বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১— বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সকল দেশের সমস্যার সঙ্গেই কমবেশি জড়িয়ে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক আধিপত্য, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং সামরিক দাপটের বাস্তবতা। ঔপনিবেশিক, আধা-ঔপনিবেশিক, নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণের জাল আজও পৃথিবী ব্যাপী শুধু ছড়িয়ে থাকাই নয়, তা অত্যন্ত প্রবলও বটে। এ'রকম এক সময়ে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী "১-টি মাত্র দিবস, বাকি ৩৬৪-টি রজনী" (কমরেড সত্যানন্দ ভট্টাচার্য-র ভাষা) যাপন করা কোনও প্রকৃত পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তির কর্তব্য হতেই পারে না। প্রতিমুহূর্তের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-লুন্ঠন-বঞ্চনা-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিমুহূর্তে লড়াই-সংগ্রাম চালানোই কর্তব্য। মিটিং, মিছিল, ভাষণ, প্রবন্ধের মাধ্যমে একদিনের গতানুগতিক, নিয়মমাফিক, গণতান্ত্রিক ও নিরুপোদ্রব 'প্রতিবাদ' নয়। বাস্তবের ময়দানে ৩৬৫ দিনই সংগঠিত করতে হবে লড়াই।
'সাম্রাজ্যবাদ' খারাপ তো বটেই। বিশ্বজোড়া শোষণ, লুন্ঠন, আধিপত্য, অত্যাচার, যুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ … সবকিছুই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বর্তমান কালে শুধুমাত্র কেতাবি সংজ্ঞা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের কীর্তিকলাপের হিসেব মেলানো কঠিন! মনে রাখতে হবে, মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের জীবদ্দশায় পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তর দেখে যাননি। লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে দেখেছেন, কিন্তু তার পারমাণবিক শক্তির বীভৎস দাপট দেখেননি। স্তালিন সেই বীভৎসতা দেখেছেন এবং তা প্রতিরোধের বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই আজও পৃথিবীতে আর কোনও হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটানোর স্পর্ধা দেখাতে পারেনি সাম্রাজ্যবাদ; কিন্তু ভিয়েতনাম-লাওস-কাম্বোডিয়ার উপর বছরের পর বছর সাম্রাজ্যবাদী হামলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও যন্ত্রণা তিনি দেখেননি। মাও-ৎসে-তুঙ সে বর্বরতাও দেখেছেন, কিন্তু আফগানিস্তানের মতো জনগণের উপর বিচিত্র এবং দীর্ঘকালীন সাম্রাজ্যবাদী ও 'সমাজতান্ত্রিক' বৈদেশিক আগ্রাসনের অমানবিক রূপ দেখে যাননি। কমিউনিস্ট শিক্ষকরা কেউই কল্পনাবিলাসী গণৎকার ছিলেন না; তাঁরা ছিলেন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের বাস্তব নেতা। "ব্যাদে সব আছে"-র মতো, শিক্ষকদের 'রচনাবলীতেই সব উত্তর পাওয়া যাবে' ধরে নিলে বিভ্রান্তি অনিবার্য। তা'হলে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার সংগ্রামী কর্তব্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
