বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

কলম্বিয়ায় পালাবদল এককালের সশস্ত্র গেরিলাই এখন প্রেসিডেন্ট

কলম্বিয়ায় পালাবদল এককালের সশস্ত্র গেরিলাই এখন প্রেসিডেন্ট

পর্যবেক্ষক

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ জুলাই ২০২২— ১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি। শেষ বিকেলে সেদিন হইচই পড়ে গেল কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতা শহরে। সাইমন বলিভারের প্রাসাদ থেকে তাঁর ঐতিহাসিক তরবারিটা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে চারজন সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধা। কারা এরা?
সদ্যগঠিত এম ১৯ গেরিলা গোষ্ঠীর সদস্য। পুরো নাম মুভিমিয়েন্তো ১৯ দে এব্রিল। স্পেনের উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে লাতিন আমেরিকার যেসব এলকা মুক্ত করেছিলেন সাইমন বলিভার, সেগুলোই এখন কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, পেরু আর বলিভিয়া। বিপ্লবী বলিভারের তরবারি উপনিবেশ বিরোধী বিদ্রোহের প্রতীক। তা রাখা ছিল বোগোতায় বলিভারের প্রাসাদ মিউজিয়মে। সেটা ছিনিয়ে যাওয়ার সময় গোরিলার বার্তা রেখে যায়,  বলিভার, আপনার তরবারি ফিরে যাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। মানে মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা। সেদিনের এম ১৯ গেরিলা দলে নাম লিখিয়েছিল ১৭ বছরের এক কিশোর। ৪৮ বছর পরে সেই কিশোরই  ২০২২ সালে ভোটে জিতে কলম্বিয়ার প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট। নাম গুস্তাভো পেট্রো।
১৯৮৫। বোগোতায় অত্যাচারী প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে এম ১৯ গেরিলারা। পরিকল্পনা করা হয়েছে, প্রেসিডেন্টকে বন্দি করে বিচার করা হবে। খবর পেয়ে পাল্টা অভিযানে নামে দেশের সেনাবাহিনী। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ১০০র বেশি গেরিলাকে। সেই অভ্যুত্থানে ধরা পড়ে গুস্তাভো। তখন বয়স ২৭। বিদ্রোহের অপরাধে জেলে কাটাতে হয় দেড় বছর। সেখানে সইতে হয়েছে অত্যাচার। শেষে মুক্তি।
এরপর শুরু হয় পথ হাতড়ানো। ৮০র দশকের শেষে এম ১৯ গেরিলা দল ভেঙে দেওয়া হয়। পেড্রোসহ বাকিরা তৈরি করেন নতুন রাজনৈতিক দল এম ১৯ ডেমোক্রেটিক অ্যালাযেন্স। সেই অ্যালায়েন্সই কলম্বিয়ায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে চেম্বার্স অফ রিপ্রেজেনটেটিভ–এ বেশ কয়েকটি আসনে জয়ী হন। নতুন এই দিশা নিয়ে দলে চলে আলোচনা। এরই মধ্যে ১৯৯৪ সালে পেট্রোর সঙ্গে দেখা হল হুগো শাভেজের। ভেনেজুয়েলায় ১৯৯২এ অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকেও। সাইমন বলিভারের চিন্তাধারা নিয়ে বোগোতায় এক সেমিনারে দেখা শাভেজ ও পেট্রোর।  সম্ভবত সেখানেই দীর্ঘ আলোচনায় ঠিক হয় কাজে লাগাতে হবে নির্বাচনকেও। এরপরে ভোটি জিতে শাভেজের ক্ষমতায় ফেরার কথা আমরা সবাই জানি।
ভোটে লড়তে হলে শক্তি বাড়াতে হবে। টুকরো টুকরো বিপ্লবী গোষ্ঠীতে হবে না। অতএব ১৯৯৪ সালে এম ১৯এর নেতা আন্তনিও নাভারো ভলফ ও অন্যদের সঙ্গে মিলে পেট্রো গড়লেন ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক মঞ্চ ভায়া অলটার্না।  মানে বোধহয় বিকল্প পথে। এক কথায় জোট রাজনীতির পথে এগোলেন কলাম্বিয়ার বিপ্লবী বামপন্থীরা। সেবছর ফের ভোটে জিতলেন পেট্রো, হলেন দেশের সেরা কংগ্রেস সদস্য। ২০০৬এ পেট্রো গড়লেন বৃহত্তর বিকল্প মঞ্চ অলটারনেটিভ ডেমোক্রেটিক পোল। এরপর বহু আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ২০১২–১৪, ২০১৪—১৫ সালে পেট্রো ভোটে জিতে হলেন রাজধানী বোগোতার মেয়র। তারও ৭ বছর পর ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে হলেন দেশের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি। ইতিহাসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলেন কলম্বিয়াকে।
