বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো নিম্নভূমি অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের বাসস্থান হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের হচ্ছে। আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু অংশে খরার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সাহেল অঞ্চল এবং ভারতের কিছু অংশে খরা এবং জমির উর্বরতা হ্রাসের কারণে কৃষি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় জনগণ বাধ্য হয়ে চলে যেতে হচ্ছে শহরে বা অন্য দেশে।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় প্রতি বছর।
বেশিরভাগ দুর্যোগ-সম্পর্কিত স্থানচ্যুতি স্বল্পমেয়াদী, তবে ধীরগতিতে শুরু হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিবাসন ধীরে ধীরে আরও স্থায়ী এবং সম্ভবত বড় আকারের হতে চলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূমির অবক্ষয়, উপকূলীয় ক্ষয়, চরম তাপমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য প্রভাব ক্রমান্বয়ে সমগ্র এলাকা (বা কিছু ক্ষেত্রে, সমগ্র দ্বীপ) বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে, গ্রামীণ জীবিকার কার্যকারিতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রতিযোগিতা নিশ্চিত বাড়িয়ে তুলবে এসব বিপর্যয়কারী ঘটনা। ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশীয় মৌসুমী বায়ু পূর্বভারত ও বাংলাদেশে বর্তমান হারের তুলনায় কুড়ি শতাংশেরও বেশি বৃষ্টিপাত বয়ে আনবে -বানভাসি হবেন লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের বড় একটা অংশের। আর সাহারা মরুভূমির আফ্রিকা অঞ্চল পাবে ১০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত, সাহারা আয়তনে বেড়ে সারা আফ্রিকাকেই গ্রাস করতে উদ্যত হবে। বিশ্বব্যাঙ্কের অনুমান যে এসব কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ২১৬ মিলিয়ন মানুষ দেশের মধ্যে সরে যেতে পারেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ মাইগ্রেশন (IOM)-এর অভিমত, “পরিবেশের হঠাৎ বা দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়ের কারণে কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সমষ্টির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে, ঘরবাড়ি হারাতে বাধ্য হলে, সাময়িক বা চিরস্থায়ীভাবে নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হতে বাধ্য হয়ে নিজের দেশের অন্যত্র বা অন্যদেশে চলে যেতে বাধ্য হলে তাদেরকে বলা হবে পরিবেশজনিত উদ্বাস্তু।”
এইসব লক্ষ-কোটি ছিন্নমূল মানুষেরা শুধুমাত্র তাদের সম্পত্তি বা ভূমি হারাবেন তাই না, হারাবেন নিজের পরিচয়, সংস্কৃতি, ধর্ম-সংস্কার, খাদ্যাভাস থেকে পোশাক-পরিচ্ছেদ।
নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে Intergovernmental Panel On Climate Change (IPCC) বিভিন্ন তথ্য, সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান ফলাফল হল লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুতি অর্থাৎ দেশের অন্যত্র বা অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া। কারণ জলবায়ুর স্বাভাবিক চক্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তন। আছে ভূমিক্ষয়, সমুদ্র জলের উচ্চতা বেড়ে উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা বানভাসি হয়ে যাওয়া, চাষের জমিতে বা পানীয় জলে লবণের আধিক্য ঘটা (সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষ চাষী-ক্ষেতমজুর এই সমস্যায় অনেকদিন ধরেই জর্জরিত)। বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আলাস্কা, আন্টার্টিকা, গ্রীনল্যান্ডের মেরুবরফ ও হিমালয়ের মাথায় আচ্ছাদিত বরফের চাদরের অতি দ্রুত গলনও অন্যতম কারণ।
কিরিবাতি দ্বীপের আবাইয়াং-এ তেবুংগিনাকো গ্রাম ইতিমধ্যেই তীব্র উপকূলীয় ক্ষয় এবং লবণাক্ত জলের অনুপ্রবেশের কারণে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে।
কিরিবাতি প্রজাতন্ত্রকে সেই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের কমিটি রায় দিয়েছে যে এই ঘটনা ঘটতে যে সময় লাগবে -প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর -সেই সময়ের মধ্যে কিরিবাতি প্রজাতন্ত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় তাদের জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে এবং প্রয়োজনে স্থানান্তর করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিটির ঐতিহাসিক রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, “যদি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্তিশালী প্রচেষ্টা না করা হয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দুষ্ট হবে। এর ফলে সুবিধাভোগী রাষ্ট্রগুলোয় ‘নন-রিফউলমেন্ট’ (পুনর্বাসন নিষেধাজ্ঞা) চাঙ্গা হয়ে উঠবে।” রায়টিতে আরও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে: “একটি সম্পূর্ণ দেশ জলের নিচে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি এতটাই চরম ঝুঁকি যে, সেই দেশে জীবনযাপনের শর্তসমূহ এই ঝুঁকি বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই সাধারণভাবে মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের যে অধিকার তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।”
এই রায়টি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্র কিরিবাতির এক ব্যক্তি ইওয়ানে তেইটিওটার একটি মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত।
