বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

কেন্দ্রীয় বাজেট সাধারণ মানুষের নয়

কেন্দ্রীয় বাজেট সাধারণ মানুষের নয়

রতন গায়েন

photo

অর্থমন্ত্রী ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেট ভাষণ শুরু করেছিলেন চিরাচরিত উচ্চ আশাব্যঞ্জক শব্দবন্ধ দিয়ে। বললেন, বাজেটের লক্ষ্য হল সর্বজনীন উন্নয়ন, বেসরকারি লগ্নিকে উৎসাহ প্রদান, গৃহস্থালির আয়বৃদ্ধি ও উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। অন্য অনেক প্রতিশ্রুতি আছে। তবে তা রূপায়ণের জন্য স্বাধীনতার শতবর্ষ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
সীতারামন এবারের বাজেটে বেসরকারি লগ্নিকে উৎসাহিত করে বিকাশ ও কর্মসংস্থানের সেই বন্ধ্যা পথের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু গত বাজেটে যুব কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত পাঁচ প্রকল্পে দুই লক্ষ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা এবং চার কোটি যুবক যুবতীর চাকরি ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই সব প্রকল্পে কত কর্মসংস্থান হয়েছে তার কোনও প্রতিফলন এই বাজেটে নেই।
আসলে কর্পোরেট কোম্পানিগুলিকে বিপুল করছাড় ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেও লগ্নির দেখা মেলেনি। নয়া-উদারবাদের পর্বে বিশ্ব মন্দা ও চাহিদা ক্রমাগত নিম্নগামী হওয়ায় কর্পোরেট নির্ভর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যে ব্যর্থ হবে তা অবধারিতই ছিল। বস্তুত ২০১৪ সাল থেকেই এই জুমলা চলছে।
আগের প্রতিশ্রুতিগুলি যে রক্ষিত হয়নি সেই বিষয়ে বর্তমান সরকার সম্পূর্ণভাবে অবগত। জনসমর্থন ধরে রাখার নতুন কৌশল হল মধ্যবিত্ত পরিবারের সমর্থন আদায়। সেই লক্ষ্যে ১ লক্ষ কোটি টাকার আয়কর ছাড়। আশা, এই ছাড়ে মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে তার প্রভাবে নিম্নবিত্তেরও ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। এই অনুমানের দুটি ভ্রান্তি আছে।
এক, অর্থমন্ত্রী জানেন যে সারা দেশে রাজ্য সরকারগুলি বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পে বছরে যে অনুদান বণ্টন করে চলেছে তার পরিমাণ ৩ থেকে ৪ লক্ষ কোটি টাকা। এত বিপুল টাকার অনুদানেও যদি বাজারে চাহিদা তৈরি না হয়, তবে ১ লক্ষ কোটি আয়কর ছাড়ে বাজারে চাহিদা বাড়ার যে আশা এক অলীক ধারণা। দুই, অর্থমন্ত্রী যে মধ্যবিত্তরা আয়কর ছাড়ের সুযোগ পাবেন, তাদের সিংহভাগ স্বচ্ছল পরিবারের। আয়কর বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে যে ৮ কোটি মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন তার মধ্যে ৪ কোটির সামান্য বেশি লোকের আয় ৫ লক্ষ টাকার বেশি। এঁরাই নতুন কর ছাড়ের সুযোগ পাবেন। এই তথ্যে আরও জানা যায় যে, আরও ২.৩৫ কোটি মানুষ আয়কর দিলেও তাঁরা এখনও রিটার্ন দাখিল করেননি। যদি এঁদের প্রত্যেকের আয় বছরে ৫ লক্ষ টাকার বেশিও হয়, তবুও দেশের মাত্র ৬.৩৫ কোটি মানুষের আয় ৫ লক্ষ টাকার বেশি হবে। এই সংখ্যাটি দেশের মোট ৬০ কোটি শ্রমশক্তির ১০.৭৫ শতাংশ। এঁরা কোনওভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পড়েন না, বরং আয়ের নিরিখে দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ পরিবারের মধ্যে পড়েন। আসলে এই আয়কর ছাড়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির যে কোনও সম্পর্ক নেই তা গত বছর ও এবছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকেই স্পষ্ট। গত বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে দেশের কর্মক্ষম যুবসমাজের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে ২০২৪ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত অকৃষি ক্ষেত্রে প্রতি বছর ৭৮.