বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
আমরা যখন তিন মাস ধরে ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম এই সময় পর্বে পশ্চিম এশিয়া ও আন্তর্জাতিক দরবারে ইজরায়েলের গাজা আক্রমণ নিয়ে ঘটনার ঘনঘটা। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজি) প্যালেস্টাইনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের রাফায় সামরিক অভিযান বন্ধ করতে ইজরায়েলকে নির্দেশ দিয়েছে। আইসিজি-র নির্দেশ অমান্য করে ইজরায়েল রাফায় বর্বর হামলা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) মুখ্য প্রসিকিউটর ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং তিন হামাস নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরাধের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার অনুরোধ করেছেন। ইজরায়েল ও আমেরিকা গাজায় যুদ্ধ অপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে, গাজায় ইজরায়েলের বর্বরতা বন্ধ ও যুদ্ধবিরতি, গাজায় মানবিক সাহায্য এবং স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির দাবিতে সারা বিশ্বের শান্তিকামী জনতা রাস্তায় নেমে বিশাল বিশাল প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া সহ আমেরিকার শক্তিবলয়ের দেশে দেশে ইজরায়েলকে মদত ও সামরিক সাহায্য পাঠানোর বিরুদ্ধে ধিক্কারে ফেটে পড়েছেন জনতা। খোদ আমেরিকায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের অবরোধ সামলাতে পুলিশ বর্বর নিপীড়ন নামিয়ে এনেছে — প্রকাশ করে দিচ্ছে আমেরিকার গণতন্ত্রের আসল চেহারা।
১০ মে রাষ্টসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে এক বিশেষ জরুরি অধিবেশনে প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব নেওয়া হয় এবং নিরাপত্তা পরিষদের কাছে প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানায়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করে আরব দেশগুলি; সমর্থন করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলির সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৪৩টি দেশ। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া সহ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার প্রায় সমস্ত দেশ— মধ্য প্রাচ্যের মিশর, জর্ডন, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব অমিরশাহী, কাতার, কুয়েত, তুরস্ক, বাহারিন, ইয়েমেন থেকে আরম্ভ করে এমনকি আমেরিকার শক্তিবলয়ের ফ্রান্স, স্পেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া। স্বাভাবিকভাবেই, এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে ইজরায়েল এবং তার মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; সঙ্গী হয়েছে আর্জেন্টিনা, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি সহ মাত্র ৯টি দেশ। ভোটে বিরত থেকেছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ইউক্রেন সহ ২৫টি দেশ।
আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে এবং স্পেন প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইজরায়েল এই তিনটি দেশ থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত ফিরিয়ে নিয়েছে। গাজায় নিষ্ঠুর যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েল বিশ্বের দরবারে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে— গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমেরিকার শক্তিবলয়ে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে ইজরায়েল গাজা ভূখণ্ডে যে বর্বর গণহত্যা সংগঠিত করে চলেছে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বার বার যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র — ভেটো দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবকে প্রহসনে পরিণত করেছে। ইজরায়েলের মতোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বিরতিতে পণবন্দীদের মুক্ত করার সঙ্গে হামাসকে নিকেশ করার শর্ত আরোপ করে। হামাসকে ধবংস না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে বলে ঘোষণা করেছিল ইজরায়েল। সমর্থন জানিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আট মাস বিবেকহীন যুদ্ধ চালিয়েও ইজরায়েল পণবন্দিদের মুক্ত করতে পারেনি। হামাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা ইজরায়েলি সেনা বাহিনী প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করছে।
দখলদার ইজরায়েলি সেনা বিমান, ট্যাঙ্ক, কামানের গোলায় গাজা ভূখণ্ডকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। বোমার আঘাতে সমস্ত ঘরবাড়ি, শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল, স্কুল, জল ও বিদ্যুৎ পরিকাঠামো ধ্বংস করেছে। জল নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ নেই। প্রতিদিন শিশু নারী বৃদ্ধ খুন হচ্ছে। গাজার ২.৩ মিলিয়ন (২৩ লক্ষ) মানুষকে উত্তর থেকে মধ্য, মধ্য থেকে দক্ষিণে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। ভয়ার্ত প্যালেস্তিনিরা পালাতে পালাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন গাজা ভূখণ্ডের সব থেকে দক্ষিণ সীমান্তে রাফায়। প্রাণ বাঁচাতে রাফা সীমান্তে জড়ো হওয়া প্যালেস্তিনি শরণার্থীদের উপরে নির্বিচারে গুলি এবং বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা এবং বিমানবাহিনী।
গাজার সঙ্গে সঙ্গে অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে বিমান হামলা তীব্র করেছে ইজরায়েলের সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধবাজ শাসকরা। সেনা ও দখলদাররা সেখানে ট্যাঙ্ক, বুলডজার নিয়ে প্যালেস্তিনিদের ঘরবাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। ইজরায়েলের গোপন উদ্দেশ্য ক্রমশ প্রকাশ হয়ে পড়ছে, শুধু গাজা নয়, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুজালেম থেকেও প্যালেস্তিনিদের উৎখাত করে নিরাপদ বাফার জোন তৈরি করা।
