বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২২— প্রকৃতির সম্পদ নিজের বেঁচে থাকার জন্য ব্যবহার করা পুরো জীবজগতের সাধারণ রীতি, যার মধ্যে পড়ে জল, মাটি, হাওয়া, ইত্যাদি। আমরা এও জানি যে এর মধ্যেই রয়েছে এক নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্র, যেমন উদ্ভিদের ফল, পাতা খেয়ে নিরামিষাশী প্রাণীর বেঁচে থাকা আবার তাদের খেয়ে মাংসাশী প্রাণীর বেঁচে থাকা। সেই আদিমকাল থেকে মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে পর্যন্ত মানুষও এই স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের অংশ ছিল, প্রকৃতির সঙ্গে ছিল তার এক সাধারণ বিপাকীয় সম্পর্ক (Natural Metabolism)। পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা বলে মানুষ প্রজাতি হিসেবে কোনও একদিন এই সাধারণ প্রাকৃতিক সম্পর্কের ওপরে উঠতে চেষ্টা করেছিল (ইয়ুভাল নোয়া হারারির ব্যাখ্যায় জ্ঞানভিত্তিক বিপ্লবের (Cognitive Revolution) হাত ধরে), আর তারপর প্রকৃতির স্বাভাবিক বৃদ্ধির ওপর সে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করতে চেষ্টা করেছিল (Agricultural Revolution), যা শেষমেশ আজ প্রকৃতির ওপর নির্মম প্রভুত্ব করার চেষ্টায় পর্যবসিত হয়েছে। সহজ করে বোঝাতে গেলে এই প্রশ্নগুলো করলেই চলে যে মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী কি সাধারণভাবে নিজের ইচ্ছামত কোন জায়গায় নির্দিষ্ট গাছ লাগিয়ে তার ফসল আহরণের চেষ্টা করেছে (কৃষি) বা অন্য পশুকে পোষ মানিয়ে তার কোনও গুণাবলী বা শক্তিকে নিজের সুবিধায় ব্যবহার করেছে (পশুপালন বা উৎপাদন/পরিবহণে তার ব্যবহার)? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল – ‘না’। কিন্তু এটাই তো মানুষের বৈশিষ্ট্য যা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তাকে সমগ্র জীবজগতের মধ্যে বিশিষ্টতা দিয়েছে এবং তা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে হয়নি, যেমন এককোষী অ্যামিবার তুলনায় শিম্পাঞ্জী অনেক বেশি উন্নত প্রজাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিবর্তনের নিয়ম মেনেই। কার্ল মার্কস তাঁর সুবিখ্যাত পুঁজি (Capital) গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বলছেন যে এতদূর পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিপাকীয় সম্পর্কে কোন চিড় ধরে নি। কিন্তু এরই ভেতরে একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর তা হল ব্যক্তিগত মালিকানার উৎপত্তি (ভাবুন যে আর কোনও জীব নিজের উত্তরপুরুষের জন্য সম্পদ জমিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে?), যেখানে প্রতি ব্যক্তি নিজের বা নিজের বংশজের জন্য নির্দিষ্ট করে আরও বেশি সম্পদ আহরণের চেষ্টা করে, এবং বস্তুত শক্তিশালী-দুর্বল, পুরুষ-নারী, লম্বা-বেঁটে, ইত্যাদি ব্যবধান-নিরপেক্ষভাবে একটা সম্মিলিত প্রজাতি হিসেবে বাঁচার প্রাকৃতিক বন্দোবস্তকে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। প্রজাতির মধ্যেই একে-ওপরের বিরোধ বাঁধে নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণ ও সঞ্চয়ের চেষ্টা নিয়ে যা মানব সভ্যতার চলনের এক কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে থেকেছে। এবং কোনও সন্দেহ নেই যে এই ভাবনারই এক চূড়ান্ত ফল হল আধুনিক পুঁজিবাদ যা প্রকৃতির ওপরে অত্যাচারকে নিয়ে গেছে এক চরম সীমায় – আজ মানুষ উন্নত বিজ্ঞানের সহায়তায় জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ধানের গড়ন বদলে দেয়, সে শুধুমাত্র উদ্ভিদ নয়, ইচ্ছেমত পশুও চাষ করে, গরু-শুয়োর বা ছাগলের শরীরে বেশি মাংস চাপায় যাতে তার রসনার তৃপ্তি হয়, ইত্যাদি। আবার মার্কসের কথা ধার করে বলা যায় যে আধুনিক পুঁজিবাদ মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকীয় সম্পর্ক থেকে সরিয়ে নিল (Metabolic Rift), মানুষ নিজেকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে না দেখে প্রকৃতির প্রভু ভাবতে শুরু করল, যেন সে প্রকৃতি-নিরপেক্ষভাবে বেঁচে থাকতে সক্ষম, পুরো জীবজগৎ ধ্বংস হয়ে গেলেও যেন তার কিছু যায়-আসে না, লক্ষাধিক বছর ধরে বেড়ে ওঠা পাহাড় বা অরণ্য সে এক লহমায় ডিনামাইট