মাও-পরবর্তী দুনিয়ায়, এই মুহূর্তে আবার সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা আফগানিস্তানের 'তালিবান' শাসন সেখানকার মানুষের জীবনে আবার নতুন ক'রে এক অন্ধকার যুগের সূত্রপাত ঘটিয়েছে; এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী বর্বর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। আমরা যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে বসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনাবলী জানার পর, নানা তত্ত্ব ও তথ্য সহযোগে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি, তাঁদের বিচারে আফগান শাসকদের মধ্যে কারা 'খারাপ' আর কারা 'ভাল', সে বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক মূল্যায়ন নিয়ে আফগান জনগণের কিছুই যায়-আসে না। আমাদের দু'চারটে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরেও তাঁদের অবস্থার বিন্দুমাত্র হেরফের আগেও হয়নি, এখনও হবে না। আফগান জনগণের ভয়ঙ্কর জীবনযন্ত্রণা উপলব্ধি করা তো দূরের কথা, আমরা তার বীভৎসতা কল্পনাও করতে পারবো না! বিভিন্ন সময়ে, ভারতবর্ষের যে কোনও প্রান্তে শাসকের হামলায় একজনের মৃত্যুও দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। আফগানিস্তানে যুগযুগ ধরে লক্ষলক্ষ মানুষের হত্যাকারী বৈদেশিক শক্তির রাজনৈতিক চরিত্র 'সাম্রাজ্যবাদী' নাকি 'সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী' অথবা 'সমাজতান্ত্রিক', তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সাগ্রহ ও অনিঃশেষ আলোচনা/ বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু জনগণের কাছে একমাত্র/ প্রধান বিচার্য বিষয় তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সমসাময়িক ও ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। গুলি বুকে লেগে মৃত্যু হ'লে, সেই বুলেটের চরিত্রবিচারে ভুক্তভোগীদের কোনও আগ্রহ থাকতে পারেনা। বৃহত্তর কিম্বা ভবিষ্যৎ 'প্রগতি'-র কোনও আশ্বাস নিহতের পরিবারকে শান্তিও যোগাতে পারেনা। আফগানিস্তানেও এই মুহুর্তে জনগণের কাছে প্রধান বিচার্য বিষয় সেখানকার তালিবানী নিষ্ঠু্র বর্বরতা, নির্বিচার হত্যাতান্ডব, মধ্যযুগীয় নারীবিদ্বেষ, এবং কদর্য ধর্মীয় পৈশাচিকতা। নানা উত্থানপতনের মধ্য দিয়েও আফগান সমাজে যতটুকু অগ্রগতি ঘটেছে দীর্ঘকাল যাবৎ, তাকে বরবাদ ক'রে আফগানি সমাজকে আবার অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চরম প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপগুলোই সেখানকার মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এ'কথা ঠিকই, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আফগানিস্তানে একসময়ে হাজির হয়েছিল তার নিজস্ব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই। বাজার দখলের উদ্দেশ্যে আফগানিস্তানকে আগ্রাসী রাশিয়ার প্রভাবমুক্ত করার জন্য; তার নিজের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রয়োজনে সেখানকার সোনা তামা ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দখলদারীর লোভে; সে দেশে অকল্পনীয় দামে বিপুল যুদ্ধসরঞ্জাম চালান করে নিজের অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙ্গা করার লক্ষ্যে; প্রতিযোগী চীন-সংলগ্ন অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখার কু-অভিপ্রায়ে 'তালিবান'-এর সৃষ্টি ও বৃদ্ধিকে মদত দেওয়ার বদ উদ্দেশ্যে, ইত্যাদি মানবতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল কারণে। এ'বার আমেরিকার নিজের তৈরি উগ্র-ধর্মীয় দানব 'তালিবান' তার বিরুদ্ধেই অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরেছে। 'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন' তৈরি করলে চিরকালই যা হয়!