৫ লক্ষ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তাই ২০২৪ সালে কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান পেশ না করার কারণ সহজেই অনুমেয়। এই প্রসঙ্গে দুটি তথ্য বিশেষ উদ্বেগের। একটি হল ২০২৪এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকরত্বের হার ছিল ১০.২ শতাংশ, আর স্নাতকদের মধ্যে এই হার ছিল ১৩ শতাংশ। আরও উদ্বিগ্ন হওয়ার তথ্য হল অতিমারির পরের পাঁচ বছরে নিয়মিত বেতনের কর্মসংস্থানের হার কমেছে এবং কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বেড়েছে। অথচ কৃষি পরিকাঠামোর বিকাশ ও স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকর করার কোনও ঘোষণা বাজেটে নেই। তেমনি অসংগঠিত ও স্বনিযুক্ত শ্রমজীবীদের বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। এবছরের সমীক্ষা অনুযায়ী নিয়মিত বেতনের পুরুষ কর্মীদের মজুরি ২০১৭-১৮ সালে যেখানে ছিল মাসিক ১২,৬৬৫ টাকা, ২০২৩-২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১,৮৫৮ টাকা। স্বনিযুক্তি ক্ষেত্রে পুরুষ কর্মীদের প্রকৃত মাসিক আয় ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৯,৪৫৪ টাকা, ২০২৩-২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮,৫৯১ টাকায়। বস্তুত দেশের আনুমানিক ৬০ কোটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকাংশের আয় কমেছে। এর উপর জিডিপি বৃদ্ধির হার ২০২৩-২৪ এর ৮.২ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪-২৫ সালে হয়েছে ৬.৪ শতাংশ। ফলশ্রুতিতে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির গতিও মন্থর হয়েছে।
এবারের বাজেটে রাষ্ট্রপতির ভাষণ থেকে শুরু করে রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর জবাবি ভাষণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ও দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সোচ্চারে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও ইতিমধ্যেই সঙ্কটে পড়া এই শ্রেণীর জন্য আায়কর ছাড়ের সীমা বৃদ্ধি ও আয়কর কাঠামোর নয়া বিন্যাসে কত শতাংশ প্রকৃত মধ্যবিত্ত উপকৃত হবেন, তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। আবার কর বাবদ সাশ্রয় করা আয় তাঁরা অতিরিক্ত ভোগ্যপণ্য কেনার পিছনে খরচ করবেনই একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আর্থিক সমীক্ষা থেকে এটিও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশের কর্মক্ষম মানুষের ভদ্রস্থ কাজের অভাব রয়েছে। কর্মরতদের বেতন নিয়মিত কমছে ও স্বনিযুক্ত পুরুষ কর্মীদের প্রকৃত মাসিক আয়ও কমেছে। এমতাবস্থায় মধ্যবিত্তদের খুব সামান্য অংশ আয়কর ছাড়ের সীমা বৃদ্ধিতে (৭ লাখ থেকে ১২ লাখ) উপকৃত হলে আপত্তির কোন কারণ থাকতে পারে না। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নামে স্বচ্ছল আয়ের মানুষ ও ধনীদের সরকারি রাজস্ব বিলিকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। আরও বড় আপত্তির বিষয় হল আয়কর ছাড় দেওয়া হয়েছে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের আর্থিক অধিকার হরণ করে। উদাহরণ হিসাবে চিহ্ণিত করা যায় যে, মনরেগা প্রকল্পে (১০০ দিনের কাজের প্রকল্প) এবছরের বাজেট বরাদ্দ গতবারের মতো ৮৬,০০০ কোটি টাকাই রাখা হয়েছে এবং তাতে বকেয়া মজুরির ৬৯৫০ কোটি টাকার হিসাবে ধরা হয়নি। যদি মুদ্রাস্ফীতি ও টাকার পড়তি দামকে হিসাবের মধ্যে ধরা হয়, তাহলে এবছর মনরেগায় বরাদ্দ আসলে কমেছে। একইভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অঙ্গনওয়াড়ি প্রভৃতি সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্পে প্রকৃত বাজেট বরাদ্দ কমেছে। উপেক্ষা করা হয়েছে আয়কর না দেওয়া বেতনভুক কর্মী, দৈনিক মজুরির শ্রমিক, ছোট ও মাঝারি শিল্পের কর্মী, গৃহে কর্মরত মহিলা এবং কর্মহীন যুবশক্তিকে। অবাক করার মতো বিষয় হল, ১ লক্ষ কোটি টাকা আয়কর ছাড়ের পরও অর্থমন্ত্রী অনুমান করেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের ২০২৫-২৬ সালে রাজস্ব আদায় ২০২৪-২৫ এর তুলনায় ১১ শতাংশহারে বৃদ্ধি পাবে।
এই হিসাবের রহস্য একমাত্র অর্থমন্ত্রী জানেন।
আয়কর ছাড় যে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক নয় উপরোক্ত তথ্যগুলি থেকে তা স্পষ্ট। ‘হাউসহোল্ড কনজাম্পশন সার্ভে’ রিপোর্টেও দেখা যায়, গড় বার্ষিক মাথাপিছু খরচ গ্রামে ৪,২২৬ টাকা, শহরে ৬,৯৯৬ টাকা। এই হিসাব সারা দেশের মানুষের গড় খরচের হিসাব। যদি নিচের দিকে আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের গড় খরচের হিসাব করা হয় তবে তাঁদের মাসিক খরচের পরিমাণ অনেক কম হবে। এবং যদি আরো নিচের ২৫ শতাংশ মানুষের খরচের হিসাব করা হয় তবে তা আরও কমবে। একটি চারজনের পরিবার উল্লেখিত গড় খরচের টাকায় খাদ্য, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়া, পরিবহণ, ঋণশোধ, বিনোদন, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং আপৎকালীন পরিস্থিতি সামলে এমন সঞ্চয় থাকবে না যে তাঁরা অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশিত ভোগ্যপণ্য ক্রয় করে বাজারে চাহিদা তৈরি করতে সক্ষম হবে। এই সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০৩০ সাল পর্যন্ত অকৃষি ক্ষেত্রে বছরে ৭৮.৫ লাখ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে মোট জিডিপির মধ্যে ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রের অংশ ছিল ১৫.০৭ শতাংশ যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৯৩ শতাংশ। বিশ্ব বাণিজ্যে ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রে ভারতের অংশ ছিল ২.৮ শতাংশ আর চীনের অংশ ২৮.৮ শতাংশ। কর্মহীন যুব শক্তি, দৈনিক মজুরির শ্রমিক ও স্বনিযুক্তদের ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রে নিয়োগ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র। ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া প্রকল্প’ ডাহা ফেল। আসলে এই বাজেটে নিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, আয়কর ছাড়ের সীমা বৃদ্ধির পরিবর্তে যদি সরকার পেট্রল, ডিজেলের উপর থেকে শুল্ক হ্রাস করত এবং নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর ওপর জিএসটির হার কমাতো, তবে এক বড়সংখ্যক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত যা বাজারে আকাঙ্খিত চাহিদা সৃষ্টি করতে সহায়ক হতো। বর্তমানের সরকারের পক্ষে এই নীতি নেওয়া সম্ভব নয়। জনবিরোধী বাজেট ও অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই করা ছাড়া তোষামোদি পুঁজির ধামাধরা সরকারি নীতির পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.