এর মধ্যে ঘটে গেছে আরও এক কাণ্ড। মূল রাজনীতির ধারায় ফেরত আসার পর কলম্বিয়ায় দাবি উঠল বলিভারের ছিনিয়ে নেওয়া তরবারি ফেরত দিন এম –১৯ এর নেতারা।  দাবি মেনে ১৯৯১ সালে মিউজিয়াম থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া বলিভারের তরবারি ফেরত দিলেন এম–১৯এর প্রাক্তন গেরিলারা। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১, এই দীর্ঘ ১৭ বছরগুলি কোথাও লুকানো ছিল এই তরবারি। শোনা যায়, কলম্বিয়ার গেরিলারা বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হাত ঘুরে নাকি সেটা পাঠিয়ে দেন ফিদেল কাস্ত্রোর হেফাজতে। যদিও কোথায় ঠিক রাখা হয়েছিল তা জানাননি কেউই। যাঁরা জানতেন তাঁদের প্রায় সবাই এখন মৃত। ফলে এই ইতিহাস পুরোটা জানাও যাবে না। জানতেন কি পেট্রো?তাও জানা যায়নি।
এই প্রথম বামেরা ক্ষমতায় আসায় কলম্বিয়ার অর্থনৈতিক মডেলে এবার বড়সড় বদল হতে চলেছে। তার চেয়েও বড় কথা এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থেও এবার ধাক্কা লাগবে। ভোটে জিতে পেড্রো জানিয়েছেন, ‘আসল পরিবর্তন এবার আসছে’।  জানিয়েছেন, ধাপে ধাপে জ্বালানি হিসাবে তেল ও কয়লার ব্যবহার কমিয়ে সবুজ অর্থনীতির ওপর জোর দেবেন তিনি। আরও অনেক মানুষকে পেনসনের আওতায় আনবেন।  সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশোনা ফ্রি করে দেওয়া হবে। ধনীদের ওপর কর বসিয়ে এই
অর্থ জোগাড় করা হবে। পেড্রো জানিয়েছেন, স্থানীয় শিল্পকে বাঁচাতে তিনি আমদানি শুল্ককে হাতিয়ার করবেন, বাণিজ্য চুক্তিগুলি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করবেন। এসবই কলম্বিয়ার নয়া উদারবাদী বাণিজ্য ব্যবস্থাকে ধাক্কা দেবে। কয়েক প্রজন্ম ধরে চলা কলম্বিয়ার ড্রাগ কার্টেলের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিতে চান পেড্রো।
তবে বাধাও অনেক রয়েছে। আইনসভায় পেড্রো ও তাঁর সহযোগী দলগুলির হাতে রয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ আসন, রক্ষণশীল দলগুলির হাতে রয়েছে ৫৭ শতাংশ আসন এবং গ্রিন পার্টির রয়েছে ৯ শতাংশ আসন। রক্ষণশীলদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থাও পেড্রোর সংস্কারে বাধা দেবে বলে অনুমান। তাছাড়া স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কও সংস্কারে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তবে পেড্রোর সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটাতে পারবেন বিদেশনীতিতে। ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এর ফলে ভেনেজুয়েলায় মাদুরোকে উৎখাত করার মার্কিন পরিকল্পনা জোর ধাক্কা খাবে। কারণ, বলিভিয়ায় শাসক বদলের জন্য মার্কিন মদতে যতগুলি অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে কলম্বিয়ার মাটি ব্যবহার করে। এবার সেটা বন্ধ হবে।
মনে রাখতে হবে যে, ভেনেজুয়েলা হল বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেলের ভাণ্ডার। কয়েক দশক ধরে এই ভাণ্ডার দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মার্কিন কর্তারা। হুগো শাভেজের আমলে শুরু হয়ে মাদুরোর আমলেও এই ষড়যন্ত্র চলেছে। এখন কলম্বিয়ায় ভেনেজুয়েলার মিত্রশক্তির সরকার মানে আরও একটি নাট্যমঞ্চ আমেরিকার হাতছাড়া হল।
এর ফলে পেড্রো যোগ দেবেন লাতিন আমেরিকার সেই সব নেতাদের দলে যাঁরা একই দৃষ্টিভঙ্গীর ছাতার তলায়  আনতে চান লাতিন আমেরিকাকে, খারিজ করতে চান মার্কিন আধিপত্যকে। ২০১৭ সালে থেকে নেটো চুক্তির অংশীদার কলম্বিয়া। যদি পেড্রো নেটো থেকে বেরিয়ে আসেন তাহলে সেটা হবে মার্কিন ও পশ্চিমী শক্তির কাছে বড় ধাক্কা। এরপর যদি পেড্রোর কলম্বিয়া চীনের সঙ্গে হাত মেলান তাহলে আরও চাপে পড়বে ওয়াশিংটন। এককথায় পেড্রোর জয় কলম্বিয়ায় এক ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন। এটা সেদেশের ও লাতিন আমেরিকার স্থিতাবস্থার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.