আফগান জনগণের সত্যিই যেন কপালপোড়া! বারবার তাঁরা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক (!) এবং ধর্মীয় পাষন্ডদের হামলার শিকার হচ্ছেন! ১৯৭৯ সালে তাঁদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক (!) সোভিয়েত ইউনিয়নের হামলার। ২৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য আফগানিস্তানে ঢুকেছিল। হত্যা করা হয়েছিল গদিচ্যুত রাষ্ট্রপতি হাফিজুল্লাহ আমিনকে। কাবুল শহর পুরোপুরি সোভিয়েত সৈন্যর দখলে চলে যায়। দু'তিন দিন পরেই দেখা যায় পুরো দেশে তখন রয়েছে ৫০ হাজার রুশ সৈন্য, এক হাজার ট্যাঙ্ক এবং বহু যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার এবং সাঁজোয়া গাড়ি। দেশের নানা জায়গায় সোভিয়েতের এই দখলদারীর বিরোধী বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলোর উপরেও হামলা চলতে থাকে সোভিয়েত সেনাদের। সোভিয়েত সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল, "যেসব কারণে সেখানে সোভিয়েত সৈন্য গেছে, সেইসব কারণগুলো দূর হয়ে গেলেই আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরিভাবে সোভিয়েত সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়া হবে।" আরও লিখেছিল, সৈন্য পাঠানোর হয়েছে ১৯৭৮ সালে স্বাক্ষরিত 'রুশ-আফগান মৈত্রী চুক্তি' অনুযায়ী। (১৯৭১ সালে যেমন স্বাক্ষরিত হয়েছিল 'ভারত-রুশ মৈত্রী চুক্তি'।) একমাসের মধ্যে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়বার উদ্দেশ্যে ছ'টি আফগান সংগঠন মিলেমিশে একটা সংগঠন গড়েছিল। রুশ-সৈন্যের সংখ্যা তখন বাড়তে বাড়তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ। শহর এবং আশপাশ ছাড়া, ২৮টির মধ্যে ২২টি প্রদেশই সোভিয়েত বিরোধী বিদ্রোহীদের দখলেও চলে যায়। প্রায় ২০ লক্ষ আফগানের মৃত্যু এবং প্রায় ৬০ লক্ষ আফগানদের উদ্বাস্তু হয়ে পাকিস্তান ও ইরানে যেতে বাধ্য হয়েছিল - সবমিলিয়ে এক অন্ধকারের সাক্ষী হয়েছিল তখনকার আফগানিস্তান। কাবুলের বিদেশী কূটনীতিবিদরা জানিয়েছিলেন, "নতুন আফগান সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের হত্যার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।" সোভিয়েত পত্রিকা তখন লিখেছিল, "ডিসেম্বরের ঘটনার পর থেকে আফগানিস্তানের ভিতর জীবনযাত্রা শান্তিপূর্ণ হয়ে আসছে।" সোভিয়েতের গায়ের 'সমাজতান্ত্রিক' ছাপ আফগান জনজীবনে কোনও সান্ত্বনা যোগাতে পারেনি।
গত শতাব্দীর '৫০-এর দশকে হাঙ্গেরিতে, '৬০-এর দশকে চেকোস্লোভাকিয়ায়, '৭০-এর দশকে আফগানিস্তানে - একের পর এক সামরিক অভিযান নিঃসন্দেহেই সোভিয়েত বৈদেশিক নীতির একেকটি মাইলফলক। 'বিপ্লব রপ্তানি'-র তাগিদ নাকি 'আধিপত্য বিস্তার'-এর বাসনা, কোনটা তাকে সামরিক তৎপরতায় বারবার উদ্বুদ্ধ করেছে, ইতিহাস তার জবাব বুঝে নেবেই।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ (লেনিন) বিভিন্ন সময়ে, নানা লেখায়, বারবার একটা শব্দ ব্যবহার করতেন - "সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী"। ১৯১৫ সালে তিনি বললেন, "বিভিন্ন নেশনের উপর আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে বৃহৎ-শক্তিধর নেশনগুলোর তরফ থেকে ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ"-র কথা; এবং একই সঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করলেন, "এটাই হ'লো বর্তমান সময়ে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ-এর অর্থনৈতিক ভিত্তি।" ('The Collapse of the Second International'; V.I.Lenin, Collected Works, Vol. 21, Progress Publishers, Moscow, 1974, p: 243 দ্রষ্টব্য।) নভেম্বর বিপ্লবের আগের বছরে (১৯১৬) লিখলেন, "বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক প্রোলেটারিয়েটরা একদিকে