দিয়ে বা মেশিন চালিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে, তাদের সমস্ত প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রসহ। ঘটনা হল যে বর্তমান পৃথিবীর ‘পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা’ আসলে এরই ফসল যেহেতু প্রকৃতি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানের নিয়মেই এই গতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে যাতে করে পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে এবং পৃথিবী রক্ষা পায়। যে পৃথিবী আজ থেকে প্রায় ৭০ লক্ষ বছর আগে দু-পেয়ে মানুষের ধাত্রীভূমি হয়েছিল, আজ মানুষেরই কর্মকাণ্ডের ফলে সেই পৃথিবী মানুষের (পড়ুন জীবজগতের) বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠছে। এই দ্বন্দ্ব শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমরা কেউ জানি না, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি যে বেশ ঘোরালো সেটা বোধহয় আমরা সবাই বুঝতে পারছি।
চারদিকে তাই আলোচনা দেখা যাচ্ছে যে কিভাবে এমন শক্তি (Energy) উৎপাদন করা যায় যা আগের মত প্রকৃতির অতটা ক্ষতি করবে না। চতুর্দিকে চেষ্টা চলছে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, সমুদ্রশক্তি, ইত্যাদিকে আর্থিকভাবে লাভজনক করে উৎপাদনের। অর্থাৎ মানবসভ্যতার নিয়ন্ত্রকরা এখনো ব্যবস্থার মুনাফাকেন্দ্রিক গতিপথ পাল্টানোর কথা ভাবছেন না, চেষ্টা করছেন শুধু প্রকরণগুলিকে খানিকটা বদলে নেওয়ার। যেমন কয়লাখনি নির্ভর তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে না, বদলে সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তি বা পরমাণুশক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে, অথবা তেল দিয়ে গাড়ি না চালিয়ে ব্যাটারি দিয়ে বা হাইড্রোজেন দিয়ে চালানো হবে, ইত্যাদি। এই ভাবনার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটা বিশ্বাস কাজ করছে এবং সেটা হল পুঁজিবাদী যে ব্যবস্থাটার ওপর গত ২০০ বছর পৃথিবী চলছে সেটার সঙ্গে প্রকৃতির কোনও মূলগত বিরোধ নেই, উৎপাদন প্রকরণগুলো খানিকটা বদলে নিলেই একটা সমঝোতা সম্ভব যাতে করে প্রকৃতি ও পুঁজিবাদ অনায়াসেই সহযাত্রী হতে পারে, কোথাও কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু অনেকেই সেটা মনে করছেন না এবং সেই কারণেই দুনিয়াজোড়া বেশ জোরালো আওয়াজ উঠেছে – SYSTEM CHANGE, NOT CLIMATE CHANGE! আমাদের দেশে এখনো বিষয়টি বেশ অগভীর ভাবনার জায়গা থেকে ‘পরিবেশ বনাম উন্নয়ন’ হিসেবে রাখা হলেও, পৃথিবীর বহু মানুষ অনেকটা তলিয়ে দেখে বলছেন যে বিষয়টা আসলে ‘প্রকৃতি বনাম পুঁজিবাদ’। স্বভাবতই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সুবিধাভোগীরা (তার মধ্যে আমরাও অনেকে হয়তো পড়ি) ব্যাপারটা সেভাবে দেখতে রাজি নন, তাঁরা পুঁজিবাদী উন্নয়নের পক্ষে, শুধুমাত্র কিভাবে ঘরের বাতানুকূল যন্ত্রটিকে চালিয়ে রেখেই ‘বেজায় গরম’, ‘দূষিত হাওয়া’, ‘বন্যা’, ‘সাইক্লোন’, বা ‘পৃথিবী ধ্বংস’ গোছের ঝামেলাগুলো এড়ানো যায় তার রাস্তা খুঁজতেই উৎসাহী। এই অংশের কাছেই সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ধরনের বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ শিল্পপতিদের কাছেও কারণ তারাই এই সংক্রান্ত গবেষণায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন যেহেতু ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি থেকেও বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা, এবং এটা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেছেন যে এই শক্তিক্ষেত্রে বিনিয়োগের কারণেই গৌতম আদানি গত কয়েক বছরে মুকেশ আম্বানিকে পেছনে ফেলে দেশের সবচেয়ে বিত্তশালী মানুষ হয়ে উঠেছেন।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে বিতর্কটার মধ্যে আসলে দুটো আলাদা প্রশ্ন লুকিয়ে আছে।
১) কিছু প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই (পড়ুন লাভজনকভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন) কি প্রকৃতি ও পুঁজিবাদের মধ্যে একটা সমঝোতার রাস্তা বার হতে পারে এবং কোনওভাবেই পুঁজিবাদী উন্নয়নের গতিরোধ না করেই কি সেটা করা সম্ভব?
