বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

নয়া উদারবাদ, জলবায়ু সম্মেলন ও এই পৃথিবী

নয়া উদারবাদ, জলবায়ু সম্মেলন ও এই পৃথিবী

পর্যবেক্ষক

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ নভেম্বর, ২০২১— পত্রিকার এই সংখ্যা যখন পাঠকদের হাতে পৌঁছবে তার আগেই ৩১ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে শুরু হয়ে যাবে COP26 UN Climate Change Conference. চলবে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তন এই গ্রহকে সমূহ বিপদের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এনিয়ে এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। তারও আগে এই গ্রহের বাসিন্দাদের বিপন্ন করে তুলেছে কোভিড অতিমারি। অতিমারি মোকাবিলায় বিশ্বের ধনী-দরিদ্র সব দেশকে হাতে হাত মিলিয়ে যুদ্ধে নামার আর্জি জানিয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। কিন্তু ধনী আমেরিকা ও ইউরোপ সেই আর্জিতে সাড়া দেয়নি। ফলে এখন যখন আমেরিকা বা ইউরোপের নাগরিকেরা কোভিডের টিকার বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ নিতে চলেছেন, তখন আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের নাগরিকেরা টিকার একটি ডোজও পাননি। এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশে এখনও পর্যন্ত অনেকে একটি মাত্র ডোজ পেয়েছেন। অনেকে আবার তাও পাননি। এই টিকা বৈষম্যই দেখিয়ে দিচ্ছে পুঁজিবাদী তথা নয়া উদারবাদী বিশ্বে ধনী ও দরিদ্রে বৈষম্য কতদূর পরিব্যাপ্ত।
অতিমারি মোকাবিলায় বৈষ্যম্যের এই দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেই বসছে জলবায়ু বদলের মোকাবিলায় বিশ্ব সম্মেলন। তার আগেই অবশ্য বিপদের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এই গ্রহের জলবায়ুতে ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে দেখতে হবে যাতে ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বেশি না বাড়ে। এটাই ছিল জলবায়ু সংক্রান্ত প্যারিস সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি। অথচ দেখা যাচ্ছে, সেই লক্ষ্যমাত্রা আদৌ পূরণ হওয়ার নয়। কারণ, বিদ্যুৎ ক্ষেত্র, ভারী শিল্প, কৃষি, পরিবহণ, প্রযুক্তি— এধরনের গুরুত্বপূর্ণ ৪০টি ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা আদৌ প্রত্যাশিত হারে কমছে না। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ উল্টে বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ ইতিমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছে যে, এই গ্রহের আবহমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে যে সব গ্যাস, গত বছরেই সেগুলি বৃদ্ধির নতুন রেকর্ড স্পর্শ করেছে। এবং বিভিন্ন দেশ আগামী দিনে যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে সেগুলো পোড়ানো হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির অনেক বেশি বেড়ে যাবে। এই গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ এই দশকের মধ্যে অর্ধেক কমাতে হবে। এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ধনী দেশগুলির সরকারি বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। রিপোর্ট বলছে, কোথাও সেরকম লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না।
আসলে জলবায়ু বদলের বিপদ থেকে এই গ্রহকে রক্ষা করতে হলে বিপুল পরিমাণ বিনিযোগ বাড়াতে হবে মানবসম্পদ উন্নয়নে, কমাতে হবে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলির ভোগের মাত্রা, বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে বায়ুচালিত ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে। বিনিয়োগ মানে পুঁজির বিনিয়োগ। এবং নয়া উদারাবাদী বিশ্বে পুঁজি এখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের লাগামের বাইরে। মুনাফা লোভী নয়া উদারবাদী, ক্রোনি পুঁজি মুনাফা ছেড়ে মানব উন্নয়নে নজর দেবে না কখনই। কারণ তেমনটা হলে পুঁজি আর পুঁজি থাকবে না। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সেটা সম্ভব নয়। তাই গ্লাসগো সম্মেলনে যত বড় শপথই নেওয়া হোক, তা হবে প্যারিস সম্মেলনের প্রতিশ্রুতির মতোই এক মরীচিকা।
তাই এই গ্রহকে যদি জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে লড়াই গড়ে তুলতে হবে পুঁজির রাজত্বের অবসানের লক্ষ্যে। বড় বড় শপথবাক্যে কিংবা রাষ্ট্রপুঞ্জের আর্জিতে কোনও বরফই যে গলবে না তার জ্বলন্ত প্রমাণ কোভিড অতিমারি আক্রান্ত বিশ্বে চরম টিকা বৈষম্য। ইদানিং রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে নিখাদ পরিবেশ রক্ষা নিয়ে হইচই কম হচ্ছে না। এসবই গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার মতো। কেন একজন মার্কিন নাগরিক টিকার তিনটি ডোজ পান, কেন জার্মানি ও ব্রিটেনে লক্ষ লক্ষ ডোজ টিকা নষ্ট হয়, কেন ইথিওপিয়ার মানুষ টিকার একটা ডোজও পান না, কেন সেখানে দুর্ভিক্ষ ফিরে ফিরে আসে— এই বিষয়টি তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেই সমস্যার মূলে পৌঁছনো সম্ভব হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.