শভিনিস্ট এবং 'সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী', অপরদিকে বিপ্লবী - এই দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে।" (C.W., Vol. 22, p: 342 দ্রষ্টব্য।) বিপ্লবের বছরে (১৯১৭) তিনি বললেন "সকল দেশের সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদে" কথা। (C.W., Vol. 24, p: 561 দ্রষ্টব্য) এবং বিপ্লবের পূর্বমুহূর্তে উল্লেখ করলেন "রুশ ও জার্মান সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদীদের নোংরা কৌশল" [dirty tricks] সম্পর্কে। (C.W. Vol. 25, p: 242 দ্রষ।টব্য।) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দেই তিনি সুস্পষ্ট ভাষাতে লিখেছিলেন, "সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী মানে কথায় সমাজতন্ত্রী, কিন্তু কাজে সাম্রাজ্যবাদী।" ('Imperialism, The Highest Stage of Capitalism', V.I. Lenin, Collected Works, Vol. 22, Progress Publishers, Moscow, 1964, p: 285 দ্রষ্টব্য।) ১৯১৯ সালে লেনিন আবার লিখলেন, "সুবিধাবাদ অথবা সংশোধনবাদ, অনিবার্যভাবেই এদেরকে বিশ্বজোড়া তাৎপর্যপূর্ণ একটি ব্যাপারে [phenomenon] পরিণত করবে [grow] - সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ।" একই লেখায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, "পুঁজিবাদ সম্পর্কে নীরস মামুলি কিছু কথা বলে [platitudes] শ্রমিকদের যারা প্রতারিত করে, সেইসব অজ্ঞ অথবা ভন্ডরাই একমাত্র এই রূঢ় সত্যকে আড়াল করে যে, সমাজতন্ত্রের মধ্যেকার একটি পুরো ধারাই সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের দিকে চলে গেছে। এরা এ'কথা বুঝতেই পারেনা যে, সাম্রাজ্যবাদের অধীনে তাদের এই পরিণতি অর্থনৈতিকভাবে অনিবার্য।" ('The Tasks of the Third International"; V.I.Lenin, Collected Works, Vol. 29, Progress Publishers, Moscow, 1965, p: 502 দ্রষ্টব্য।)
লেনিন এইসব কথাগুলো লিখেছিলেন আজ থেকে ১০৬-১০২ বছর আগে। আফগানিস্তানকে কেন্দ্র ক'রে একাধিক সমাজতান্ত্রিক (!) দেশের তালিবান-সমর্থক ভূমিকা বর্তমানে আবার লেনিনের রচনাগুলোকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ক'রে তুলেছে।
১৯৮০ সালের ১৪ জানুয়ারি, রাষ্ট্রসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের এক বিশেষ জরুরি সভা হয়িছিল। সেখানে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের নিন্দা ক'রে ১০৪-টি দেশ একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। প্রস্তাবে বলা হয়, "এক্ষুনি, নিঃশর্তভাবে, সব" রুশ সৈন্য আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হোক। রুশ হস্তক্ষেপের পক্ষে ভোট দেয় মাত্র ১৮-টি দেশ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই প্রস্তাব সম্পর্কে তদানিন্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান লিওনির ব্রেজনেভ বলেছিলেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই সিদ্ধান্ত হল আফগানিস্তানের ব্যাপারে জঘন্য হস্তক্ষেপ। হ্যাঁ, ব্রেজনেভ আরও একটা কথা বলেছিলেন: আফগানিস্তানে যা করা হয়েছে তা না করে "অন্য কোনও পদক্ষেপ" নিলে আমাদের "সোভিয়েত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা" থাকতো না। এই খবরটা বেরিয়েছিল রুশ সংবাদপত্র 'প্রাভদা'-য়, ১৯৮০ সালের ১৩ জানুয়ারি।
সমাজতান্ত্রিক (!) সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারী এবং তার পরিণতি কার্যত "চিরচিহ্ন দিয়ে গেল" আফগানিস্তানের "অপমানিত ইতিহাসে"! আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাস যেভাবে কয়েক দশক ধ'রে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের জীবন্ত দলিল হয়ে রইলো, তা বিশেষভাবে স্মরণীয়।

