বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাঙ্কের পতন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাঙ্কের পতন

সন্দীপন ধর

photo

তিন দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাঙ্ক বন্ধের পর বিশ্বজুড়ে ব্যাঙ্কের শেয়ারের দরপতন হয়েছে ব্যাপকভাবে। সারা বিশ্বে মন্দা পরিস্থিতিতে এই পতনের ফল কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের আমানত নিরাপদ বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন, তখন বোঝা যায় এই আর্থিক সংকটকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে আশ্বাস দিয়েছেন তা কেবল ধসে পড়া দুটি ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের জন্যেই নয়। ব্যাঙ্ক দুটির পতনে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বেই এর সম্ভাব্য প্রভাব রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাঙ্ক বন্ধ করতে হল কেন?

ব্যাঙ্ক বন্ধের কারণ কী


বিশেষ করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে ঋণ দেওয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক ১০ মার্চ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন। এরপর ব্যাঙ্কের সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেয় ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক এই ব্যাঙ্ক বন্ধের ঘটনাকে বলা হচ্ছে ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে সব থেকে বড় পতন। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার মধ্যে ২০০৮ সালে পতন ঘটেছিল ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাঙ্কের, যার সম্পদমূল্য ছিল ৩০৭ বিলিয়ন ডলার।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের চাকা বন্ধ হতে থাকে ব্যাঙ্ক বন্ধের দু’দিন আগে থেকে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় জানায়, কিছু সম্পদ বিক্রি করে তাদের ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী করতে ২২৫ কোটি ডলারের নতুন শেয়ার বিক্রি করবে তারা।
ওই ঘোষণার পর প্রধান কোম্পানিগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। গ্রাহকরা ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিলে ব্যাঙ্কটি অর্থ সংকটে পড়ে যায়। সিলিকন ভ্যালি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারের দাম পড়ে যায় ৬০ শতাংশ।
ব্যাঙ্কটি যেদিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়, সেদিনও শেয়ারের দরের পতন হয় ৬০ শতাংশ। ফলে দুই দিনে মোট পতন হয় ৮৪ শতাংশ।
বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে সবমিলিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১০ মার্চ সকালে ব্যাঙ্কের কার্যক্রম বন্ধ করে নিয়ন্ত্রণ নেয় ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন।
গত ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ ছিল এবং আমানত ছিল ১৭৫.৪ বিলিয়ন ডলার।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক বন্ধ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই তিনদিনের মাথায় ১২ মার্চ নিউ ইয়র্কের সিগনেচার ব্যাঙ্ক বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
নিউ ইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস জানায়, গত বছরের শেষ নাগাদ সিগনেচার ব্যাঙ্কের সম্পদ ছিল ১১০.৩৬ বিলিয়ন ডলার। আমানতের পরিমাণ ছিল ৮৮.৫৯ বিলিয়ন ডলার। হঠাৎ করে এই ব্যাঙ্কের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণায় বিপাকে পড়ে যান আমানতকারীরা।
সিগনেচার ব্যাঙ্কের অনেক গ্রাহকই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাঙ্কের আমানতের প্রায় এক চতুর্থাংশ এসেছে এই ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু ডিসেম্বরে তারা ৮ বিলিয়ন ডলার ক্রিপ্টো আমানত কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার উভয় ব্যাঙ্কই একটি ক্ষেত্রের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যাঙ্ক দুটির বিনিয়োগকে ঝুকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছিল।

আরও কোন ব্যাঙ্ক ঝুঁকিতে


সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাঙ্কের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া এবং ইউরোপ জুড়ে ব্যাঙ্কের শেয়ারের দরে পতন হয়েছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
বিশেষভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ব্যাঙ্কগুলো। বিনিয়োগকারীদের ধারণা, ব্যাঙ্ক দুটির পতন অন্যান্য ফার্ম বা কোম্পানিগুলোর জন্যও বিপদ সংকেত। তবে বেশিরভাগ ব্যাঙ্কের বিনিয়োগ যেহেতু বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছ এবং হাতে প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থ রয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুমান ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের বাকি অংশে ঝুঁকি কম রয়েছে।
ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রের এই ব্যর্থতা যে বিষয়টিকে সামনে এনেছে, ব্যাঙ্কগুলোকে যেরকম দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে সেগুলো তার চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সুদের হার বৃদ্ধির কারণে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগকারীদের অনেকেই লোকসানের মুখে রয়েছেন; তাদের শেয়ারের দর কমে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিনিয়োগকারীরা নড়েচড়ে বসেছেন, যেটি ব্যাঙ্কের শেয়ারের দরের পতনের একটি কারণ।

অর্থ নিরাপদ?


যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরকার আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়ে আসছে। বেশিরভাগ সচেতন গ্রাহকরা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এর চেয়ে বেশি অর্থ রাখবেন না।
সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাঙ্কের দুই ধরনের গ্রাহক রয়েছে। সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বেশি কাস্টমার হল স্টার্ট-আপ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সিগনেচার ব্যাঙ্ক করপোরেট সেক্টরে বেশি বিনিয়োগ। আর এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই ব্যাঙ্ক আকাউন্টে আমানত রক্ষা সীমা আড়াই লাখ ডলারের বেশি।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত সপ্তাহে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত আমেরিকানদের আশ্বস্ত করবে, “আপনার আমানত সেখানেই থাকবে, যখনই আপনার প্রয়োজন পড়বে।”
ইতিমধ্যে সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের যুক্তরাজ্যের শাখার স্বত্ব কিনে নিয়েছে এইচএসবিসি ব্যাঙ্ক। ফলে দেশটির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুঃশ্চিন্তা থেকে আপাত মুক্তি মিলেছে, যারা বলছিল- সাহায্য না পেলে তারা পথে বসবে। আর এখন গ্রাহক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের অর্থ তুলে নিতে পারবে।
এইচএসবিসি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী নোয়েল কুইন বলেন, যুক্তরাজ্যে সিলিকন ভ্যালির গ্রাহকদের আমানত নিরাপদ এবং তারা যথারীতি ব্যাঙ্কিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবেন।

করদাতাদের খরচ হচ্ছে?


বন্ধ হওয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের যুক্তরাজ্যের শাখা সচল রাখার সিদ্ধান্তটি সহজ ছিল না। দেশটির সরকার ও ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের সঙ্গে এইচএসবিসির রাতভর বৈঠকের পর স্বত্ব কিনে নেওয়ার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী করদাতাদের কোনও টাকা খরচ হবে না। এইচএসবিসি মাত্র ১ পাউন্ডের বিনিময়ে সিলিকন ভ্যালির যুক্তরাজ্য শাখা কিনে নেয়।
আমেরিকান নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক বিক্রির চেষ্টা করেছে। তারা সম্পূর্ণ নতুন ঋণ কর্মসূচিও চালু করে। এতে একই রকমের সমস্যায় থাকা ব্যাঙ্কগুলোকে তারা নিজেদের কিছু আর্থিক সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ দেয়; যার মানে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ থেকে ঋণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাঙ্কগুলো যাতে আমানতকারীদের সমস্ত চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়, সেটি নিশ্চিত করতে এই ঋণ কর্মসূচি মূলত ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
তবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাঙ্ককে সরকার মুক্তি দিচ্ছে কিনা, সেটি বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে রয়েছে গেছে; ২০০৮ সালে আর্থিক সংকটের সময় ওয়াল স্ট্রিটকে দেওয়া সাহায্যের বিষয়টি নিয়ে যেমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
বাইডেনের ভাষ্য, “করদাতারা কোনও ক্ষতি হবে না, আমি আবারও বলছি, করদাতারা কোনও ক্ষতি পোষাবে না। ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স ফান্ডে ব্যাঙ্ক ফি দিয়েছে, অর্থ আসবে সেখান থেকে।”
কিন্তু বাস্তবতা হল বেশিরভাগ আমেরিকানই ব্যাঙ্কগ্রাহক। ব্যাঙ্কগুলোতে যে ফি কেটে নেওয়া হয়, ঘুরেফিরে তা গ্রাহকদেরই। তাহলে সেটি করের মাধ্যমে না হলেও মূলত আমেরিকার জনগণই এই অর্থ পরিশোধ করছে।

আক্রান্ত কারা


সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যবসার জন্য ঋণ দিত। ফলে এ ব্যাঙ্কের পতনে জলবায়ু থেকে মেডিকেল গবেষণাসহ বিভিন্ন শিল্পে প্রভাব পড়বে।
গত বছর যেসব ঝুকিপূর্ণ নতুন প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল সেগুলোর অর্ধেকের ব্যাঙ্কিং অংশীদার ছিল সিলিকন ভ্যালি।
যুক্তরাজ্যে সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক সচল রাখার সিদ্ধান্তের পর ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের বিবৃতিতে বলা হয়, “যদিও বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাঙ্কটির যুক্তরাজ্য শাখায় মাত্র ৩ হাজার গ্রাহক বা কোম্পানির সঙ্গে ছোট পরিসরে লেনদেন ছিল, তারপরও সেটি একটি সেক্টরের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, যে সেক্টরকে অর্থনৈতিক সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ব্রিটিশ সরকার।”
যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেন, “এ ধরনের কোম্পানি বা ফার্মগুলোর অবস্থা শোচনীয়। কিছু ফার্মের সঙ্গে কেবল যুক্তরাজ্যের সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ফলে আমরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম, যেখানে দেখা যায় আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও সবথেকে কৌশলগত কোম্পানি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, যেটা হতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক।”
সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক বন্ধের ফলে বেকায়দায় পড়া যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন মার্কেটপ্লেস এটসি জানাচ্ছে, ব্যাঙ্কটি বন্ধের ফলে কিছু বিক্রেতাকে অর্থ পরিশোধে তাদের বিলম্ব হয়েছে। তাদের টিম একটানা ২৪ ঘণ্টা কাজ করার পর একটি সমাধানে পৌঁছেছে এবং আমানত ছাড় করতে পেরেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ চরমভাবে সুদের হার বাড়িয়েছে, যাকে ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রের সংকটের জন্য খানিকটা দায়ী করা হচ্ছে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সামলে রাখা ফেডারেল রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন সুদের হার বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী সংকট কোথায় তৈরি হবে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। কারণ, কেউ তো ঝুঁকির মধ্যে থাকতে চায় না।
বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষকদের অনুমান, ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বৃদ্ধি স্থগিত করবে অথবা সুদহার কমানো শুরু করবে। তবে আসলে কী করবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.