বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
একদিকে গাজাকে মৃত্যু উপত্যকা করে তুলতে সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছেন ট্রাম্প। হুথিদের বিরুদ্ধে নতুন করে হামলার নির্দেশ দিয়ে তা কার্যকর করছেন। বলেছেন, পানামা খাল আমরা দখল করে নেব। মেক্সিকো উপসাগরের নাম বদলে দেব। বলছেন, গ্রিনল্যান্ড কিনে নেব। এবং কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম প্রদেশ বানাবো।
অন্যদিকে এই ট্রাম্পই বলছেন, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান চান। সেজন্য চিরশত্রু রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলাতেও তিনি প্রস্তুত। অথচ মূলত মার্কিন মদতেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়েছে জেলেনস্কির ইউক্রেন। চিরশত্রু রাশিয়াকে কাছে টেনে নিতে গিয়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন এতদিনকার নির্ভরযোগ্য মিত্র পশ্চিম ইউরোপকে। অর্থনীতিতে শুল্কযুদ্ধ ঘোষণা করেছেন মিত্র শিবিরের দেশগুলির মধ্যে। তাতেই জোটে ফাটল ধরেছে।
আবার ট্রাম্পের বিদেশসচিব বলছেন, রাশিয়া নয়, তাদের আসল শত্রু চীন। চীনের বিরুদ্ধে কোমর কষে লড়াইয়ে নামছে আমেরিকা। এমনকী চীন হামলা করলে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে সেনিয়ে পেন্টাগন ব্রিফিং করছে ইলন মাস্ককে।
এই যে ট্রাম্পের ত্রিমূর্তি। এর মধ্যে কোনটা তার আসল চেহারা। সঠিক প্রশ্নটা হল, কোনটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আসল চেহারা?
এক কথায় এর উত্তর হল, তিনটিই সেই একই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখ। বিশ্ব পরিস্থিতি আজ এতটাই জটিল যে মার্কিনসহ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের সর্বত্র একইভাবে তাদের আধিপত্য কায়েম রাখতে পারছে না।
ট্রাম্পের এই যে পরস্পর বিরোধী অবস্থানের শিকড় রয়েছে অর্থনীতিতে। মার্কিন অর্থনীতি এখন গভীর সঙ্কটে। খুব সম্ভবত আগামি দিনে তাদের আর্থিক বৃদ্ধির হার আরও শ্লথ হবে। এমনকী ট্রাম্পের নীতির কারণে অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অর্থনীতিবিদেরা। মার্কিন অর্থনীতির স্থায়ী স্থবিরতা, নিজেদের দেশে বিনিয়োগের হার বিপুল পরিমাণে কমে যাওয়া, বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি আর বইতে না পারার অক্ষমতা — এসব কারণে অনেকেই মনে করছেন, অর্থনীতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের দিন এবার ঘনিয়ে আসছে। কর্পোরেটদের সুপার প্রফিট বেড়ে যাওয়া এবং মার্কিন শ্রমজীবীদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া — এটাই মার্কিন অর্থনীতির অন্যতম সঙ্কট। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে ডেমোক্র্যাটদের ছেড়ে ট্রাম্পকে উদ্ধারকর্তা মনে করেছেন মার্কিন ভোটদাতারা। আর ট্রাম্প সেউ সুযোগ নিয়ে মার্কিন কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থরক্ষায় বিশ্বের কোথাও কোথাও আদি উপনিবেশবাদে ফিরে যেতে চাইছেন পুঁজির সুপার প্রফিট আদায়ের লক্ষ্যে। আবার, একই লক্ষ্যে ফিরে যেতে চাইছেন সংরক্ষণবাদী অর্থনীতিতে, যা আসলে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধে চলাচল করবে বিশ্বের যেখানে কাঁচা মাল ও সস্তা শ্রম মিলবে। সেখানে কোনও বাধা এলেই চলবে অর্থনৈতিক অবরোধ। হবে কমলা বিপ্লব। এটাই সংক্ষেপে নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর মূল কথা। সেই উদার অর্থনীতির প্রবক্তা খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আজ সঙ্কটে। সঙ্কটগ্রস্ত মার্কিন অর্থনীতিকে বাঁচাতে গিয়ে নয়া উদারবাদী মুক্ত অর্থনীতির বিরোধিতায় নেমেছেন ট্রাম্প। এমনকী তিনি ডব্লিউটিও চুক্তি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জলবায়ু সঙ্কটের মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি — সমস্ত কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। ট্রাম্পের উল্টোপথে হাঁটার আরও প্রমাণ হল তাঁর শুল্কযুদ্ধ। তবে এযুদ্ধে জয়ের কোনও ইতিহাস নেই।
আরেকদিকে ট্রাম্প চাইছেন আরব দুনিয়ার তেলের ওপর একাধিপত্য। এজন্য তাঁর নির্দেশে গাজাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইজরায়েল। কুর্দদের একাংশের মদতে ইজরায়েলিরা দখল করেছে সিরিয়ার একাংশ। হামলা চলছে লেবাননে এবং জর্ডন নদীর পশ্চিম পাড়ে। এসব এলাকা থেকে প্যালেস্তিনি ও আরবদের তাড়িয়ে ইজরায়েলের বৃহত্তর উপনিবেশ গড়তে চান ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। গোটা আরব বিশ্বের শাসকেরা হাত গুটিয়ে বসে। দূরায়ত এই লক্ষ্য অর্জনেই ট্রাম্পের নির্দেশে রমজান মাসের মধ্যেই গাজায় চলছে নারী ও শিশুমেধ যজ্ঞ। এর সঙ্গে তুলনা করা যায় একমাত্র ফ্যাসিস্টদের ইহুদি নিধনের। সেদিন যাদের গ্যাস চেম্বারে পোড়ানো হয়েছিল, তাদের পরবর্তী প্রজন্মই এখন গাজায় নরমেধ যজ্ঞ চালাচ্ছে। সেখানে ছাড় নেই ক্যানসার হাসপাতালেরও। এখনকার পদ্ধতিটা শুধু আলাদা। এটাই ইতিহাসের পরিহাস।
তবে ট্রাম্প পাঁকে পড়েছেন ইউক্রেন যুদ্ধে। মার্কিনসহ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের মদতে রাশিয়াকে জব্দ করার জন্য ইউক্রেনে কমলা বিপ্লব এবং তার জেরেই ইউক্রেন যুদ্ধ। সামরিক সরঞ্জাম, অর্থ, ছদ্মবেশে সেনা, গোয়েন্দা তথ্য — সবই জোগাচ্ছে আমেরিকা ও ন্যাটো। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা। লক্ষ্য ছিল, দুর্বল ও টুকরো করে রাশিয়ার তেল ও খনিজ সম্পদ লুন্ঠন ও রাশিয়ার বাজার দখল। এই প্রথম দেখা গেল, আমেরিকার আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কোনও কাজে এল না। প্রাথমিক সঙ্কট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রুশ অর্থনীতি। চীনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ গাঢ় হল। চীন ও রাশিয়া, পুরনো ইউরোপকে ছেড়ে, দক্ষিণ গোলার্ধের গরিব দেশগুলির এবং মধ্য এশিয়ার বিশাল বাজারের দিকে নজর দিল। ফলে তাদের পণ্য বিক্রির জন্য মার্কিন বাজারের ওপর দারুণভাবে নির্ভর করার সঙ্কট কাটল। আসলে ২০০৮ সালের সঙ্কটের পর থেকেই চীন পরিকল্পিতভাবে মার্কিন বাজারের বিকল্প বাজার তৈরির কাজে নেমেছিল। তারই অংশ হল ব্রিকস, বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ব্রিকসের ব্যাঙ্ক, শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেসনের মতো আরও নানা বহুপাক্ষিক মঞ্চ। এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প।