নাকি,
২) প্রকৃতি ও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা মূলগতভাবেই একে ওপরের প্রতিপক্ষ যেখানে আর বেশি দিন এদের সহাবস্থান সম্ভব নয়?
আরও বহু বিতর্কের মতই এই বিতর্কের ফলাফলও এখনো ঘোষিত নয়, দুই যুযুধানপক্ষ (পুঁজিবাদী উন্নয়নের পক্ষে ও বিপক্ষে) তাই নানা উদাহরণ, ব্যাখ্যা ও যুক্তিতর্ক নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। বর্তমানের বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলাফল দেখে পুঁজিবাদের বাদীপক্ষ খানিক বেগতিকে থাকলেও, বিবাদীপক্ষের অবস্থাও খুব সুবিধার নয়, কারণ পুঁজিবাদ পরবর্তী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তখনকার (এখনো কাল্পনিক) উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কতটা আলাদা হবে তার কোনও পরিষ্কার রূপরেখা তাদের কাছেও নেই। ফলে বিষয়টার মধ্যে একটা বড়রকম ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে।
এরই ফল হিসেবে পরিবেশ বিতর্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন এমন মানুষদের মধ্যে মোটামুটি গোটা চারেক ধরন দেখা যাচ্ছে।
ক: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে লাভজনকভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থাকে দাঁড় করালেই সমস্যার সমাধান হবে। এরা স্পষ্টতই ওপরের ১ নম্বর পয়েন্টের সঙ্গে সহমত।
খ: গরীব, আদিবাসী মানুষের জল-জঙ্গল-জমি কেড়ে নিয়ে কয়লা খনি, খাদান, ইত্যাদি করতে দেওয়া যাবে না, কিন্তু উন্নয়নও তো হতে হবে এবং তার জন্যে তেল-কয়লা বাদ দিয়ে লাভজনকভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থাকে দাঁড় করাতে হবে। ভাবলে বোঝা যায় যে এরা আসলে পুঁজিবাদের হাতে জল-জঙ্গল-জমি দখল হওয়া, মানুষের জমিহারা হওয়া, ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে সনাতনী লড়াই সেই লড়াইয়ের কথাই বলছেন, প্রকৃতি-পরিবেশের বিষয়টার দার্শনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বটা তাদের মননে এখনো অনুপস্থিত, এবং ফলত অন্তত এই প্রসঙ্গে বাস্তবিকভাবে তাঁরা ১ নম্বর পয়েন্টের পক্ষেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।
গ: পুঁজিবাদী উন্নয়নের মডেলের বিরোধিতা করতে হবে। দেউচা-পাঁচামীর কয়লাখনির জন্য আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমি কেড়ে নেওয়ার বিরোধিতা করতে হলে কর্ণাটকে হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার চাষজমি কেড়ে নিয়ে সোলার প্যানেল বসানোর বিরোধিতাও করতে হবে। চিরাচরিত কাহিনী অনুযায়ী ধানবাদের ঝরিয়ায় রাক্ষুসে গর্ত খুঁড়ে তোলা কয়লা বা যদুগোড়ার শিশুদের জন্মপঙ্গু বানিয়ে তোলা ইউরেনিয়াম যেমন আসলে বৃহৎ শিল্পপতির মুনাফা এবং উচ্চবিত্ত জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের কাজে ব্যবহার হয়, অর্থাৎ লাভ করেন কেউ আর মূল্য চোকান আরেকজন, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা সেই একই কাজ চালাবে, ফলে তার বিরোধিতা করতে হবে। যেমন কম্পিউটার বিপ্লবের কয়েক দশক বাদে ধনী দেশগুলো তাদের ভয়ানক ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য আমাদের মতো দেশে চালান করে, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সঞ্চয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাটারি ও তার দূষিত রাসায়নিক ঠিক তেমন ভাবেই নদী, পাহাড়কে দূষিত করবে, কাজেই তারও বিরোধিতা করতে হবে। অর্থাৎ বলা যায় যে এরা ২ নম্বর পয়েন্টের সঙ্গে বেশি সহমত, কিন্তু সমস্যা হল যে পরিবর্ত বন্দোবস্ত, সেই অবস্থার মানবসভ্যতার শক্তিচাহিদা ও সেটার উৎপাদন করতে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে তার বিপাকীয় সম্পর্ক কি দাঁড়াবে তার কোন স্পষ্ট উত্তর এদের কাছেও নেই।
ঘ: অত ঝামেলার দরকার নেই, সেই অরণ্যচারী জীবনে ফিরে যাওয়াই ভাল। এদের সম্পর্কে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। এদের অবস্থানের উত্তর বোধহয় ঋষি অরবিন্দের গান্ধী প্রসঙ্গে রসিকতাতেই পাওয়া যাবে। গান্ধী যখন জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করছিলেন কারণ সেটা কৃত্রিম, তখন নাকি অরবিন্দ বলেছিলেন – “Civilization is artificial, so is Gandhi’s loin cloth”!
