বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

পরিবেশ আন্দোলন: কিউবা ও শ্রীলঙ্কার প্রতিতুলনা

পরিবেশ আন্দোলন: কিউবা ও শ্রীলঙ্কার প্রতিতুলনা

অরূপ ঘোষ

photo

১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভেঙে দেওয়া এবং ১৯৪৪ সালে ইউনাইটেড নেশন এর অধীনে ব্রেটন উডস সম্মেলন মারফত লগ্নি পুঁজির নতুন কাঠামো গঠন হওয়া, সমাজতান্ত্রিক ও শ্রমিক আন্দোলনের একটি বিরাট পরাজয় যদিও সেদিন তা কমিউনিস্ট চেতনাতে ধরা পড়েনি। সেটা ধরা পড়ল অনেক পরে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ব্যবস্থা পতনের মধ্য দিয়ে। উন্নত বিশ্বের বৃহৎ শিল্পগুলিকে টুকরো-টুকরো করে সারা বিশ্বে আউটসোর্স করার ভিতর দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল।
কিন্তু আজ লাতিন আমেরিকার দেশগুলি জুড়ে যেমন নতুন এক ধরনের বামপন্থী আন্দোলনের উত্থান হচ্ছে, ঠিক তেমনি সোভিয়েত ব্যবস্থা পতনের পর ছোট্ট একটি দেশ কিউবা যেভাবে আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের নাকের ডগায় বসে আমেরিকা অবরোধসহ সমস্ত ধরনের আক্রমণকে প্রতিহত করছে। শুধু তাই নয়, আমেরিকা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে কিউবা এক উন্নত মডেলও খাড়া করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তাই কিউবার আলোচনা সামনে এনে আজকের সমাজতান্ত্রিক পথের নতুন এক অনুসন্ধান করার জন্য এই লেখা।
কিউবার উত্থান
কিউবা দীর্ঘদিন স্পেনের উপনিবেশ ছিল। ১৮৯৮ সালে স্পেন ও আমেরিকার যুদ্ধের ফলে কিউবা স্পেনের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়। কিউবায় প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয় ১৯০২ সালে। কিন্তু কিউবার প্রজাতান্ত্রিক সরকার কার্যত আমেরিকার পুতুল হিসেবে থেকে গেল। কিউবার চিনি উৎপাদনের কারখানাগুলি ও আখের চাষের জমিগুলি দখলীকৃত হয় আমেরিকা ধনকুবেদের দ্বারা। এই পর্বে ড্রাগ মাফিয়াদের প্রাধান্য ও যৌন ব্যবসার বাড়-বাড়ন্ত জনজীবনের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে দেয়। ফলে পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বিপুল আকার ধারণ করলে, ১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবাতে এক বিপ্লবী সরকারের পত্তন হয় এবং সমস্ত জমিকে সরকার জাতীয়করণ করে নেয়। এই সময়ে সোভিয়েত দেশ সাহায্যের হাত কিউবার দিকে বাড়িয়ে দিলে কিউবা কার্যত আমেরিকা আগ্রাসনের মুখে পড়ে। কিন্তু আমেরিকা অবরোধ থাকলেও, কিউবা অর্থের সম্পর্কের বাহিরে বেরিয়ে এসে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে। যেখানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতাটাই মূল বিচার্য বিষয় ছিল। কিউবা মূলত চিনি ও নিকেল পাঠাত সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলিতে, বিনিময়ে তারা পেত খনিজ তেল, বেশ কিছু খাদ্য, ঔষধ ও প্রযুক্তি।
সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন ও কিউবার চলার নতুন পথ
সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের ফলে কিউবা সরাসরি আমেরিকা অবরোধের মুখে পড়ে। ১৯৮৯ সাল হতে চলা অবরোধ আসলে ডলার আধিপত্যকামী অবরোধ। সত্তরের দশকে সোনার থেকে ডলারকে মুক্ত করে ডলার নিজেই বিশ্বগ্রাহ্য অর্থ হয়ে ওঠে এবং একতরফা একটা সাম্রাজ্যবাদী নিয়ম সমস্ত দেশের উপর লাগু করে দিয়ে। নিয়মটি হল, কোনও দেশ খনিজ তেল ক্রয়-বিক্রয় ডলার ছাড়া করতে পারবে না। সাদ্দাম ইউরোতে তা শুরু করেছিল বলে তাকে খুন হতে হল। কার্যত বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশ তার মুদ্রা সার্বভৌমত্ব হারালো এই নিয়মের বলে। কিউবার উপরে এই অবরোধ চরম অবস্থানে পৌঁছল, কার্যত কিউবার কৃষি ছিল শিল্পনির্ভর অর্থাৎ ট্রাক্টর, কৃত্রিম সার ও কীটনাশক নির্ভর। তার উপর ডলারের আক্রমণ চরম জায়গায় পৌঁছল। কিউবার ভাঁড়ারে ডলার শূন্য। খনিজ তেল, সার, যন্ত্রপাতি কিনবে কী করে? কিউবা এক চরম খাদ্য সংকটে পড়ে যায়। কিউবার চরম খাদ্য সংকটই কিউবাকে নতুন পথের সন্ধান দেয়।
কিউবার নেতৃত্ব সেদিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতি স্বীকার না করে, দেশের জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা ও শ্রমিক কৃষকের সহযোগিতার উপরে ভরসা রাখে। কৃষকরা ট্রাক্টর ছেড়ে হাল-বলদে ফিরে গেল প্রকৃতি নির্ভর জৈব চাষকে কেন্দ্র করে। আর শ্রমিকরা একই পদ্ধতিতে শহুরে চাষ গড়ে তুলল। হাল বলদে ফিরে গেলে কৃষি উৎপাদন যে বিপুল মাত্রায় মার খাবে সেটা নেতৃত্ব জানতো বলেই, শহরে যে যেখানে জমি পেল বাড়ির আশেপাশে সেখানেই তারা বিভিন্ন ধরনের চাষ গড়ে তুলল। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে এই যজ্ঞ গড়ে উঠল প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। বারবার আঘাত করে বা দেশের মধ্যে বেশ গুপ্তচর ছেড়ে দিয়েও যাকে ভাঙতে পারেনি আমেরিকা। উল্টে আমেরিকার মানুষ হারিকেনের মতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে পড়লে কিউবা তাদের মেডিকেল টিম পাঠানোর আহ্বান জানাতে থাকে। আমেরিকা মেহনতী মানুষের কাছে নতুন বার্তা যেতে শুরু করল, ব্যক্তি মালিকানা নির্ভর আমেরিকা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা তাদের কাছে পরিস্ফুট হতে শুরু করল। উল্টে কিউবা তাদের উন্নত মেডিকেল পরিষেবা গড়ে তুলে, সেই পরিষেবা সহমর্মিতার সঙ্গে সারা বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশকে দিতে শুরু করে। এই সকল দেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এসে কিউবা নিখরচায় তাদের বৃত্তি সহযোগে ডাক্তারি পড়াতে শুরু করে এবং তাদের দিয়ে মুচলেকা নেওয়া হয়, শিক্ষার শেষে তাদের দেশে ফিরে গিয়ে যেন তারা ন্যূনতম দুই বছরের বেশি গ্রামের জনগণকে পরিষেবা দেয়। কোভিডকালীন সময়ে ইউরোপ, এশিয়া, ল্যাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা জুড়ে কিউবার মেডিকেল সাহচর্য উজ্জ্বল ভূমিকা রাখে। কিউবার এই ভ্রাতৃত্ব বিশ্ব জনগণের সামনে উজ্জ্বল এক সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসে। পাশাপাশি এই সময় আমেরিকা বেসরকারি মেডিকেল পরিষেবা আমেরিকা জনগণের দুর্দশার কারণ হিসাবে পরিলক্ষিত হল বিশ্বের জনগণের কাছে।
এবারে আসা যাক প্রকৃতির রোষ থেকে কিউবা নিজেকে কীভাবে বাঁচবার পরিকল্পনা নিল এই অবরোধকালীন সময়েও। ঘূর্ণিঝড় কবলিত সমুদ্র উপকূল অঞ্চল থেকে ১১ শতাংশ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে বাসস্থান গড়ে দিল, এবং উপকূলবর্তী ঐ সকল অঞ্চলে প্রায় ৩৮০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের চাষ করা হল। কোরাল দ্বীপপুঞ্জ গুলির ক্ষতিকেও মেরামত করা হল। সোলার সরঞ্জামের উপর আমেরিকা অবরোধ থাকা সত্ত্বেও কিউবা ২৪% বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করল পুনর্নবীকরণযোগ্য পদ্ধতিতে (renewable energy)।
