও ‘দেশ’ না। “আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিয়ম”-এ সে আলাদা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হলেও, তাঁরা অভিন্ন বাঙালি জাতিরই এক অংশ। যাঁদের এক থাকারই কথা ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শয়তানদের পরিকল্পনা এবং কিছু কুলাঙ্গার বঙ্গসন্তানের তথা ভারতীয়দের সহযোগিতা, তার ফলেই আমরা আজ কাঁটাতারের দুদিকে ‘আলাদা’! বারবার শাসকশক্তির অদল-বদল ঘটলেও, যাঁদের ভাষা ইতিহাস সংস্কৃতি ঐতিহ্য মানসিকতা – সবই এক। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকোলের প্রেম; ইলিশ, চিতল, মৌরলা, চিংড়ির ভালোবাসা; লোকগীতি-ভাটিয়ালী-সারিগান-লালনসঙ্গীত সম্পর্কে মুগ্ধতা; ডিঙি-ডোঙা-সাম্পান-পানসি নিয়ে নদীমাতৃক সংস্কৃতি; ইত্যাদি — এই সবকিছুই আজও ‘দুই বাংলা’-র অভিন্ন সম্পদ। তবুও, শতসহস্র বছরের প্রতিবেশী বাঙালিরা আজ ‘দুই দেশ’-এর বাসিন্দা!
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও আমরা কামনা করতে পারি, দুই বাংলার জনগণের সম্প্রীতি ও ঐক্য শক্তিশালী হোক। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং পরিবেশ রক্ষিত ও বিকশিত হয়ে উঠুক। আজকের ‘দুই বাংলা’ই তাতে সমৃদ্ধ হবে। হিন্দু ও মুসলমান, দুই সাম্প্রদায়িক শক্তিরও মেরুদণ্ড তাতে দুর্বল হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দুরভিসন্ধিকেও রুখে দিতে সুবিধা হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.