ওদিকে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ছকের বাইরে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত চীন বিরাট অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। পাশাপাশি আমেরিকার একচেটিয়া আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় আশঙ্কিত দেশগুলির মঞ্চ হয়ে উঠতে শুরু করল চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে ব্রিকস — যার অন্যতম অংশীদার ভারত। আমেরিকার আর্থিক আধিপত্য ভাঙার এক জোরালো হাতিয়ার। এমনকী ডলারের একাধিপত্য সঙ্কুচিত করার দাবিও জোরদার হল।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সঙ্কটে। গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে লাভ আছে। কিন্তু ইউক্রেনে অল্প কিছু বিরল খনিজ ছাড়া লাভের কিছু নেই। যুদ্ধের মূল লক্ষ্য রাশিয়াকে দুর্বল করার চেষ্টা সফল হয়নি। উল্টে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে ব্রিকস তৈরি করছে একটা বিকল্প আর্থিক দুনিয়া। এই পরিস্থিতিতে নির্বোধ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ কেউ চালাবে না। ট্রাম্প সেটাই করছেন। ইউক্রেনের বিরল খনিজ ভাণ্ডার লুঠে নিয়ে জেলেনস্কিকে ছুড়ে ফেলতে চাইছেন তিনি। লক্ষ্য, রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করে রুশ বাজার কিছুটা দখল করা। এবং রাশিয়াকে কাছে টেনে চীনকে দূরে ঠেলে ব্রিকসকে দুর্বল করা। এই লক্ষ্যে এগোচ্ছেন ট্রাম্প।
এতে তাঁর নীট ক্ষতি, আটলান্টিকের অপর পাড়ে এতদিনের মিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। সাম্রাজ্যবাদের এই অংশটা এখন হীনবল ও দিশাহীন। আমেরিকা তাদের ত্যাগ করলে তারা কী করবে তারা জানে না। কারণ এদের আর্থিক ক্ষমতাও আমেরিকার মতোই সঙ্কটে।
সব মিলিয়ে বিশ্ব এখন তিন দুনিয়ার মুখোমুখি। একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাদের হৃত সাম্রাজ্য ফেরাতে প্রাণপণ সক্রিয়। কিন্তু আর্থিকভাবে হীনবল। সঙ্কট সামলাতে আবার সে ফিরতে চায় পুরনো উপনিবেশবাদে।
সাম্রাজ্যবাদী শিবির দ্বিধাবিভক্ত। তাই ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এবং ইউরোপের বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী শক্তির অর্থনৈতিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সামরিক জোট ন্যাটো দিশাহীন ও হীনবল। তাকে খুঁজতে হচ্ছে তার নতুন ভূমিকা। এটা হল দ্বিতীয় দুনিয়া।
অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি গড়ে তুলতে চায় এক বিকল্প অর্থনীতি ও রাজনীতি। আগামী দশকগুলিতে এই তিন দুনিয়ার শক্তি সংঘাতই বিশ্বের নতুন ভারসাম্য গড়ে তুলবে।
তবে ভুললে চলবে না লেনিনের কথা, সাম্রাজ্যবাদ মানে যুদ্ধ। অথবা ফরাসি সমাজতন্ত্রী জ্যাঁ জয়েস যেমন বলেছেন, মেঘ যেমন পেটের ভেতর বৃষ্টি নিয়ে ভেসে যায়, তেমনি পুঁজির সঙ্কটের গর্ভেই রয়েছে যুদ্ধ। সেই ভয়ঙ্কর চেহারা আমরা দেখছি গাজায়, দেখছি ইয়েমেনে। সাম্রাজ্যবাদ যত হীনবল হবে, ততই সে হিংস্র হয়ে উঠবে। তাই ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদের মদতে গাজার নরমেধ যজ্ঞের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই এখনকার প্রধান কাজ।