শ্রীলঙ্কায় কী ঘটল
শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোতাবয়ে রাজাপক্ষ গদিতে বসেই তামিল জাতির উপর ফ্যাসিস্ট কায়দায় আক্রমণ নামিয়ে আনেন। সরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে নিজের আত্মীয়-স্বজনকে বসিয়ে এক ধরনের পরিবারতান্ত্রিক শাসন গড়ে তোলেন। দেশের মধ্যে অনুৎপাদক ক্ষেত্রে বিপুল ব্যয় বাড়িয়ে তুলে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার অর্থাৎ ডলার প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেন। জ্বালানি কেনা প্রায় তার কাছে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে ২০২১ সালে গোতাবয়ে রাজাপক্ষ আচমকা দেশ জুড়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং জৈব চাষ প্রবর্তন করেন। কৃষকদের থেকে আপত্তি থাকলেও তিনি তা কর্ণপাত করেন না। চাষিরা বলেন ধীরে ধীরে জৈব চাষে যাওয়া সম্ভব, এইভাবে নয়। উৎপাদক সমাজকে অস্বীকার করার ফলে, দেশের কৃষি উৎপাদন বিপুল পরিমাণে হ্রাস পায় এবং খাদ্য সংকট তৈরি হয়। দেশ জুড়ে মানুষের বিক্ষোভ এতদূর দানা বাধে যে জনগণ কার্যত কলম্বো শহর অবরোধ করে বসেন এবং সরকারের পতন ঘটে। এখন অবশ্য সেখানে বামপন্থী সরকার গঠন হয়েছে।
এই দুই দেশ থেকে শিক্ষা
প্রকৃতিকেন্দ্রিক জৈব চাষ দেশ জুড়ে লাগু করা সম্ভব একমাত্র দেশের উৎপাদক সমাজের সাহচর্যের দ্বারা। একদিকে প্রকৃতিকে ঠিক করতে গেলে জৈব চাষে যেতে হবে, আবার জৈব চাষ গড়ে তুলতে গেলে উৎপাদক সমাজের সাহচর্য দরকার। এই সাহচর্য আসলে আজকের সমাজতন্ত্রে যাওয়ার প্রকৃত পথ। রাশিয়ার পতনের পর ইস্তভান মেসজেরাস Beyond Capital নামে একটি বই লেখেন। তিনি দেখান, সোভিয়েত ব্যবস্থা পুঁজিকে অতিক্রম করতে পারেনি। সেখানে তিনি মার্কসের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বকে সামনে এনে দেখান, পুঁজি তার মুনাফাকেন্দ্রিক সামাজিক বিপাকীয় সম্পর্ক রাখার জন্য উৎপাদনশীল মানুষদের সঙ্গে প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা ঘটায়, যার ফলে প্রকৃতির মধ্যে এক বিপাকীয় ফাটল দেখা দেয়। এই ফাটলের কারণে পৃথিবী ক্রমশ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ডলার কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে খনিজ তেলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ার ভিতর দিয়েই প্রতিনিয়ত যা অনুভূত হচ্ছে। তাই পুঁজির বিপাকীয় সামাজিক সম্পর্ককে উৎখাত করে মানুষ প্রকৃতির বিপাকীয় সম্পর্ক গঠন করতে হবে। আর এই বিপাকীয় সম্পর্ক উৎপাদক সমাজের নেতৃত্ব ছাড়া গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। কিউবা ধীরে ধীরে এইরূপ সমাজের একটি ছবি পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছে। আজকে পুঁজিবাদের কারণে, প্রকৃতি যখন ভারসাম্য হারিয়েছে, তখন এই রূপ উৎপাদক সমাজের সাহচর্য গড়ে তোলাটাই প্রাথমিক কাজ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.