বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
২০২৩-এর ৭ অক্টোবর নবপর্যায়ে প্যালেস্তাইন-ইজ়রায়েল যে বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু হয়েছে তা প্যালেস্তাইনের ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে লেবাননে সম্প্রসারিত হয়েছে। ইরানও এই যুদ্ধের শরিক হয়ে পড়ছে। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে অতি সক্রিয়তা। অবশ্য প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডটিকে বিভক্ত করে রাষ্ট্রসঙ্ঘ দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেকে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পৃথিবীর প্রথম ইহুদি রাষ্ট্র ইজ়রায়েল গঠিত হয়। আরব দেশগুলি এই ভাগ বাঁটোয়ারা মেনে নেয়নি। যার ফল ১৯৪৮-৪৯ এর আরব-ইজ়রায়েল যুদ্ধ। বহু রক্তপাত ও প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ প্যালেস্তিনীয় আরবের দেশচ্যুতির মূল্যে ইতিহাসখ্যাত এই নাকবা (বিপর্যয়) শেষ হয়।
এই যুদ্ধের বিষময় পরিণতিতে প্যালেস্তাইন তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়: ইজ়রায়েল রাষ্ট্র, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক (জর্ডন নদীর পশ্চিম তট) আর গাজ়া ভূখণ্ড। ভৌগোলিকভাবে সেগুলি আঞ্চলিক হলেও পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কায়েমে তার গুরুত্ব কম ছিল না। পরবর্তী সাড়ে সাত দশক জুড়ে ইজ়রায়েল-প্যালেস্তাইনের যে রক্তাক্ত সংঘাত চলছে, এখনকার হামাস-ইজ়রায়েল যুদ্ধ তাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই যুদ্ধে ইজ়রায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য হল সমগ্র প্যালেস্তাইনের উপর ইজ়রায়েলের আধিপত্য কায়েম করা এবং প্যালেস্তাইনের জাতীয় সত্তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এই প্রকল্পের শরিক আমেরিকা তার পূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে ইজ়রায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কোন বাধ্যবাধকতায় বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমেরিকাকে এমন এক প্রকল্প রূপায়ণে সামিল হতে হয়েছে।
আমরা উপরোক্ত বিষয়টি আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যের বর্তমান প্রেক্ষিতে আলোচনা করবো। অবশ্যই এই আলোচনায় আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই মারণ যুদ্ধ কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেই প্রসঙ্গও আলোচিত হবে।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর দুনিয়ায় আমেরিকা সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আধিপত্যের দাবিদার হয়ে ওঠে। পারমাণু শক্তিধর আমেরিকার শক্তি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের থেকে অনেক এগিয়ে যায়। ভৌগোলিক ভাবে দেশটির অবস্থানের কারণে এবং পার্ল হারবারের আক্রমণ ছাড়া বড়সড় আঘাত না ঘটার কারণে দেশটিকে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়নি। যুদ্ধে বিপর্যস্ত দেশগুলির আর্থিক পুনর্গঠনে অংশগ্রহণ করে আমেরিকা আর্থিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য বেড়ে ওঠে। কিন্তু এই আধিপত্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিস্পর্ধী শক্তির সম্মুখীন হয়। এর মোকাবিলা করতে মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি ও ৪৪টি সহযোগী দেশের প্রতিনিধি আমেরিকার ব্রেটন উডস শহরে মিলিত হয়ে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়। এগুলি হল - (১) আন্তর্জাতিক মুদ্রা হবে ডলার (২) নির্দিষ্ট অঙ্কের সোনার সঙ্গে যার দাম বাঁধা থাকবে, (৩) যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাঙ্ক গড়ে তোলা, (৪) গঠিত হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা।
এই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমেরিকার প্রাধান্য থাকলেও, সোভিয়েত শিবিরের উপস্থিতির কারণে আমেরিকা বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি। বস্তুত ব্রেটন উডস সম্মেলনকে কেন্দ্র করে যে বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি হল তা স্থায়ী হল না। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে স্থির অঙ্কের সোনার সঙ্গে বেঁধে রাখতে অপারগ হওয়ার পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করে। সোভিয়েতের পতনের পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই দাপট ফিরে আসেনি। গণ প্রজাতন্ত্রী চীনের অভাবনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং প্রযুক্তির বিকাশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কায়েম করার পথে বড় বাধা হয়ে উঠছে।
চীনের অর্থনৈতিক উল্লম্ফন আমেরিকার যে রাতের ঘুম কেড়ে নিতে থাকে। ২০০১ সালে চীনের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদানের পর চীনের জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী থেকেছে। ২০০৬ সালে মার্কিন জিডিপি চীনের চেয়ে ৪০০ শতাংশ বেশি ছিল। বর্তমানে মাত্র ৫৮ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে চীনের জিডিপি ছিল বর্তমান মূল্যের হিসেবে ১৬.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং মার্কিন জিডিপি ছিল ২২ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০৩০ সালে চীনের জিডিপি বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়াবে ৩৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মার্কিন জিডিপি হবে ৩০.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। চীন উচ্চমানের প্রযুক্তি ও উৎকর্ষে এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে ইলেকট্রিক গাড়ি, ব্যাটারি, কম্পিউটার চিপস, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পণ্য, ইস্পাত ও সৌর প্যানেল নির্মাণে এগিয়ে রয়েছে। এর জেরে বাইডেন প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করে মার্কিন উৎপাদন শিল্পকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করছে। কিন্তু উল্টো দিকে চীন আমেরিকা থেকে আমদানি করা কৃষি ও অন্যান্য পণ্যের ওপর ১৮৫ বিলিয়ন ডলারের অধিক শুল্ক আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরে পাল্টা চাপ সৃষ্টি করেছে। এই চাপ সামাল দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হবে না। কারণ আমেরিকার কৃষিপণ্য রফতানির চীন প্রধান বাজার। এই বাজার সংকুচিত হলে আমেরিকার সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়বে। ২০২৩ সালে আমেরিকা চীন থেকে আমদানি করেছিল ৪২৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আর চীনে রফতানি করা পণ্যের মূল্য ছিল ১৪৮ বিলিয়ন ডলার।