১৯৯০ সাল থেকে পরিবেশ উদ্বাস্তু বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আজকের উদ্বাস্তু সমস্যাটি শুধু স্থানীয় নয়, বরং বিশ্ব সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবেশ উদ্বাস্তু সমস্যা মানবজাতির জন্য একটি ক্রমবর্ধমান সঙ্কট। এটি শুধু পরিবেশের নয়, বরং অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজের বিভিন্ন দিককেও প্রভাবিত করছে। জলবায়ু সঙ্কট যে যুদ্ধের চেয়েও বেশি উদ্বাস্তু তৈরি করছে। ‘অবৈধ অভিবাসী’ দমন করার ওপর জোর দেওয়ার বদলে, সরকারকে আরও বড় একটি সমস্যার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত: পরিবেশের অপরিবর্তনীয় ক্ষতি এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বৃদ্ধি। এই তুলনাটি করার সময় যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে গ্রহণ করা হয়, তবে বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন, ২০২০-এর পরিবেশগত অভিবাসীদের উপর উল্লেখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে বিষয়টির তাৎপর্য স্পষ্ট হবে। তেইটিওটা বিশ্বের প্রথম জলবায়ু উদ্বাস্তু হননি, তবে কমিটির রায়টি মূলত স্বীকৃতি দিয়েছে যে জলবায়ু উদ্বাস্তু আসলে বিদ্যমান, যা রাষ্ট্রসঙ্ঘের জন্য তরফে প্রথম ঘোষণা। রায়টি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যাদের জীবন অত্যন্ত হুমকির মুখে, তাদের জন্য শরণার্থী সুরক্ষার একটি আইনি ভিত্তির স্বীকৃতি দেয়।
এটি বিশ্ব জলবায়ু পদক্ষেপের জন্য একটি মাইল ফলক মাত্র যদিও তা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে বাধ্যতামূলক নয়। তবে এই রায় বিশ্বের সরকারগুলিকে দেখায় যে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে থাকা আইনি দায়িত্বগুলোর উপর বাড়তি প্রভাব ফেলবে। এটি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির নাগরিক এবং সরকারের জন্য ভাল সংবাদ। কারণ দেশগুলি দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পদক্ষেপের জন্য চেষ্টা করে আসছে, কিন্তু তা বহুবারই অবহেলা এবং অস্বীকৃতির সম্মুখীন হয়েছে।
২০২০ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিউম্যান রাইটস কমিটি ঘোষণা করেছে, “পরিবেশগত কারণে যারা অন্য দেশে পালাতে বাধ্য হয়েছেন তাদের কোনওভাবেই অতিথি দেশ থেকে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য করা যাবে না।” কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? উদাহরণস্বরূপ, গত ২০১৯ সালে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আরও বেশি পদক্ষেপ নেওয়া জন্য প্যাসিফিক দ্বীপ ফোরামে টুভালু প্রস্তাব পেশ করেছিল। ফোরামটি অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে সহ ১৮টি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র নিয়ে তৈরি। কিন্তু মূল ঘোষণার কিছু অংশ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের আপত্তির কারণে বাদ পড়ে। অস্ট্রেলিয়া নির্গমন হ্রাস, কয়লা ব্যবহার এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের জন্য তহবিল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, একইভাবে নিউজিল্যান্ডও তহবিল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ফিজির প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক বাইনিমারামা চূড়ান্ত ঘোষণাটির সমালোচনা করে টুইট করেন, “আমরা (ফোরাম) একটি জাতি হিসেবে একত্রিত হয়েছিলাম কারণ আমরা সমুদ্রের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমরা ফোরামের স্থিতাবস্থা ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছি।”
টুভালুর প্রধানমন্ত্রী এন্যেল সোপোয়াগা অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে বলেছিলেন:
“আপনি আপনার অর্থনীতি রক্ষা নিয়ে চিন্তিত... আমি আমার মানুষদের রক্ষা নিয়ে চিন্তিত।” অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতিকালে অস্ট্রেলিয়ায় যে দাবানলগুলি ঘনঘন ছড়িয়ে পড়ছে এবং হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে, তাতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে অস্ট্রেলিয়াকে শীঘ্রই তার নিজের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মোকাবিলা করতে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হতে পারে।
পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষ ও প্রকৃতির স্বাভাবিক সম্পর্ককে বিঘ্নিত করে। পুঁজিবাদ প্রকৃতিকে এক ধরনের পণ্য হিসেবে দেখে, যার ওপর অতিরিক্ত শোষণ চালানো হয়। এর ফলে, প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন বন, মাটি, জল এবং বায়ু অতিরিক্ত ব্যবহার এবং দূষণের শিকার হয়। পুঁজিবাদে মুনাফার জন্য প্রকৃতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়, যা প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট করে। এই শোষণমূলক ব্যবস্থার কারণে, মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক ক্রমাগত দূরত্বে চলে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থায় মানুষ প্রকৃতির শত্রু হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে ওঠে। জলবায়ু-উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। আমরা যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও বড় সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হবে।