সরাসরি সোভিয়েত আধিপত্যের এক দশক পর, আফগানিস্তানে তালিবানী দাপটের শুরু। এই সময়কালে আভ্যন্তরীণ হানাহানিতে নিহত হয় প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ। আমেরিকার 'টুইন টাওয়ার' ধ্বংসের পর, ২০০১ সাল থেকে সেখানে সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দখলদারী আরম্ভ। দশ বছর পর, ২০১১ সালে আফগানিস্তানে উপস্থিত মার্কিন সেনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লক্ষেরও বেশি। ২০১৫ সালে বলা হয়, আফগানিস্তানে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। 'বডি কাউন্ট রিপোর্ট'-এ বলা হয়েছিল, নিহত মানুষের সংখ্যা ১ লক্ষ ৬ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৭০ হাজারের মধ্যে। ৫ মে ২০১৫ তারিখের হিসাব অনুযায়ী, "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধে, এক দশকে নিহত হয়েছে ১৩ লক্ষ মানুষ।" একসময়ে দেখা গেলো, শিশুমৃত্যুর হার সেখানে সবচাইতে বেশি এবং বড়দের প্রত্যাশিত আয়ু সবচাইতে কম। ২০ বছর মার্কিন মোড়লির পর, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে, কাতার-এর রাজধানী দোহা-তে আমেরিকা ও তালিবান-দের মধ্যে এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ'বছর (২০২১) ১৪ এপ্রিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন, ১ মে থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আমদানি করা বিপুল পরিমান অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র তালিবানদের হাতে রেখেই, আমেরিকার সেনা প্রত্যহার শুরু হয়। এখন আবার তথাকথিত মানবিকতার খাতিরে সেখানে শুরু হয়েছে তালিবানদের সঙ্গে মার্কিন সেনার গুলিবিনিময়!
দখলদারী চালানো যে কোনও শক্তির প্রচার কৌশলে বিভ্রান্ত হলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কর্মসূচি কার্যত এক অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। 'ভবিষ্যৎ'-এর যুক্তি দেখিয়ে 'বর্তমান'-এর চূড়ান্ত জনবিরোধী কাজকে সমর্থন যোগানো, একধরনের বালখিল্যপনা কিম্বা রাজনৈতিক শয়তানি। শাসকগোষ্ঠির প্রচারিত পরিসংখ্যানে অভিব্যক্ত সমাজের প্রগতি কীভাবে জনগণের দুর্গতি-কে আড়াল করে, তা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা জানি।
ইতিহাসের "অচেতন অস্ত্র" ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যখন নিজেদের স্বার্থে ভারতবর্ষে রেল লাইন চালু করার সময়ে হাজার হাজার ভারতীয় জনগণের সীমাহীন দুর্গতি ও মৃত্যুর ইতিহাস রচনা করছিল, সমাজপ্রগতির সমর্থকদের তখন তার প্রতিবাদ প্রতিরোধ না-করাই বোধহয় শ্রেয় ছিল! কংগ্রেস রাজত্বের সময়ে নানা ধরনের 'উন্নয়নমূলক' কাজকে সমর্থন করার জন্য, সুন্দর সমাজের সৈনিক কয়েক হাজার কমিউনিস্ট কর্মীকে হত্যার অমানবিক ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ করা সম্ভবত উচিত ছিল না! বিজেপি আমলে কয়েক হাজার কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরকার টাকা পাঠানোর কারণে, কয়েক লক্ষ কৃষকের অভূতপূর্ব ও সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের বিরোধিতাই তা'হলে কৃষকবান্ধব কর্তব্য! পশ্চিমবঙ্গে 'বাম' শাসনে কিছু 'ভাল' কাজের হেতু, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র হত্যার এবং শিল্পপতিদের নির্লজ্জ দালালির মতো নীতি-নৈতিকতাহীন ঘটনাগুলোকে প্রতিবাদহীনভাবে মেনে নেওয়াই বোধহয় 'প্রগতিশীল' কর্তব্য ছিল! তৃণমূল কংগ্রেসের রাজত্বকালে কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্য সাথী, সবুজ সাথী, লক্ষ্মীর ভান্ডার ইত্যাদি বহুবিধ কর্মসূচির জন্য, ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলা কদর্য জনবিরোধী ঘটনাগুলোরও নিন্দা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার কথা তা'হলে ভাবাই উচিত না!
সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম এবং সমাজতান্ত্রিক চীন যখন সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ১৯৭৯ সালে এবং তাতে মৃত্যু ঘটে কয়েক হাজার মানুষের, এখানকার অনেক সমাজতন্ত্রী এবং 'সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী' শক্তি তখন মৌনব্রত অবলম্বন করাকেই সুবিধাজনক মনে করেছিলেন! কারণ কোনওদিকেই তখন 'পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ' ছিলনা, তাই 'প্রগতিশীল' অবস্থান নেওয়া বড়ো কঠিন ছিল!
'ভবিষ্যৎ'-ই একমাত্র কিম্বা প্রধানত বিচার্য বিষয়, 'বর্তমান' শুধুই আগামীর দিকে এগিয়ে চলার সাময়িক একটি অধ্যায় মাত্র, - এ ধরনের ভাবনা মানবসভ্যতার পক্ষে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। সভ্যতার যাত্রাপথে 'ভবিষ্যৎ' সর্বদাই অনিশ্চিত, অজানা, অনির্দিষ্ট, ধারণা মাত্র। কখনও যে হিসেব হয়তো মিলে যায়, কখনও মেলেনা। কিন্তু 'বর্তমান' সর্বদাই জীবন্ত বাস্তব। এটা সমাজবিকাশের একটা পরীক্ষিত শিক্ষা।
'সাম্রজ্যবাদ বিরোধী দিবস' বাছাবাছা ঐতিহাসিক কিছু ঘটনাবলীর স্মৃতিচারণের দিন শুধু হতে পারেনা। শুধুমাত্র লৈখিক বা মৌখিক কিম্বা শৈল্পিক বিরোধিতায় সাম্রাজ্যবাদের বিন্দুমাত্র কিছু এসে যায় না। তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের উপর সরাসরি আঘাত নেমে এলো কিনা, সেটাই সাম্রাজ্যবাদের কাছে মূল বিচার্য বিষয়। যেকোনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তার স্বার্থরক্ষাকারী 'দেশীয়' তাঁবেদার ও সহযোগী শক্তিগুলোর মুখোশ উন্মোচন, এবং তাদের বিরুদ্ধেও প্রকৃতই আপোষহীন সংগ্রামের পথে এগোতে হবে। কারণ তারাই নানা দেশে স্থানীয়ভাবে পুঁজিবাদ-সাম্রজ্যবাদকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম সামাজিক খুঁটি। পুঁজিবাদকে বাড়িয়ে তোলার এবং শক্তিশালী করার; বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার এবং তাদের বিস্তার ঘটাবার; আধুনিক পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন সংসদীয় গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার এবং শক্তিশালী করার ব্রত নিয়েই এইসব 'দেশীয়' এবং বস্তুত প্রগতিবিরোধী রাজনীতিবিদদের যাবতীয় কাজকারবার।
সভ্যতার অগ্রগতি ঘটতে ঘটতে একটা সময়ে এসে যে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছিল, তারই বিশেষ এক স্তরকে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদ। হাজার রকম অপকর্ম করলেও, মানবসভ্যতাকে পিছন দিকে আর সে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়ায় বহু ধরনের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রতীকও সে। কিন্তু 'তালিবান' হল সামগ্রিক বিচারে সভ্যতাকে বর্বরতার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি। সামাজিক পশ্চাদগতির প্রতীক তারা। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ও মদতেই তার সৃষ্টি এবং বাড়বাড়ন্ত। অসভ্যতা ও বর্বরতাই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। নারীজাতিকে ঘৃণ্য অত্যাচার করা এবং মধ্যযুগীয় দাসত্বের শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা তাদের অন্যতম চারিত্রিক বিশেষত্ব। শরিয়তি 'আইন'-এর তথাকথিত নিদান এবং 'উন্নত' দেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া আধুনিকতম সয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের শক্তি, এই হল তাদের প্রধান মূলধন।
