বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

রুটি ও গোলাপের জন্য শতাব্দী প্রাচীন যে লড়াই…

রুটি ও গোলাপের জন্য শতাব্দী প্রাচীন যে লড়াই…

ঝিলম রায়

photo

সাম্প্রতিককালে ছত্তিসগড় আদালত একটি ধর্ষণের অভিযোগের মামলায় রায় জানিয়েছে, ১৫ বছরের উর্ধ্বে কোনও বিবাহিত নারী যদি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে তাঁর সম্মতি উপেক্ষা করে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম বা কোনও রকম যৌন ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করার অভিযোগ আনেন তবে তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ বিবাহ সম্পর্কের মধ্যে মেয়েদের অসম্মতির কোনও তাৎপর্য নেই। রায়টি বেরিয়েছে ২০১৭র একটি ঘটনায় যেখানে মেয়েটিকে তাঁর স্বামী জবরদস্তি যৌন সঙ্গমে বাধ্য করে এবং তাঁর ফলে মেয়েটির মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে মেয়েটি তাঁর জবানবন্দিতে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেন। হাসপাতালের মেডিক্যাল রিপোর্টও প্রমাণ করে যে মেয়েটির মৃত্যু সেই নৃশংস ধর্ষণের জন্য হওয়া নানান আঘাতের ফলেই হয়। প্রমাণ থাকতেও আট বছর ধরে মামলা চলার পর আদালত ঘোষণা করে এদেশে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণ জায়েজ। বিবাহিত স্ত্রীর শরীরে যেকোনও সময়, যেকোনও উপায়ে নিজের হক জাহির করা ভারতীয় পুরুষের সাংবিধানিক অধিকার।
আর কিছুদিন বাদেই ৮ই মার্চ। ১১৫তম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস। ১৯১০এ শ্রমজীবী মেয়েদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন এই দিনটিকে মেয়েদের রাজনৈতিক সমানাধিকারের দাবিতে সংগঠিত হওয়ার দিন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেই থেকেই এই দিন বহন করে এসেছে শ্রমজীবী মেয়েদের হকের লড়াইয়ের ইতিহাস। বহন করেছে ১৯১৬ এ জারের রক্তচোখ উপেক্ষা করে পেট্রোগ্রাদের মেয়েদের প্রতিরোধের যার ঢেউ নতুন প্রাণ দিয়েছিল বলশেভিক বিপ্লবকে। স্বপ্ন দেখিয়েছিল এক অন্য পৃথিবীর। যে পৃথিবীতে মেয়েদের চার দেওয়ালের শেকল ভেঙে সর্বক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার ও নারী মুক্তির নতুন স্বপ্ন বুনেছিল। তারপর অবশ্য অনেক জল গড়িয়েছে। তবু ঘরে বাইরে, কারখানায়, পরিবারে মেয়েদের জান কবুল লড়াই জারি থেকেছে শতাব্দী জুড়ে। সেই স্বপ্ন আন্দোলিত হয়েছে আমেরিকায় লড়েন্সে কাপড়ের কারখানায় মেয়েদের বেতন বৃদ্ধি ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মস্থলের দাবিতে হরতালে। যে হরতাল স্লোগান তুলেছিলাম রুটির জন্য, গোলাপের জন্যেও। সেই স্বপ্নের ঢেউ খেলেছে ১৯৩৯এর ভারতের একটু একটু করে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলনে যখন বোম্বের বিটিয়া মিলে বহু নারী শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে সেখানকার মেয়েরা দু’দিন ধরে মিলের ম্যানেজারদের ঘেরাও করে রেখেছিল। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যা প্রথম ঘেরাও বলে ধরা হয়। একই স্বপ্ন আলোড়ন ফেলেছিল ১৯৬৮এ ব্রিটেইনের ডাগেনহামের ফোর্ড কোম্পানির গাড়ির সিট তৈরির কারখানায় মেয়েদের ‘সম কাজে সম বেতনের’ দাবিতে অনড় থাকার লড়াইয়ে। যা থমকে দিয়েছিল ফোর্ড কোম্পানির উৎপাদন। বাধ্য করেছিল ‘দক্ষ’-‘অদক্ষ’ কর্মীর সংজ্ঞাকে নতুন করে ভাবাতে। সেই স্বপ্নই নতুন করে প্রাণ পেয়েছে ১৯৪৯ এর চীনের নারী শ্রমিকদের লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রম বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। গৃহকর্ম, সন্তান পালনের সামাজিককরণের নানাবিধ প্রচেষ্টায়। সেই স্বপ্নে বুক বেঁধেই ১৯৪৬এর মন্বন্তরে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি অঞ্চলে অঞ্চলে যৌথ হেঁসেলে গড়ে তুলেছিল যা সলতে পাকিয়েছিল পরবর্তী কালের তেভাগার জান কবুল লড়াইয়ের। সেই স্বপ্ন চোখেই আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৫এ অন্ধ্রপ্রদেশে মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে মেয়েদের সংগ্রামের হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল স্বতন্ত্র নারী আন্দোলন। পণ প্রথার বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটু একটু করে সংগঠিত হতে থাকা আন্দোলন রাজনীতিকরণ করেছিল মেয়েদের সম্মতির প্রশ্ন। রাজনীতিকরণ করে লিঙ্গ হিংসার প্রশ্নকেও। আটের দশকের গোড়ার দিকে পণ প্রথাজনিত নারী খুনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সংগঠন স্ত্রী সংঘর্ষ তাঁদের তৎকালীন লিফলেটে পণ প্রথার জন্য একের পর এক মেয়ের খুনের কারণ হিসেবে কাঠগড়ায় তোলেন ব্যক্তিগত মালিকানার প্রশ্নকেও। পিতৃতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে তাই গোড়া থেকেই ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে থেকেছে ব্যক্তিগত মালিকানা বিরোধী লড়াই। ক্রমাগত প্রশ্ন করে গেছে মেয়েদের শ্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি পরিবার কাঠামোকে। প্রশ্ন করেছে লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রম টিকিয়ে রাখার জন্য টানা গণ পরিসর ও ব্যক্তিগত পরিসরের লক্ষ্মণরেখাকে।
আজ সেই আন্দোলনের পাঁচ দশক পেরিয়ে আবারও কোনও আদালতের রায় বিবাহ মেয়েদের শরীরকে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি করে দেয়। ‘স্বাধীনতার’ ৭৭ বছর পরেও বৈবাহিক ধর্ষণ আইনে স্বীকৃতি পায় না। রাষ্ট্র বারবার মেয়েদের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করে। মেয়েদের সঙ্গী নির্বাচনের অধিকারকে নাকচ করার আইন আনে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে রাষ্ট্র নাক গলায়। রাষ্ট্র বিষমকামী বিবাহ, রক্তের সম্পর্কে-ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুতোয় নির্মিত পরিবার ছাড়া আর কোনও রকম পরিবার-সম্পর্কের ধারণাকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়। তখন আবারও পরিষ্কার হয় এই লড়াইগুলো আসলে কতটা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃ্ক্ত। পরিষ্কার হয় কেন উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা টিকিয়ে রাখতে সামাজিক পুনরুৎপাদনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রাষ্ট্র। পরিষ্কার করে কেন সেই কাজের অবমূল্যায়ন প্রয়োজন এবং কেন সেই অবমূল্যায়ন সংগ্রামে যারা কাজ করে তাঁদের সামাজিক ভাবে তাঁদের সত্ত্বারও অবমূল্যায়ন করতে চায় রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বিবাহিত মেয়েদের বুঝিয়ে দেয় যে বিয়ের পর তাঁর শ্রমের, তাঁর যৌনতায় তাঁর স্বামীর আইনত হক আছে। রাষ্ট্র বুঝিয়ে দেয় যে পরিবার, বিবাহ কাঠামোতে তাঁর মতের, তাঁর সম্মতির কোনও গুরুত্ব নেই। সম্মতির রাজনীতি নিয়ে স্বতন্ত্র নারী আন্দোলনের সূচনার পাঁচ দশক পেরিয়েও এদেশে সেই বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনত অপরাধ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা যায়নি। একই সঙ্গে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়নি তথাকথিত দেশের সুরক্ষার স্বার্থে সেনাবাহিনীর নারী শরীরকে হাতিয়ার করা, ধর্ষণ করার প্রথাকেও। ছত্তিসগড় আদালত যখন এই রায় ঘোষণা করছে তখন তার ঠিক কিছু কিলোমিটার দূরেই বস্তারে সেনাবাহিনী জল জঙ্গল জমি আঁকড়ে লড়ে চলা আদিবাসী মেয়েদের উপর আকাশপথে বোমাবর্ষণ করছে, দেশের সুরক্ষার নামে তাঁদের ধর্ষণ করছে, তাঁদের শরীর ছিন্নভিন্ন করছে, তাঁদের নৃশংস ভাবে হত্যা করছে। নকশাল টেস্টের নামে আদিবাসী মেয়েদের বুক টিপে পরখ করে নিচ্ছে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়। যাঁদের জীবনের মূল্য খুব খুব কম সেনাবাহিনীর মনোবল বাড়াতে তাঁদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার নামে ধর্ষণ করাও তাই এদেশে আইনতভাবে স্বীকৃত।