বস্তুত আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তার মোকাবিলায় চীন, রাশিয়া ও ব্রিকসের সহায়তায় যে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি করতে উদ্যোগী, তা বর্তমান শতকের এক নয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস জোটে এবছরের শুরুতে নতুন পাঁচ সদস্য - ইথিওপিয়া, ইরান, মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর যোগদানে ব্রিকস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকস সম্মেলন থেকে নতুন করে আরও ১৩টি দেশ সহযোগী দেশ হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে। এই দেশগুলি হল - আলজেরিয়া, বেলারুশ, বলিভিয়া, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, কাজাকস্তান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, উগান্ডা, উজবেকিস্তান এবং ভিয়েতনাম।
ব্রিকস, জি৭-এর সমকক্ষ একটি গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকা ও পশ্চিমী শক্তিকে একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে এবং একমেরু বিশ্বকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ইতিমধ্যে ব্রিকস দেশগুলির মধ্যে ডলারের বিকল্প নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেন শুরু হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে সুইফট-এর পরিবর্তে বিকল্প লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে। ব্রিকস ব্যাঙ্ক, বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠছে। বিশ্ব বাণিজ্যে ডলারের গুরুত্ব যত কমছে (ডি-ডলারাইজেশন) ততই আমেরিকা বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় গুরুত্ব হারাচ্ছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান - কোনও দলের পক্ষে এটি যে সুখকর সংবাদ নয়।
এই পরিস্থিতিতে ইজ়রায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে আমেরিকার অতি সক্রিয়তা এবং ইজ়রায়েলকে সর্বাত্মক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বি-ডলারিকরণকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এমতাবস্থায় মার্কিন সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব কোনওভাবে যাতে খাটো না হয় সেই বার্তা নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে পৌঁছে দিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল মরিয়া চেষ্টা করে চলেছে।
এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের লক্ষ্য পূরণে প্যালেস্তাইনকে বলির পাঁঠা বানাতে উভয় দলই সচেষ্ট। কোন দল প্যালেস্তাইনকে নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্পে বেশি উদ্যোগী তা প্রমাণ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অবশ্য এটি কেবল সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। ইজ়রায়েলের জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সহায়ক শক্তি। মার্কিন সামরিক ও আর্থিক মদতে ইজ়রায়েল পশ্চিম এশিয়ায় সবচেয়ে অগ্রণী দেশ। বর্তমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজ়রায়েলকে বিপুল হারে সামরিক ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে চলেছে। সহায়তার হাত প্রসারিত করেছে ব্রিটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলিও। এই দেশগুলির লক্ষ্য হল শক্তিশালী ইজ়রায়েল রাষ্ট্র গঠন এবং পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকা তথা পশ্চিমী দেশগুলির আধিপত্য কায়েম রাখা। ভূ-রাজনীতিতে এই এলাকার উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও আরব দেশগুলির তেল ও খনিজ সম্পদ কব্জা করার বড় হাতিয়ার হিসেবে শক্তিধর ইজ়রায়েল আমেরিকার কাছে বিশেষভাবে প্রয়োজন। তাই প্যলেস্তাইনের বিরুদ্ধে চলছে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। ইজ়রায়েলেরও ঘোষিত লক্ষ্য হল প্যালেস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা।
আমেরিকা ও তার পশ্চিমী মিত্রশক্তির প্যালেস্তাইনকে ধ্বংস করতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়া খুব অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। কিন্তু ভারতের প্যালেস্তাইনের প্রতি চিরাচরিত সমর্থনের নীতি পরিবর্তন সত্যি সত্যিই বিস্ময়কর। লক্ষ্যণীয়, হামাসের অতর্কিত হামলার পর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই ইজ়রায়েলের পক্ষে থাকার বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রী কিছুটা সংযত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নেহরু থেকে বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারত যে জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলত, তা চালাতে আর আগ্রহী নয় মোদি সরকার। ভারত বরাবরই প্যালেস্তাইন নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের দুই রাষ্ট্রের নীতির পক্ষে থেকেছে। তাই ভারতের দোলাচল আমেরিকা ও তার পশ্চিমী মিত্র শক্তিদের যে বাড়তি অক্সিজেন যোগাচ্ছে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের কার্যকর হস্তক্ষেপ ছাড়া এবং স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্তাইন গঠন ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রকল্প রূপায়ণের দাবিতে দেশে দেশে তীব্র জনমত গড়ে উঠলে আমেরিকা ও তার সহযোগী দেশগুলিও নত হতে বাধ্য হবে।