আফগানিস্তানকে কেন্দ্র ক'রে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক বাজার এবং রাজনৈতিক সাম্রাজ্য দখলে আগ্রহী শক্তিগুলো বর্তমানে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। একদিকে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি বনেদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। অপরদিকে ইসলামিক পাকিস্তান, সমাজতান্ত্রিক (!) চীন, পুঁজিবাদী রাশিয়া ইত্যাদি বিচিত্র শক্তি। লক্ষ লক্ষ আফগান জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি এদের কারও কাছেই প্রধান ও মূল লক্ষ্য নয়। সকলেরই আসল লক্ষ্য ভূ-রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব বিস্তার। এটাই কঠিন সত্য। কেউ 'ক্রোধ'-এর ভড়ং দেখিয়ে তালিবান-এর হাতে আধুনিকতম যুদ্ধসরঞ্জামের জোগান দিয়ে চলেছে; কেউ তথাকথিত মানবতার দোহাই পেড়ে আবার আফগানিস্তানের উপর কব্জা কায়েমে তৎপর; কেউ বা নির্লজ্জের মতো প্রকাশ্যেই চরম প্রতিক্রিয়াশীল তালিবান শাসনকে সমর্থন জানাচ্ছে। মানব-সভ্যতা এবং সমাজ-বিকাশ নিয়ে এদের কারুরই বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। শ্রমিক শ্রেণী সহ ব্যাপক জনগণের স্বার্থ একেবারেই এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; সম্পূর্ণ এবং সংকীর্ণ আত্মস্বার্থ (অর্থাৎ নিজেদের রাষ্ট্রস্বার্থ) রক্ষাই এদের সকলের কাছে কাম্য।
স্তালিনের মৃত্যুর তিন বছর পরে, ১৯৫৬ সালে মাও-ৎসে-তুঙ বলেছিলেন: মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দেখতে বাঘের মতো, কিন্তু আসলে সে "কাগুজে বাঘ" ('paper tiger'), জল ও বাতাসের সামনে সে টিঁকতে পারেনা। এ'কথা যে কতখানি সত্যি, তা প্রমাণ হয়ে গেছে এই উক্তির মাত্র দু'দশকের মধ্যেই। ভিয়েতনাম-লাওস-কাম্বোডিয়া থেকে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সংগঠিত সশস্ত্র গণবিদ্রোহের "জল ও বাতাস"-এর প্লাবনে সেখান থেকে পারমাণবিক শক্তিধর আমেরিকার পাততাড়ি গোটানোর ঘটনায়। কৌশলগতভাবে সাম্রাজ্যবাদের 'পারমাণবিক দাঁত'-কে গুরুত্ব দিতে হবে অবশ্যই, কিন্তু নীতিগতভাবে প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই যে আসলে 'কাগুজে বাঘ', সেকথাও মনে রাখতে হবে। সঠিক দিশায় পরিচালিত গণবিদ্রোহের অভিঘাতে শেষপর্যন্ত তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর দ্বারা সংগঠিত প্রতিটি আগ্রাসি কর্মকান্ডের, এবং তাদের সকল সহযোগীদেরই বিরোধী হতে হবে। ভারতবর্ষে যুগযুগ ধরে শোষণ চালিয়ে যাওয়া বিপুল সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোর সক্রিয় বিরোধিতায় তৎপর হতে হবে যথার্থ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিগুলোকে। বর্তমানে দৃঢ়তার সঙ্গে এবং বলিষ্ঠভাবে সমর্থন জানাতে এবং সহযোগিতা করতে হবে আফগানিস্তান সহ সারা পৃথিবীর শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের স্বার্থকে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার আর কোনও শর্টকাট এবং তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক পথ' নেই!