এই সবের মধ্যেই আবারও একটা ৮ই মার্চ। রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষণা করেছে তাদের এবারের থিম ‘সমস্ত মেয়েদের, নারীদের জন্য অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন’। তারা আহ্বান জানিয়েছে সমস্ত ব্যবসায়ীদের মেয়েদের জন্য আরো বেশি বেশি করে বিনোয়োগ করতে, মেয়েদের ক্ষমতায়ন, সমতা, অধিকার স্বীকৃত করার ভূমিকা নিতে। আহ্বান জানিয়েছে সমস্ত দেশকে লিঙ্গ ন্যায়ের লক্ষ্যে নীতি বানাতে।
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মেয়েদের জন্য হরেক ছাড়ের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যাবে শহর। ধর্ষকদের আড়াল করা রাষ্ট্র নারী শক্তির বাণী আওড়াবে। সপ্তাহে ৭০ ঘন্টা কাজ করার নিদান দেওয়া মালিকরা নারী দিবসে কর্মীদের জন্য বিশেষ হ্যাম্পারের ব্যবস্থা করবে। স্ক্রিন জুড়ে থাকবে পুরুষদের নতুন যন্ত্র কিনে তাঁদের বাড়ির মেয়েদের গৃহশ্রম খানিক লঘু করার আহ্বান জানানো একের পর এক বিজ্ঞাপন। মেয়েদের ক্ষমতায়ন করতে কর্মক্ষেত্র আরো বেশি বেশি করে অসংগঠিতরূপ নেবে। অক্ষত থাকবে লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রমের ব্যবস্থা, লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রম বিভাজন এবং বৈবাহিক, পারিবারিক সম্পর্ক দিয়ে সেই শ্রম সংগঠিত করার কাঠামো। অক্ষত থাকবে এই শোষণমূলক উৎপাদন ব্যবস্থা, এই উৎপাদন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সামাজিক পুনরুৎপাদনের সমস্ত শ্রমের অবমূল্যায়ন করার প্রথা। কিন্তু পুঁজিবাদ যতই এই দ্বন্দ্বকে সামলাতে চেষ্টা করছে ততই তা আরো আরো প্রকট হয়েছে। ১১৫ বছর ধরেও তাই শত বিজ্ঞাপনেও শ্রমজীবী নারী দিবসের সংগ্রামী ইতিহাস মুছে যায়নি। সেই রুটি গোলাপের লড়াই, সেই অন্য পৃথিবী গড়বার লড়াই তাই বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে বার বার। নাগরিকত্বের দাবিতে দেশজুড়ে গড়ে ওঠা প্রতিবাদের প্রতীক শাহীনবাগে। দিল্লি সীমান্তে রাষ্ট্রের বাড়ি ফেরবার ফরমান ছুড়ে ফেলে মাটি কামড়ে পরে থাকা কিসানিদের লড়াইয়ে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিলকিস বানোর একরোখা লড়াইয়ে। অভয়াদের বিচার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কর্মক্ষেত্র, গণ পরিসর দাবি করা রাত দখলের কর্মসূচিতে। গণ পরিসর, ব্যক্তিগত পরিসরের বিভাজন ভেঙে রাস্তায় এনেছে ঢেকে রাখা সামাজিক পুনরুৎপাদনের জীবনদায়ক শ্রমকেও। রাস্তা দখল করে গড়েছে যৌথ হেঁসেল, গড়েছে শিশুদের জন্য ক্রেশ। লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রম বিভাজন মুছে ফেলে সামনে এনেছে অন্যরকম যৌথতার চিত্র, যৌথ যাপনের কথা। সম্পত্তি সম্পর্কের বাইরে গিয়ে গড়েছে সংগ্রামের সংহতির সম্পর্ক, লড়াইয়ের আগুনে গড়া বন্ধুত্ব, কমরেডশিপ। যে সম্পর্ক বারবার আশ্বাস দিতে থাকে এক অন্য পৃথিবী আজও সম্ভব, যা নতুন করে ঢেলে সাজাতে পারে এক শ্রেণীহীন সমাজ। শতবর্ষ আগে পেট্রোগ্রাদের শ্রমজীবী মেয়েরা যে লড়াই শুরু করেছিল সেই দিন বদলের লড়াই তাই আজও ধ্বনিত হতে থাকে নারী মুক্তির স্লোগানে মুখরিত প্রতিটি ব্যারিকেডে। ডাক দেয় খোলা আকাশের নিচে শুধু কিছু রাত নয়, নিজের হকের অর্ধেক আকাশটারই দখল নিতে। ঘরে, বাইরে, ক্ষেতে, কারখানায়, অফিসে, রাস্তায়… রুটির জন্য, গোলাপের জন্য।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.