বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। ঘটছে জীবনহানি, অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং বাস্তুসংস্থানের ব্যাপক বিপর্যয়। লস এঞ্জেলসের মারাত্মক দাবানলের দগদগে স্মৃতি অর্থনীতির গভীরেও রেখাপাত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন সরাসরি লক্ষ্যণীয় — ভয়াবহ দাবানল, ঘনঘন হারিকেন, রেকর্ড তাপপ্রবাহ এবং অপ্রত্যাশিত ঝড়। এই বিপর্যয়গুলোর পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির অত্যধিক ব্যবহার, বন উজাড় এবং অন্যান্য দূষণের মতো মানুষের তৈরি কারণ দায়ী। সরকারি নীতিতে দ্রুত জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা জোরদার না করলে এই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
IPCC-এর AR6 রিপোর্ট, ২০২৩ অনুযায়ী মানব কার্যকলাপের ফলে তৈরি জলবায়ু পরিবর্তন না ঘটলে ২০২০-এর দশকের চরম তাপমাত্রা, বন্যা, এবং ঘূর্ণিঝড়ের দাপট ঘটতো না। যেমন চলছে তেমনি চললে ২০৫০ সাল নাগাদ আমেরিকায় চরম আবহাওয়ার কারণে মারাত্মক বিপর্যয়কারী ঘটনা আরও ২ থেকে ৫ গুণ বাড়তে পারে যদি বিশ্ব তাপমাত্রা ১.৫°C অতিক্রম করে। অন্য একটি সংস্থা ‘জাতীয় জলবায়ু মূল্যায়ন’ (U.S. National Climate Assessment) এর মতে, উত্তর আমেরিকার মধ্য-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে টর্নেডো ও শক্তিশালী ঝড়ের প্রকোপ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। NOAA জানাছে ১৯৮০-র ক্যাটাগরি ৪-৫ হারিকেনের সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। বাতাসে গ্রীনহাউজ গ্যাসের অপরিমিত বৃদ্ধিই এর কারণ।
আমেরিকার সদ্য নিবার্চিত রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আর্থিক নীতির কেন্দ্রে আছে “আমেরিকা ফার্স্ট” যা আসলে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের সম্প্রসারণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও চাকরি সৃষ্টির অজুহাত জলবায়ু সংকটকে উপেক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, কয়লা খনির পুনরুজ্জীবন এবং আর্কটিক ড্রিলিং-এর মতো প্রকল্পগুলি পুঁজিবাদী অর্থনীতির “অতিলাভ-কেন্দ্রিক” মডেলের প্রতীক, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি স্বল্পমেয়াদি মুনাফার কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি শিরোনামে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে চাইছেন তাতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়বে আর সেকারণে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বায়ুমন্ডল ও সমুদ্রজলের মাধ্যমে তা গোলার্ধের অন্য প্রান্তের মানুষ-নামানুষ ও সামগ্রিক পরিবেশকে বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলবে। মনে রাখতে হবে যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনহাউজ গ্যাস নি:সরণে যথাক্রমে দ্বিতীয় (নি:সরণের মোট পরিমাণে) ও প্রথম (নিস:রণের মাথাপিছু পরিমাণে)।
আমেরিকার অর্থনীতি বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মুদ্রাস্ফীতি, আবাসন সংকট, ঋণ সমস্যা, বাণিজ্য যুদ্ধ, আর্থিক অসমতা এবং শ্রমবাজারের পরিবর্তন সবই অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। আমেরিকার সামনে আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ ডলারের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রা সোনার পরিবর্তে ডলারের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ডলার সোনার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এভাবে ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে সোনার সঙ্গে ডলারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। আমেরিকার রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ও তেল এবং অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবা ডলারে কেনাবেচার কারণে ডলার বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য হারায়নি। সম্প্রতি অবস্থার বড় মাপের পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো ধীরে ধীরে তাদের বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ কমাচ্ছে। ১৯৯০ সালে বিশ্বের মুদ্রা রিজার্ভের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ছিল ডলার, যা ২০২৪ সালে ৫৮ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। বিশ্ব-অর্থনীতি সম্ভবত একটি বহু-মুদ্রা ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির নানা টানাপোড়েনের কার্য-কারণ সম্পর্কের প্রতিফলন এসব যেখানে, ১) ডলারের পাশাপাশি ইউরো, ইয়েন, রেনমিনবি (চীনা ইউয়ান) বড় ভূমিকা পালন করবে। ২) আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্লক স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়াবে। ৩) ডিজিটাল মুদ্রা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। ৪) সার্বভৌম মুদ্রা বন্ড বাজারের বিকাশ হবে।
এই লেখায় এসবের বিশদ আলোচনা বাতুলতা। বলার কথা এই যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকটকে যেভাবে দেশে-দেশে মানুষসহ প্রকৃতির ঘাড়ে চাপিয়ে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা হচ্ছে আমেরিকা তার ব্যতিক্রম নয়।
ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির লক্ষ্য বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ — বিদেশি পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করা বিশেষ করে চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর (ভারত এর কোপে ইতিমধ্যেই পড়েছে)। এছাড়া কর্পোরেশনগুলির জন্য কর কমানো, জ্বালানি এবং পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণবিধি হ্রাস, দেশীয় তেল, গ্যাস এবং কয়লা উৎপাদন বৃদ্ধি করা। ট্রাম্প, বাইডেন আমলে চালু মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইনের (IRA) উপর বিরতি আদেশ দিয়েছেন। এর ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির উন্নয়ন নিরুৎসাহিত করা অথবা বৈদ্যুতিক যানবাহনকে উৎসাহিত করার মতো কর্মসূচি প্রভাবিত হবে। IRA (Inflation Reduction Act) ২০২২ সালে পাস হয়। এই আইনে জলবায়ু কর্মসূচি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনে ভর্তুকির জন্য বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ ছিল।