রাষ্টসঙ্ঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় (OCHA) দ্বারা পরিচালিত ওয়েবসাইট রিলিফওয়েব-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইজরায়েলি সেনাবাহিনী ৭ অক্টোবর, ২০২৩ এর পর থেকে ২৪ এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত ৪২,৫১০ জন প্যালেস্তিনিকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে ৩৮,৬২১ জন অসামরিক নাগরিক, ১০,০৯১ জন মহিলা এবং ১৫,৭৮০টি শিশু। কয়েক হাজারের মৃতদেহ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে, হাজার হাজার নিখোঁজ এবং মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইজরায়েলি সেনা ১৩৭ জন সাংবাদিক, ৩৫৬ জন চিকিৎসা কর্মী এবং ৪২ জন সিভিল ডিফেন্স কর্মীকে হত্যা করেছে। (https://reliefweb.int)
ইঙ্গ-মার্কিন পরিকল্পনায় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে যেদিন ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয় ঠিক সেইদিনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েল হয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুরুপের তাস। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সংযোগস্থলে ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্যের স্বার্থে গণতন্ত্রের আবরণের মোড়কে ইজরায়েলকে একটি শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে মার্কিন ও পশ্চিমী দেশগুলি ধারাবাহিকভাবে মদত করে চলেছে। ইজরায়েল মিশর, জর্ডন, সিরিয়া, লেবাননের সঙ্গে বার বার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। একের পর এক দখল করেছে আরব ভূমি। ইজরায়েল হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী দেশগুলির নয়া ঔপনিবেশিক স্বার্থের উত্তরাধিকার চালিয়ে যাওয়ার জন্য এক তাঁবেদার সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র।
১৯৪৬ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি আমেরিকা ইজরায়েলকে $১৫০ বিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য দিয়েছে। এই সময়পর্বে সারা পৃথিবীতে ইজরায়েলই আমেরিকার কাছ থেকে সব থেকে বেশি পরিমাণ সামরিক সাহায্য পেয়েছে। ইজরায়েলকে সামরিক-রাজনৈতিক মদত দেওয়ার নীতিতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের কোনও বিভেদরেখা নেই। ২০১৬ সালে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে আমেরিকা ইজরায়েলের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য রেকর্ড পরিমাণ $৩৮ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। সেই সামরিক সাহায্য চুক্তির অংশ হিসাবে, ২০২৩ সালে ইজরায়েলে মার্কিন সামরিক সাহায্য $৩.৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। (১ বিলিয়ন - ১০০ কোটি)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, আমেরিকা রাফায় ইজরায়েলের গ্রাউন্ড অপারেশন সমর্থন করে না। কিন্তু ইজরায়েলকে প্রাণঘাতী অস্ত্র পাঠানো থেকে বিরত হয় না। আমেরিকার ইজরায়েল নীতিরও পরিবর্তন হয় না।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বার বার ইজরায়েলকে রাফায় আক্রমণ না চালাতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ইজরায়েল সেই পরামর্শ উপেক্ষা করছে। কারণ তারা জানে আমেরিকা হল ইজরায়েলের সব থেকে বড় রক্ষাকর্তা। গাজায় বর্বরতার মধ্যেই আমেরিকা ইজরায়েলকে $১৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের এফ-১৫ যুদ্ধবিমান সহ সমরসম্ভার বিক্রি করছে।
আগামী ২৪ জুলাই আমেরিকা ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে কংগ্রেসের বিশেষ যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমেরিকান কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়া বিদেশের রাষ্ট্রনায়কদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান। অথচ এই সময়েই ইজরায়েলের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। আমেরিকার কপটতা বিশ্বের দরবারে প্রকাশ হয়ে পড়ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার তেল-গ্যাস ও খনিজ সমৃদ্ধ দেশগুলিতে আমেরিকার আধিপত্যবাদী রাজনীতি-অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। আর্থিক-বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতি ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব অমিরশাহী, মিশর, কাতারের মতো দেশগুলির কাছে পারস্পরিক স্বার্থে অন্যতম পছন্দের বিকল্প হয়ে উঠছে। চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরব তিন দশকের বৈরিতার অবসান করে পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সংকল্প করেছে। সুতরাং আমেরিকা তাদের মুনাফা ও লুন্ঠনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত। আর সে কারণেই তারা যুদ্ধবাজ ইজরায়েলকে প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্নে মদত করে চলেছে।
বেইজিংএ চীনের মধ্যস্থতায় স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের কাজকে ত্বরান্বিত করতে প্যালেস্তিনি সংগঠনগুলির পুনর্মিলনের উদ্দেশ্যে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন ফাতাহ ও হামাসের প্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
অন্যদিকে, বেইজিংএ চীন, মিশর, বাহারিন, সংযুক্ত আরব অমিরশাহী, তিউনেশিয়া সহ আরব দেশগুলোর যৌথ বিবৃতিতে অবিলম্বে গাজা ভূখণ্ডে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করতে এবং প্যালেস্টাইন সমস্যার একটি ব্যাপক, ন্যায্য এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য চেষ্টা চালাবে বলে ঘোষণা করেছে।
এখন দেখা যাক, কত রক্তক্ষয়ের পর গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুজালেমে ইজরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ হয় আর কবে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র জন্ম নেয়।