এমনকি ক অবস্থানও খুব একটা বিতর্কের অবকাশ দেয় না কারণ ক অবস্থানের পক্ষে মানুষরা সম্ভবত বর্তমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগীর তালিকায় পড়েন, তিনি গৌতম আদানিও হতে পারেন, বড় সরকারি আমলাও হতে পারেন অথবা বড় বেসরকারি চাকুরে। এদের শ্রেণী অবস্থান নিয়ে সংশয় নেই, এরা এই বন্দোবস্তের সপক্ষে, শুধু বিজ্ঞানের কাছ থেকে পরিবেশ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার একটা আশু বন্দোবস্ত খুঁজছেন।
তাই মূলত খ আর গ অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক হবে। প্রথমে খ অবস্থান বিষয়ে আসা যাক। সহজে বোঝার জন্য আলোচনাগুলো খনি-খাদান ও খনন শিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। গত শতাব্দীর ’৬০-’৭০-এর দশকে বলিভিয়ার টিন খনিতে যে লড়াই হচ্ছিল তার চেহারা ছিল সনাতন ‘শোষণের মাধ্যমে সঞ্চয়’ (Accumulation by exploitation)-এর বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেখানে তার চেহারা ছিল খনি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা ও সংগঠনের মাধ্যমে মালিকের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু এই লেখায় যে প্রসঙ্গ এসেছে তা খানিকটা আলাদা, কারণ আজ এই লড়াই দাঁড়িয়েছে ‘উৎখাতের মাধ্যমে সঞ্চয়’ (Accumulation by dispossession)-এর বিরুদ্ধে লড়াই, এবং সেখানে সনাতনী শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই, সেখানে বরং পরিবেশের ক্ষয়, পরিচিতি সত্ত্বা ও সংস্কৃতির ক্ষয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এবং এই কারণেই সারা পৃথিবী জুড়েই শাসকরা এই ‘আদি বাসিন্দা’ (আদিবাসী) পরিচিতির অধিকারটাকে ফেলে দিতে চাইছে, যেমন ২০১৩ সালে পেরুর প্রধানমন্ত্রী আন্দিজ পাহাড়ের কুইচুয়া আর আইমারা উপজাতিদের আদিবাসী পরিচয়টা সরিয়ে দিয়েছেন, এদেশেও অরণ্য আইনে বদল এনে গ্রামসভার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও নিশ্চিতভাবেই একই দিকে ইঙ্গিত করে। কাজেই খ-বাবুদের একটা বিস্তারিত পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। রামপুরহাটের পাহাড় ও পাথর, জটের থান, আদিবাসী জীবন ধ্বংসের বদলে ঝাঁ চকচকে নিউটাউন, একি সেই চিরাচরিত ভারত বনাম India-র গল্প নয়? আর তাই যদি হয় তাহলে আসামের মিকির বামুনি গ্রামের মানুষদের কি হবে যাদের বিরাট পরিমাণ জমি অ্যাজুর পাওয়ার-এর হাতে সোলার প্যানেল বসানোর জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে? শুধু পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে? এই সমস্যার উত্তর কি কালো (কয়লা) বনাম সবুজ (পুনর্নবীকরণযোগ্য) শক্তির মধ্যে পাওয়া যাবে? অন্যদিকে ঠিক যেমন আমেরিকার ১৫২টি পরিত্যক্ত পাথর খাদানকে পরিষ্কার করার জন্য সেদেশের সরকারকে আজ ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি ভারতীয় টাকা খরচ করতে হচ্ছে (Office of the Inspector General i), ঠিক তেমনই সিলিকনের সোলার প্যানেল বানানোর জন্য যে পাথর ও বালি খাদান হবে সেটা সামলানোর খরচ (যদিও আমরা এখনো সিলিকন বাইরে থেকে আনি, নিজেদের প্রযুক্তি নেই), বাতিল ব্যাটারির বিষাক্ত রাসায়নিক সামলানোর খরচ কে জোগাবে? তাই এই ধরনের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মোট খরচ হিসেবে শুধু কিছু ক্ষতিপূরণ নয়, পরিবেশ ও তার পুনরুদ্ধার, স্থানীয় মানুষের জীবন, সংস্কৃতির মূল্য, এই সবই ধরতে হবে। আর তাই উৎখাত ও মুনাফার কাহিনী একই রেখে পরিবেশের সমস্যার সমাধান করা যাবে কিনা তার একটা বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রয়োজন বলে মনে হয়। এবং ‘কর্মসংস্থানের’ নামে পুঁজিবাদী উন্নয়নকে সমর্থনের প্রশ্নকেও আবার বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