ট্রাম্পের বিরতি আদেশের লক্ষ্য জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পকে সহায়তা এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া। এই পদক্ষেপ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতিকে ধীরগতি করতে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা বাড়াতে পারে।
আমেরিকার অর্থনীতির বেহাল দশা ফেরাতে আমেরিকার ভোটদাতারা বাইডেনকে সরিয়ে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছেন যদিও সেদেশের জনগণের ৭৩% মনে করেন বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে এবং ৬০% মনে করেন এটি মানুষের কর্মকাণ্ডেরই ফল। বিপরীতে সেদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের অস্তিত্ব ও তীব্রতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি একে একটি “প্রতারণা” বলে অভিহিত করেছেন এবং দাবি করেছেন যে জলবায়ু পরিবর্তন মানব কার্যকলাপের কারণে হচ্ছে না। তবে ভোটদাতারা এর জন্য নির্বাচনে তাকে বিমুখ করেননি। বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে আমেরিকান ভোটাররা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এই জাতীয়তাবাদি প্রচারে আস্থা রেখেছেন এবং আশু ও আপাত লাভের আকাঙ্ক্ষায় পরিবেশ বির্পযয়কে হয় মোকাবিলা সম্ভব বলে মনে করেছেন অথবা একে সুদূর সম্ভবনার তালিকায় রেখেছেন। ট্রাম্প তার শাসনের প্রথম জমানায় (২০১৭-২০২১) জীবাশ্ম জ্বালানি কারবারি কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিশেষ রক্ষাকর্তা হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
ট্রাম্পের পরিবেশ নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি মূলত পুঁজিবাদী স্বার্থ সংরক্ষণ, কর্পোরেট ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিপরীতে জাতীয়তাবাদী অর্থনীতি জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা। ট্রাম্পের নীতিগুলো কার্যকর হলে রাষ্ট্র ও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর মেলবন্ধনে পরিবেশগত সংকট আরও গভীর হবে। ট্রাম্পের শাসনের প্রথম পর্বে ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদক দেশে পরিণত হয়, যেখানে প্রতিদিন ১১ মিলিয়ন ব্যারেল উৎপাদনের রেকর্ড তৈরি করা হয়। এই প্রবণতা বর্তমান সময় পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ২০২১ সালে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর, তাঁর প্রশাসনের আশ্বাসজনক জলবায়ু নীতির পরও, ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচা তেল উৎপাদন প্রতিদিন ১২.৯ মিলিয়ন ব্যারেলে পৌঁছে নতুন রেকর্ড গড়ে।
জীবাশ্ম জ্বালানির সর্বাধিক উৎপাদন ট্রাম্পের কর্পোরেট বান্ধব নীতির প্রতিফলন, যা জলবায়ু সংকটকে উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়লেও বিশ্ব জ্বালানি চাহিদা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ও রাজনৈতিক চাপের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন কমেনি।
জলবায়ু রক্ষা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি সম্প্রসারণের মধ্যে মার্কিন নীতির দ্বৈততা, টেকসই উন্নয়নের প্রশ্নে জোরালো বিতর্ক তৈরি করেছে আমেরিকার মধ্যেই। অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি Cooperation Jackson। মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের জ্যাকসন শহরে অবস্থিত একটি প্রগতিশীল, কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন সংগঠন এটি যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সমবায় অর্থনীতি ও পরিবেশগত ন্যায়বিচার গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন স্থানীয় অধিবাসী, শ্রমিক ও নিপীড়িত সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে গঠিত, যারা যৌথ মালিকানাভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাচ্ছে। Cooperation Jackson শুধু একটি সংগঠন নয়, বরং এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাইরে একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকল্পের প্রমাণ। তাদের প্রকল্পগুলি দেখায় যে সম্প্রদায়ভিত্তিক সমবায়, গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশগতভাবে টেকসই ব্যবস্থা কীভাবে অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যদিও চ্যালেঞ্জ অনেক, তবুও জলবায়ু সংকট ও অর্থনৈতিক অসমতার এই যুগে তাদের সংগ্রাম বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক।
ট্রাম্পের দুই পর্বের শাসনকালের মাঝের চার বছরে শক্তি উৎপাদন প্রসঙ্গে পরিবেশমুখী ভাবনা ও প্যারিস চুক্তিতে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে আর্ন্তজাতিক উদ্যোগগুলিতে আমেরিকা সরকারের দায়বদ্ধতার হিসাব-নিকাশ বোঝা যেত। আগামীদিনে আন্তর্জাতিক এই রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়ে সে দায়টুকুও এড়িয়ে যাবে ট্রাম্প সরকার এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা শুধু পরিবেশবিরোধী নয়। এটি একটি গভীর ব্যবস্থাগত সমস্যার প্রকাশ যার মধ্যে আটকে আছে পুঁজিবাদী পরাক্রমশীলতা, যেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং কর্পোরেট ক্ষমতা সম্মিলিতভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের দিকে ছুটে চলেছে। ট্রাম্পের উত্তরাধিকার প্রশ্ন তোলে: পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কি কখনো জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে? উত্তর খুঁজতে হলে চিন্তা কাঠামোয় এই অর্থনৈতিক মডেলের আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য।