এই প্রসঙ্গে আমাদের এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যায়। বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমানের বেআইনি পাথর ভাঙ্গার কারখানায় কাজ করতে গিয়ে বহু শ্রমিকের সিলিকোসিস নামের একটি রোগ হয় যার কোন নিরাময় নেই, মৃত্যু নিশ্চিত থাকে। এই প্রসঙ্গে সরকার ও বেআইনি কারখানার মালিককে কাঠগড়ায় তুললে অনেকেই বলেন যে এই কারখানাগুলো আটকালে স্থানীয় মানুষের চলবে কি করে? অথচ তাঁরা ভুলে যান যে এই সেদিন প্লাস্টিক ব্যবহারে কিছু নিষেধাজ্ঞা এনে রাজ্য সরকার ৬০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ও কয়েক হাজার মানুষের জীবিকা বন্ধ করেছে, হয়তো প্লাস্টিকের প্রভাব শহরের মানুষের জীবনেই বেশি দেখা যাই বলেই। ফলে সাময়িক কর্মসংস্থানের নামে ভয়ঙ্কর শোষণ, এমনকি মৃত্যুকেও যুক্তিগ্রাহ্য করে দেখানোর অভ্যাস ত্যাগ করা প্রয়োজন। খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে এই একই উন্নয়নের যুক্তি নরেন্দ্র মোদি বা মুকেশ আম্বানিও দেখান। কাজেই আজকের পরিস্থিতির অনেকগুলো চারিত্রিক বদলকে মাথায় নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।
সবশেষে আসি গ অবস্থান সম্পর্কে। সম্ভবত পাঠক এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে লেখক হিসেবে আমার পক্ষপাত গ অবস্থানের দিকেই। এই পুঁজিবাদী উন্নয়নের রাস্তায় প্রকৃতি-পরিবেশের বিপন্নতার অন্তিম উত্তর বেরনোর সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই মনে হয় যদিও কোন মূলগত পরিবর্তন খুব সহজেও আসবে না। বহু লড়াই, রক্ত ও সংশয় নিয়েই এগোতে হবে। কিন্তু বেছে বেছে বিরোধিতা নয়, এই গ্রহকে বাঁচাতে হলে এই ধরনের সমস্ত প্রকল্পকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা প্রয়োজন। প্রতিটি এমন প্রস্তাবের সঠিক লাভ-ক্ষতির (কার লাভ, কার ক্ষতি? পরিবেশের ধ্বংস কার অ্যাকাউন্টে যাবে?) হিসাব ছাড়া এমন কোনও কিছুকেই এক পাও এগোতে দেওয়া যাবে না। এমন লাগাতার বিরোধিতার মুখেই একমাত্র রাষ্ট্র থমকে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু এই বিরোধিতা কখনোই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিরোধিতা হতে পারে না, কারণ ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্যে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। পুঁজিবাদ পার হয়ে ভবিষ্যতের উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃতির বিপাকীয় বন্দোবস্ত পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাও একমাত্র বিজ্ঞানের হাত ধরেই আসতে পারে। ফলে ব্যবস্থার পরিবর্তন যেন বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিরোধী না হয়ে ওঠে।
তাই ‘প্রকৃতি বনাম পুঁজিবাদ’ আজকের দুনিয়ার সম্ভবত সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন, যার সামনে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে, আমাদের সবাইকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে – “কোন দিক সাথী, কোন দিক বল, কোন দিক বেছে নিবি তুই?”